
ইব্রাহিম নোমান ॥ বাংলার বাঘদের গর্জন যেন ক্রমশ আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে তুলছে। এ ভূখন্ডের ১৭ কোটি বাঙালীর ক্রিকেটীয় আবেগে জাগ্রত হচ্ছে অবিরত। বাংলাদেশের খেলা বিশ্বের যে প্রান্তেই হোক না কেন, হোক সেটা সুদূর মেলবোর্ন বা কলম্বো কিংবা লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ড, সেখানেই বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা গায়ে হাজারো দর্শক। মাঠে বসে টাইগারদের অনুপ্রেরণা দিচ্ছেন হাজারো বাঙালী। পিছিয়ে নেই সহস্র কিলোমিটার দূরের টেলিভিশনের সামনে বসা ক্রিকেটপ্রেমীরাও। আর যারা বাসার বাইরে কিংবা কর্মক্ষেত্রে আছেন তাদের ভরসা বেতার তরঙ্গে ভেসে আসা ক্রিকেট ধারাভাষ্য। একটি ভাল বল, একটি উইকেট মানেই চিৎকার, বাহবা। প্রাণের আওয়াজ যেন পৌঁছে যাচ্ছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের কাছে। ক্রিকেট নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের উচ্ছ্বাস আর স্বপ্নের যেন কোন শেষ নেই।
২০১২ সালে এশিয়া কাপের ফাইনালে পাকিস্তানের কাছে দুই রানে হেরেছিল বাংলাদেশ। এমন হারের পর মাঠেই সাকিব-মুশফিকের কান্নার সঙ্গে কেঁদেছিল পুরো বাংলাদেশ। খেলার মাঠ শুধু নির্দিষ্ট একটি গ-িই নয়, ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল তার ১৭ কোটি মানুষ। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের দেশটিতে টাইগারদের সঙ্গে সকলেই মেতে ওঠে ক্রিকেট উন্মাদনায়। ক্রিকেট উন্মাদনায় ফেসবুকের প্রোফাইল ছবিতে বাংলাদেশ লেখা বিসিবির সিল বসিয়ে নিচ্ছেন বাংলাদেশীরা। প্রবাসী বাংলাদেশীরাও বদলে নিচ্ছেন প্রোফাইলের ছবি। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে সবচেয়ে উজ্জ্বল করে তুলে ধরেছে টাইগাররা।
বাংলাদেশের খেলা থাকলে দুপুরের পর অনেকেই কর্মস্থল থেকে ছুটি নিয়ে নিজ বাসায় বা বন্ধুদের সঙ্গে খেলা দেখার জন্য ছুটছেন। সবাই মিলে গলা ফাটিয়ে বাংলাদেশের চার-ছক্কার জয়ধ্বনি দিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে বড় পর্দায় খেলা দেখার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। এমনকি বিয়ে বাড়িতেও লাগানো হয় বড় স্ক্রিন। বিয়ে খেতে এসে যেন কেউ খেলা দেখা থেকে বঞ্চিত না হয় সে জন্যই এই ব্যবস্থা।
ক্রিকেট উন্মাদনায় ভাসছে দেশ
ধানমন্ডি -গুলশান-বেইলি রোডের কফিশপ থেকে রেস্টুরেন্ট, ইন্দিরা রোডের টিএ্যান্ডটি মাঠ, বুয়েট মাঠ, শাহবাগের টিএসসি ও জাতীয় জাদুঘরের সামনে, ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবর, উত্তরা, ধানমন্ডির স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি, ইস্টওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির সামনে, মোহাম্মদপুরের কাঁটাসুরের মকবুল কলেজের সামনে, কলাবাগান মাঠ, মাতুয়াইল মেডিক্যাল কলেজের ভেতরে, বনানী ক্লাব মাঠ, ফার্মগেটের সরকারি বিজ্ঞান কলেজের মাঠ, সেনপাড়া পর্বতা, পুরান ঢাকার গোপীবাগ, লক্ষ্মীবাজার, সূত্রাপুরসহ রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় বড় পর্দায় খেলা দেখানো হয়।
