দোল পূর্ণিমা বা হোলি উৎস সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে একটি অতি আনন্দের উৎসব। এটি শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভুর আবির্ভাব তিথি। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা উৎসবটি বিভিন্নভাবে ও বিভিন্ন নামে পালন করে থাকেন। কোথাও হোলি উৎসব, দোল পূর্ণিমা উৎসব আবার কোথাও বা গৌর পূর্ণিমা উৎসব নামে। তবে হোলি উৎসব ও গৌর পূর্ণিমা উৎসব দুটি একই দিনে পালিত হলেও উৎসব দুটি মূলত আলাদা। উৎসবটি হোলি উৎসব নামেই বেশি পরিচিত। কথিত আছে, দৈত্যরাজা হিরণ্যকশিপুর দানবী বোন হোরিকা বা হোলিকাকে এই দিনে হত্যা করা হয়েছিল। তাই অশুভ নাশের আনন্দে ব্রজবাসীরা আনন্দ উৎসব হিসেবে এই দিনটি পালন করেন। ৫৫০০ বছর আগে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবন লীলায় ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে ব্রজবাসীরা তাদের প্রাণপ্রিয় কানাইয়া ও বৃন্দাবনের রাধারানীকে একত্রে পেয়ে সীমাহীন আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে একটি আনন্দ উৎসবের আয়োজন করেন। সেই উৎসবে তারা রাধারানী ও শ্রীকৃষ্ণকে ফুলের দোলনাতে বসিয়ে মহাআনন্দে দোল দেন এবং সেই আনন্দ বহুগুণে বর্ধিত হলে তাঁরা রাধাকৃষ্ণের চরণে বিভিন্ন বর্ণের আবির ঢেলে প্রেমানন্দের বহির্প্রকাশ ঘটান। সেই স্মৃতিকে স্মরণ করে আজও ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে এই রঙের উৎসব পালিত হচ্ছে।
৫৩২ বছর আগে, ভারতের পশ্চিম বাংলার নদীয়া জেলায় নবদ্বীপের মায়াপুরে ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দ বাংলা ৮৯১ সালে ২৩ ফাল্গুন দোল পূর্ণিমা তিথিতে সন্ধ্যাবেলায় পুণ্যলগ্নে চন্দ্রগ্রহণ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শ্রী জগন্নাথ মিশ্রর বাড়িতে পরমেশ্বর শ্রীচৈতন্যের শুভ আবির্ভাব এক অবিস্মরণীয় এবং বিস্ময়কর ঘটনা। বাঙালীর হৃদয়ের ধন চৈতন্যদেব- নিমাই, গৌরাঙ্গ, গৌররায়, গোরা, গৌর, গৌরহরি, শচীনন্দন প্রভৃতি নামেও পরিচিত।
শ্রীচৈতন্য দেবের আন্দোলন মূলত ধর্মান্দোলন। তাঁর প্রেম প্রধানত ভগবতপ্রেম- কৃষ্ণপ্রেম। তাঁর অস্ত্র শ্রীনাম সঙ্কীর্তন। তাঁর যৌবনকালের অলৌকিক পাণ্ডিত্য- বিদ্যাগর্বীদের গর্ব খর্ব করে বিনম্র হতে শিক্ষা দিয়েছিল। তাঁর আবিষ্কৃত নাম প্রেমধর্মের প্রচারÑআচারসর্বস্ব ধর্মানুষ্ঠান, স্মার্ত ক্রিয়াকলাপকে উৎখাত করে সঙ্কীর্তন অঙ্গনে সব মানবের মহামিলন ঘটিয়েছিল। সাধন ক্ষেত্রে জাতিভেদ প্রথা দূর করে আচ-াল অস্পৃশ্যকে তিনি কোল দিয়েছিলেন। চাঁদকাজির বিরুদ্ধে তাঁর অভিযান, ধর্মীয় ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার অর্জনের অভিযান। শাসকের বিরুদ্ধে উৎপীড়িতের প্রতিবাদ। জগাই-মাধাই উদ্ধারের মধ্যে তিনি মানুষের দম্ভকে গলিয়ে, তার পাশবিকতাকে মানবিকতার ভূমিকায় উত্তরণের পথ দেখিয়েছেন- ভালবাসা দিয়ে।