এ ছাড়া বড় বড় শপিংমলসহ প্রতিটি এলাকাতেই প্রজেক্টর দিয়ে বড় পর্দায় খেলা দেখার আয়োজন করা হয়। রাস্তার পাশে ছোট ছোট চায়ের দোকানেও বসানো হয় টিভি সেট, সন্ধ্যার পরে যেন কারোরই খেলা দেখতে কোন অসুবিধা না হয় সে জন্য। সবাই উল্লাসে চিৎকার করবে, সবার মুখেই থাকবে একটি নাম- বাংলাদেশ।
শুরুর কথা
বাংলাদেশের ক্রিকেটের যাত্রা খুব বেশি দিন আগের নয়। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল ১৯৭৯ সালে সর্বপ্রথম ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত আইসিসি ট্রফিতে অংশগ্রহণ করে। প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ হিসেবে বাংলাদেশ বেশ ভাল পারফরমেন্স করে। ৪ ম্যাচের মধ্যে তারা দুটিতে জয়লাভ করে। আর বাকি দুটিতে পরাজিত হয়। আন্তর্জাতিক ম্যাচ হিসেবে এর পর তাদের যাত্রা ধারাবাহিক হয়নি। প্রায় সাত বছর আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা থেকে দূরে ছিল বাংলাদেশ। এর প্রায় সাত বছর পর ১৯৮৬ সালের ৩১ মার্চ পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ খেলে বাংলাদেশ। তবে সেই আশির দশকে ক্রিকেট নিয়ে উন্মাদনা বর্তমানের মতো ছিল না। মূলত তখনকার তরুণ প্রজন্মের কাছে ফুটবলই ছিল আকর্ষণীয় ব্যাপার। এই ট্রেন্ডের একটু একটু বদল হওয়া শুরু হয় ১৯৯৭ সালে যখন বাংলাদেশ কেনিয়াকে হারিয়ে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন হয় তার মাধ্যমে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৯ এর বিশ্বকাপে প্রথম অংশগ্রহণ ও ২০০০ সালের ২৬ জুন টেস্ট খেলুড়ে দেশ হিসেবে সদস্য পদ লাভ। ২০০০ সালের ১৩ নবেম্বর বাংলাদেশের অধিনায়ক নাইমুর রহমান দুর্জয়ের অধিনায়কত্বে টেস্ট অঙ্গনে যাত্রা শুরু করেন। কালের পরিক্রমায় হাঁটি হাঁটি পা পা করে বাংলাদেশ দল এবার খেলেছে শততম টেস্ট।
চীন বা রাশিয়ার ছেলেদের জিজ্ঞাসা করুন কে ক্রিকেটার হতে চান, তখন ১০০ জনের মধ্যে ৩ জনই রাজি হবে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ১০০ জনের মধ্যে ৯৯ জন ক্রিকেটার হতে চাইবে। সবাই এখন চায় সাকিব-তামিম-মুস্তাফিজ বা সাব্বির হতে। এই উন্মাদনা এই ভালবাসাই বাংলাদেশ ক্রিকেটকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। ২০১৪ সালের শেষে অধিনায়ক মাশরাফি যখন আরেক দফা বাংলাদেশের ক্রিকেটে প্রবেশ করলেন, সেই সময় কী টালমাটাল অবস্থায় ছিল দল! একের পর এক পরাজয়ে ক্লান্ত-বিধ্বস্ত। মাশরাফি নেতৃত্ব নেওয়ার পরই আমরা ঘরের মাঠে টানা সাত সিরিজের ছয়টি জিতেছি। পেয়েছি ২০১৫ বিশ্বকাপে সাফল্যও। অধিনায়ক মাশরাফি তার ক্ষুরধার ক্রিকেটীয় জ্ঞানের মাধ্যমে পুরো দলকে বেঁধেছেন ঐক্যের মূর্ছনায়।
ক্রিকেট মান্থলি ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে আমাদের গল্প
প্রতি মাসেই ‘ক্রিকেট মান্থলি’ নামে একটি ক্রিকেট বিষয়ক ম্যাগাজিন বের করে ক্রিকেটের জনপ্রিয় ওয়েবসাইট ইএসপিএন-ক্রিকইনফো। তাদের প্রচ্ছদে ঠাঁই পেয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেটের গল্প। ‘রেড সান রাইজিং’ নামের এই প্রচ্ছদটিতে আছে বাংলাদেশ ক্রিকেটের উত্থানের গল্প। অসংখ্যা হারের বঞ্চনা ও আশার মরীচিকার পর এবার সত্যিই বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশ, দেখছে নতুন শুরু। বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের জয়ের অভ্যাস শুরু হচ্ছে। আগে বাংলাদেশকে একটা জয়ের জন্য অনেক অপেক্ষা করতে হতো। এখন সেটা নেই। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ জয়ের খুব কাছাকাছি গিয়েও পরাজয় বরণ করেছে। কিন্তু এখন যেন একটু একটু করে সেই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ক্রিকেটের সব ঘটনা, হতাশা ও উত্থানের অনেক কথা উঠে এসেছে ক্রিকেট মান্থলির প্রচ্ছদে।
ব্যাপক উত্তেজনা
ক্রিকেট নিয়ে দেশের সকল মানুষের মধ্যে বিরাজ করছে ব্যাপক উত্তেজনা। ফেসবুকে চলে ক্রিকেটের সাপোর্টে প্রোফাইল পিক্সচার রাঙানোর খেলা। বাংলাদেশের খেলা চলাকালীন গ্যালারির অনেকটা অংশজুড়ে দেখা যায় বিনোদন জগতের মানুষের কোলাহল। শুধু তাই নয়, ক্রিকেট নিয়ে সঙ্গীতকার থেকে শুরু করে মডেল অভিনেত্রীরাও গেয়ে ওঠেন সমর্থনের গান। আর বাংলাদেশ দল যেন এতে ফিরে পায় জয়ের নেশা। অনেক গান তৈরি হয়েছে ক্রিকেট নিয়ে। এসআই টুটুল, অর্ণব, আসিফ, কনা, হৃদয় খানসহ অনেক সঙ্গীতশিল্পী গেয়েছেন ক্রিকেটের গান। দেশের প্রতিটি মানুষ ক্রিকেটপ্রেমী। তারা ক্রিকেটের সুসময় দুঃসময় সব সময় যেন বাংলাদেশ দলের পাশে থাকে।
উত্তেজনায় অনাকাক্সিক্ষত ভুল
বাংলাদেশে ক্রিকেট মানেই এখন উন্মাদনা। সেই উন্মাদনা এতই তীব্র যে পান থেকে চুন খসলেই তা নিয়ে চিল্লাপাল্লা, গালাগাল করছি। শুধু তাই নয়, আমরা খেলোয়াড়, ক্রীড়া সংগঠক থেকে শুরু করে দেশ-বিদেশের সমর্থকদেরও একেবারে নাস্তানাবুদ করে ছেড়ে দিচ্ছি। অথচ ভাবছি না দুই-তিন বছর আগেও আমরা যা খেলেছি, যে কয়টা ম্যাচ জিতেছি- এখন তার চেয়ে অনেক বেশি ম্যাচ আমাদের টিম জিতে চলেছে। আগের চেয়ে অনেক বেশি নতুন নতুন খেলোয়াড় দলে এসে পারফর্ম করছে, টিমকে জেতাচ্ছে। আমাদের প্রতি ম্যাচেই জয় চাই! তামিম কেন এটা করল, মাহমুদুল্লাহ কেন এভাবে খেলল? এদের কেন দলে নিয়েছে? একবার ভেবে দেখুন স্যার ডোনাল্ড ব্যাডম্যান তার নিজের শেষ ইনিংসে যদি শূন্য রানে আউট না হতেন তা হলে ক্যারিয়ার গড় থাকত ১০০! তেমনি সাত বিলিয়ন মানুষের মধ্যে যে বিশ্ব সেরা অলরাউন্ডার সেই সাকিব আল হাসানেরও ভুল হয়। কাটার মাস্টার মুস্তাফিজেরও ভুল