ভালবাসাই নিখিল বিশ্বের সঙ্গে বিশ্বমানবের মধ্যে প্রেম ও মৈত্রীর সেতুবন্ধন করে। তাই শ্রীদীনেশচন্দ্র সেন লিখেছিলেন, ‘প্রেম একবারই মূর্তি পরিগ্রহ করেছিল, তা এই বাংলার নদীয়ায়।’ যুগমানব হিসেবে শ্রীচৈতন্যের এখানেই সার্থকতা। আর সেই অবিস্মরণীয় প্রভাব যা দীন দরিদ্র, দলিত অবহেলিত মানুষ থেকে সমাজের উচ্চস্তরের সমৃদ্ধ জনগণকেও ত্যাগ ও ভালবাসার আদর্শে অনুপ্রাণিত করেছিল।
বেদে আছে ‘কৃষ্ণস্তু ভগবান স্বয়ং’
-অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণই পরমেশ্বর ভগবান স্বয়ং, অনন্ত কোটি বিশ্ব ব্রহ্মা- যার ইচ্ছায় সৃষ্টি হয়েছে, প্রতিপালিত হচ্ছে এবং বিলীন হয়ে যাবে।
‘গোবিন্দং আদি পুরুষং’
-অর্থাৎ বিশ্ব ব্রহ্মা-ের সবচেয়ে আদি পুরুষ শ্রীকৃষ্ণ। তাঁর আগে কোন কিছুই ছিল না। এই কলিযুগে হতভাগ্য জীবদেরকে উদ্ধার করে ভগবদ্ধামে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য শ্রীকৃষ্ণ পরমেশ্বর ভগবান স্বয়ং ভক্তবেশ ধারণ করে মহা প্রভু শ্রীচৈতন্য রূপে আবির্ভূত হয়েছেন। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুই যে শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং তা শাস্ত্রে বহু প্রমাণ আছে।
॥ সামবেদ ॥
‘তথাহং কৃতসন্ন্যাসো ভূগীর্বাণোহবতরিষ্যে
তীরেহলকানন্দায়া : পুন: পুনরীশ্বরপ্রার্থিত সপরিবারো, নিরালম্বো নির্ধূত কলিকল্মষ-কবলিত-জনাবলম্বনায়।’
আমি সন্ন্যাস গ্রহণ করিয়া, পুনঃ পুনঃ ঈশ্বর শ্রীঅদ্বৈত-প্রবর্তিত হইয়া, ভূদেবতা ব্রাহ্মণরূপে, অন্যাশ্রয় নিরপেক্ষ এবং অবিচলিতভাবে কলি-কলুষ-কবলিত জীবের উদ্ধারার্থ সপরিকর অলকানন্দার তীরে অবতীর্ণ হইব।
॥ পদ্মপুরাণ ॥
কলে : প্রথমসন্ধ্যায়াং গৌরাঙ্গোহসৌ মহীতলে।
ভাগীরথ্যা স্তটে ভূয়ো ভবিষ্যতি সনাতন:
এই সনাতন শ্রীকৃষ্ণ কলির প্রথমসন্ধ্যায় শ্রীগৌরাঙ্গরূপে পৃথিবীতে ভাগীরথী-তীরে পুনর্বার অবতীর্ণ হইবেন।
॥ মার্কন্ডেয় পুরাণ ॥
গোলোকঞ্চ পরিত্যজ্য লোকানাং ত্রাণকারণাৎ।
কলৌ গৌরাঙ্গরূপেণ লীলা-লাবণ্য-বিগ্রহ: ॥
শ্রীভগবান লোকসমূহের ত্রাণের নিমিত্ত গোলোক পর্যন্ত পরিত্যাগ করিয়া কলিতে গৌরাঙ্গরূপে লীলা-বিগ্রহধারী করিবেন।
॥ বরাহপুরাণ ॥
কলে: প্রথমসন্ধ্যায়াং লক্ষ্মীকান্তো ভবিষ্যতি।
ব্রহ্মরূপং সমাশ্রিত্য সম্ভবামি যুগে যুগে ॥
কলির প্রথম সন্ধ্যায় লক্ষ্মীকান্ত ব্রাহ্মণরূপ আশ্রয় করিয়া আবির্ভূত হইবেন। শ্রীভগবান বললেনÑ আমি যুগে যুগে আবির্ভূত হই।
॥ সৌর পুরাণ ॥
সুপূজিত: সদা গৌর: কৃষ্ণো বা বেদবিদ্ দ্বিজ: ।
এই শ্রীকৃষ্ণচন্দ্রই বৈদিক ব্রাহ্মণ হইয়া বা শ্রীগৌরাঙ্গরূপে জগতে সুপূজিত হইবেন।
তাই, যারা মহাপ্রভুকে পরম পুরুষোত্তম পরমেশ্বর ভগবান বলে অস্বীকার করে তারা অসুর বলে পরিগণিত। সর্বশাস্ত্র বিদিত পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভুর পরম করুণার দ্বারাই জীবের ভববন্ধন মুক্তি সম্ভব। তাই আমাদের শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর কৃপা লাভ করার জন্য প্রয়াসী হতে হবে।
লেখক : ভক্তিশাস্ত্রী, ইসকন, ঢাকা