হয়। আমাদের মনের যাতনা থেকেই হয়ত উত্তেজনায় অনাকাক্সিক্ষত ভুল হয়, আমরা প্রিয় ক্রিকেটারকেও ভুল বুঝি। বিশ্বসেরা সাকিব, তামিম, সৌম্য একটা বলকে কত ন্যানো সেকেন্ডের ব্যবধানে সীমানার বাইরে পাঠাচ্ছেন কখনও বা ব্যর্থ হচ্ছেন। পাড়া-মহল্লা,অলি-গলি বা প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট খেলা আর ক্রিকেটের মক্কাখ্যাত লর্ডসের মাঠে লাখো দর্শকের মাঝে পারফর্ম করা আসলেই এক কথা নয়। আমরা ভালবাসার মানুষের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি প্রত্যাশা করি। ভালবাসার মানুষের প্রতিই সবচেয়ে বেশি অনুরাগ কাজ করে। তেমনি প্রতিটি খেলোয়াড় আমাদের ভালবাসার। অনাকাক্সিক্ষত মন্তব্যও ভালবাসা থেকেই আসে! তবে আমাদের ক্রিকেট যেমন প্রতিনিয়ত উন্নতি করছে তেমনি ভক্তদের মনমানসিকতারও উন্নতি হওয়া প্রয়োজন। খেলায় হারজিত থাকবেই। একটা-দুটো খেলায় খারাপ দিন যেতেই পারে। তবে বুঝতে হবে আপনার সন্তান, ভাই মাশরাফি-সাকিব-তাসকিনরা কখনও হারার জন্য খেলে না। ওরা সর্বোচ্চ দিয়েই জয় ছিনিয়ে আনে।
চুলে ক্রিকেট স্টাইল
দল-মত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আমরা সবাই এই একটা জায়গায় এক। আমরা বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমের পাগলা সাপোর্টার। এই একটা ক্ষেত্রে আমরা একসঙ্গে হাসি, একসঙ্গে কাঁদি, একসঙ্গে হতাশ হই, একসঙ্গে উল্লাস করি। শুনে বাড়াবাড়ি মনে হলেও আমাদের অনেকের অবস্থাই এখন এমন। খেলা দিয়ে মাঠ কাঁপাচ্ছেন ক্রিকেটাররা। আর মাঠের বাইরে ভক্তদেরও প্রিয় ক্রিকেটারের মতো হওয়া চাই। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজার কানের দুই পাশ ও পেছনের চুল আগের চেয়ে কিছুটা ছোট করেছেন। মাথার ওপরের চুলগুলো আন-ইভেন স্পাইক করা। চুলের কাটের সঙ্গে হাল্কা দাড়ি ও গোঁফ মাশরাফির লুকে এনেছে নতুনত্ব।
সাকিব আল হাসানের চুলের নতুন স্টাইলের নাম মোহক। সারা বিশ্বে বর্তমানে এই স্টাইলটা জনপ্রিয়। এর আগে ফুটবলার ডেভিড বেকহামকেও দেখা গেছে এই স্টাইলে।
ক্রিকেটে পথচলাটা বেশি দিন হয়নি তার পরেও ক্রিকেটের সব বাঘা বাঘা দেশের সঙ্গেই পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। দেশে থাকা মানুষেরা যেমন ক্রিকেট নিয়ে ভালবাসা বহির্প্রকাশ করে, ঠিক প্রবাসে থাকা কোটি বাঙালীর এই প্রাণের খেলাটা নিয়ে আরও বেশি উচ্ছ্বসিত। মনের মধ্যে জমিয়ে থাকা এই বেদনা, এই কষ্ট লাঘব করে দেয় ক্রিকেট। এই ক্রিকেটই হাজার মাইল দূরে থাকা আমাদের টের পেতে দেয় না, দেশ ছেড়ে দূরে আছি। ক্রিকেট কেবল আমাদের জন্য খেলা নয়, দেশের বুকে থাকার একটা ব্যাপার।
ঐক্যের প্রতীক
সব কিছুতেই নানা দল, নানা মত আর অহেতুক বিতর্ক। কিন্তু ক্রিকেটের বিজয় মানেই সব ভেদাভেদ ভুলে হাতে হাত রেখে বিজয় উল্লাস। ক্রিকেটের বিজয় মানেই নানা সঙ্কটকে দূরে ঠেলে এগিয়ে যাওয়া। ১৯ মার্চ, ২০১৭ এক মহিমান্বিত দিন। বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল তার শততম টেস্ট ম্যাচ জিতে প্রতিটি বাংলাদেশীকে শুধু আনন্দের সাগরে ভাসায়নি, পুরো দেশকে দীর্ঘদিন পর বেঁধেছে ঐক্যের সুতায়। ক্রিকেট যেন বাংলাদেশকে নতুন করে চেনায় নতুন প্রজন্মের প্রতিটি তাজা প্রাণকে। সমস্ত গ্লানি, আত্মপরিচয়ের সঙ্কট, জীবনের নানা অনিশ্চয়তা, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সঙ্কটকে পেছনে ফেলে স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলার কঠিন সংগ্রামে প্রস্তুত হওয়ার রসদ যোগায় ক্রিকেটের প্রতিটি বিজয়। আমাদের ক্রিকেটাররা কি জানেন, তারা প্রতিনিয়ত এভাবেই বাংলাদেশকে বেঁধে চলেছেন এক বিরল মায়ার বন্ধনে। আমাদের এই টাইগাররা কি জানেন, এভাবেই তাদের প্রতিটি ছক্কা-চারে, প্রতিটি শারীরিক ভঙ্গিতে প্রতিটি বাংলাদেশীর দেহ-মনে কী হিল্লোল সৃষ্টি করে চলেছেন!
শততম টেস্টে জয়
আমাদের শততম টেস্টের দিন দেশ ও দেশের বাইরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকরী প্রতিটি বাংলাদেশীকে যেন হাজির করেছিল কলম্বোর সবুজ চত্বরে। খুলনার টাইগার মেহেদী মিরাজের ব্যাট থেকে যখন জয়সূচক রান আসল তখন জয়বাংলা বলে সবাই যেন ছুটে যেতে চাইছিল সিংহল সমুদ্র পার হয়ে কলম্বোর মাঠে। বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল-কলেজ, বাজার, বন্দরে, অফিস-আদালত যেন থমকে ছিল খানিকের জন্য। মেহেদী-মুশফিকের বিজয় দৌড়ে শামিল হয়ে আবেগী বাংলাদেশীরাও সময় ভুলে রুদ্ধশ্বাস দৌড়ে কাঁপিয়েছে রাজপথ। কপালে-দেহে লাল-সবুজের পতাকা জড়িয়ে ‘বাংলাদেশ’ ‘বাংলাদেশ’, ‘জয়বাংলা’ স্লোগানে প্রকম্পিত করেছে বাংলার আকাশ-বাতাস।
ক্রিকেটের প্রতিটি বিজয় এ দেশের মানুষকে কীভাবে, কতভাবে যে অনুপ্রাণিত করে তা বুঝতে পারা সহজ কাজ নয়। বড়-ছোট, রিক্সাওয়ালা-যাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, নেতা-কর্মী, পিয়ন-সচিব, আমির-ফকির সবাই যেন এক নিমিষে এক কাতারে, একই ছায়াতলে মনপ্রাণ দিয়ে নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পায় যে গৌরবের মহিমায়, সে যে ক্রিকেট।
এক শুভক্ষণেই না ক্রিকেট আবার প্রতিটি বাংলাদেশীর মনে জাগাল দেশপ্রেমের চেতনা! ১৯৭১ সালের এ মাসেই ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করেছিলেন। এমন একটি মাহেন্দ্রক্ষণে বাংলাদেশের টাইগাররা পুরো জাতিকে ভাসালেন ঐক্যের সঙ্গীতে।
ক্রিকেট কী না করছে বাংলাদেশে? সীমান্তে দেশমাতৃকার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় অতন্দ্রপ্রহরী বিজিবি সদস্য থেকে শুরু করে ঢাকার জনসমুদ্রে কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশ, কার মুখে না হাসি আনছে এই ক্রিকেট? হাসতে ভুলে যাওয়া রাশভারি ব্যক্তিও হাসিমুখে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, মুশফিক-সাকিবের ছক্কা-চারে উল্লাসে ফেটে পড়ছেন একটু পর পর।
বাংলাদেশের জন্য ক্রিকেট শুধু আর চার-ছক্কার খেলা নয়। শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়। ক্রিকেট এখন বাংলাদেশের অস্তিত্বের আরেক নাম। ক্রিকেট এখন বাংলাদেশের সেই শামিয়ানা, যেখানে দল-মত-শ্রেণী পেশা নির্বিশেষে প্রতিটি বাংলাদেশী আশ্রয় নিচ্ছে পরম আনন্দে, নিজেকে খুঁজে পাচ্ছে নতুন পরিচয়ে। ক্রিকেটই এখন নতুন প্রজন্মের প্রধান পরিচয়, ক্রিকেটই এখন ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশের নিউক্লিয়াস।
স্বপ্ন, সম্ভাবনা
শ্রীলঙ্কার মতো ক্রিকেটের প্রতিষ্ঠিত শক্তিকে হারিয়ে শততম টেস্টকে উৎসবে পরিণত করেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। ক্রিকেটের বনেদি মঞ্চে এর চেয়ে বড় সাফল্য আর হতে পারে না। পাঁচ দিনের এ ম্যাচ বেশিরভাগ সময়ই নিয়ন্ত্রণ করেছেন মুশফিকুর রহিম ও তার সহযোদ্ধারা। এ জয় কতটা গৌরবের এটা অনুধাবন করার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার কোন দরকার পড়ে না। ছোট্ট দুটি তথ্যই যথেষ্ট। ঘরের মাটিতে সর্বশেষ টেস্ট সিরিজে বিশ্ব ক্রিকেটের অন্যতম পরাশক্তি অস্ট্রেলিয়াকে ৩-০ ব্যবধানে হারিয়েছে লঙ্কানরা। আর হোম এ্যান্ড এ্যাওয়ে মিলিয়ে এটি শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট জয়। এত বড় অর্জনে ক্রিকেটপ্রেমীরা সর্বোপরি ভক্তরা বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে মেতে উঠবে এটাই স্বাভাবিক।
বাংলাদেশের ক্রিকেটের কথা উঠলেই একে একে আসে সাকিব, তামিম, মুশফিক, মাশরাফি, মুস্তাফিজ, সৌম্যদের কথা। অথচ বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটাররাও কিন্তু কম করছেন না। বড় কোন দলীয় সাফল্য আসেনি ঠিকই, তবে কেউ কেউ একক নৈপুণ্যে বিশ্ব সেরাদের চমকে দিচ্ছেন। খুলনার মেয়ে সালমা আক্তার তেমনই একজন। প্রায় নিয়মিতই বাংলাদেশের হয়ে কথা বলে তার বল-ব্যাট। বাংলাদেশের মেয়েদের ক্রিকেট দলে সালমা খাতুনের ভূমিকা এবং গুরুত্বও সাকিবের মতো। মেয়েদের টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে সালমা তাই বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডারদের একজন।
বাংলাদেশ দলের কোন খেলা থাকলে দেশের মানুষ যেন সব ভুলে যায়, পরিণত হয় ক্রিকেট পাগলে। একসময় ফুটবল নিয়ে মাতামাতি ছিল, কিন্তু ক্রিকেট জ্বর অনেক আগেই তাকে হারিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের কোন ভাল খবর পুরো জাতিকে যেমন উদ্বেলিত করে, তেমনি কোন খারাপ খবরে মুষড়ে পড়েন দেশের মানুষ। দেশের প্রতিটি শিশুই আজ বড় হয়ে একজন ক্রিকেটার হতে চায়, হতে চায় সাকিব-তামিম বা মুস্তাফিজ। এই আবেগ, ভালবাসা, ভাললাগা- যা ক্রিকেটের জন্য, তা নিয়ে বাংলাদেশের স্বপ্ন কী? স্বপ্নটা অনেক বড়। স্বপ্নটা ক্রিকেট বিশ্বকাপ জেতা।
[email protected]