ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

করোনার মতো আরেকটি মহামারীর আশঙ্কা

মাঙ্কিপক্সের প্রবেশ রোধে সর্বোচ্চ সতর্ক হতে হবে

প্রকাশিত: ২৩:২৪, ২৫ মে ২০২২

মাঙ্কিপক্সের প্রবেশ রোধে সর্বোচ্চ সতর্ক হতে হবে

স্বপ্না চক্রবর্তী ॥ বিরল ও স্বল্প পরিচিত রোগ মাঙ্কিপক্স। বিশেষজ্ঞদের মতে পশ্চিম ও মধ্য আফ্রিকার উষ্ণ ও আর্দ্র বনাঞ্চলের বানররা ছিল এ রোগের প্রথম শিকার। তারপর একসময় মানবদেহেও সংক্রমিত হওয়া শুরু করে রোগটি। ১৯৭০ সাল থেকে পশ্চিম এবং মধ্য আফ্রিকার মধ্যেই রোগটি সীমাবদ্ধ থাকলেও এবার আক্রান্ত হয়েছে এ পর্যন্ত ১৬১ জন। ছড়িয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। সর্বশেষ মঙ্গলবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, ভাইরাসটি এ পর্যন্ত ১৬টি দেশে ছড়িয়েছে। দ্রুত সংক্রমণশীল এই ভাইরাসটি শনাক্তকরণের কিট উন্নত দেশগুলোতেই খুব বেশি নেই জানিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, বাংলাদেশে তো এর পরীক্ষা করার কোন ব্যবস্থা নেই। তাই এতে আক্রান্ত কেউ যেন বন্দরগুলো দিয়ে দেশে প্রবেশ করতে না পারে সেক্ষেত্রে নিতে হবে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা। তারা বলছেন, যেহেতু এটি একটি দৃশ্যমান রোগ অর্থাৎ খালি চোখে দেখা যায় তাই টেস্ট কিট ছাড়াই সহজেই তাদের শনাক্ত করা সম্ভব। এদিকে ইতোমধ্যে ভাইরাসটি দেশে শনাক্ত হয়েছে বলে গুজব ছড়িয়ে যাচ্ছে একটা শ্রেণী। যা বন্ধের তাগিদ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওয়েবসাইট এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে জানা যায়, মাঙ্কিপক্স একটি ভাইরাসজনিত অসুখ। স্মলপক্স ভাইরাস শ্রেণীর একটি ভাইরাস এ রোগের জন্য দায়ী। ভাইরাসটির দুটি রূপান্তরিত ধরন রয়েছে মধ্য আফ্রিকান ও পশ্চিম আফ্রিকান। রোগটির বিভিন্ন লক্ষণের মধ্যে রয়েছে জ্বর, মাথাব্যথা, ঘেমে যাওয়া, পিঠে ব্যথা, মাংসপেশির টান ও অবসাদ। প্রথম পর্যায়ে রোগীর জ্বর আসে, পাশাপাশি শরীরে দেখা দেয় ফোস্কা ও অধিকাংশ ঘটনায় শুরুতে মুখে ফুসকুড়ি ওঠে। পরে শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে হাত ও পায়ের তালুতে। উৎপত্তির ইতিহাস ॥ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানায়, ভাইরাসটি ১৯৭০ সালের পর থেকে আফ্রিকার ১১ দেশে মাঙ্কিপক্স সংক্রমণের খবর পাওয়া যায়। ২০১৭ সালের পর নাইজিরিয়ায় এবার সবচেয়ে বেশি এ রোগের প্রকোপ দেখা গেছে। দেশটিতে চলতি বছর এখন পর্যন্ত ৪৬ জনের দেহে উপসর্গ দেখা গেলেও ১৫ জনের সংক্রমণ নিশ্চিত হওয়া গেছে বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সম্প্রতি গত ৭ মে প্রথম একজন ইউরোপীয় নাগরিকের দেহে মাঙ্কিপক্স শনাক্ত হয়। নাইজিরিয়া থেকে ওই ব্যক্তি ইংল্যান্ডে ফিরে এসেছিলেন। এরপর থেকে আফ্রিকার বাইরে অন্তত ১০০ জনের সংক্রমণ নিশ্চিত করার কথা জানিয়েছে ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ড। গত শনিবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছিল যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, স্পেন, পর্তুগাল, জার্মানি, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, ইতালি এবং সুইডেন এই ১২টি দেশে অন্তত ৯২টি মাঙ্কিপক্স সংক্রমণের তথ্য নিশ্চিত হয়েছে। পরে রবিবার ইসরাইল ও সুইজারল্যান্ডও ‘মাঙ্কিপক্স’ ভাইরাস সংক্রমণের কথা জানা যায়। তাই এটি বাংলাদেশে প্রবেশরোধে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। কিভাবে সংক্রমিত হয় ॥ কোন সংক্রমিত ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এলে মাঙ্কিপক্স ছড়াতে পারে। ভাইরাসটি শরীরে প্রবেশ করে ভঙ্গুর ত্বক, শ্বাসনালি, চোখ, নাক বা মুখের মাধ্যমে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো বলছে, যৌন সম্পর্কের মাধ্যমেও এ রোগ ছড়াতে পারে। আগে এমনটা বলা না হলেও এখন ধারণা করা হচ্ছে, যৌন মিলনের সময় সরাসরি সংস্পর্শে এ ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটতে পারে। এছাড়াও সংক্রমিত বানর, ইঁদুর ও কাঠবিড়াল এবং ভাইরাসযুক্ত বস্তু যেমন বিছানাপত্র ও জামাকাপড়ের সংস্পর্শে এলেও ছড়াতে পারে ভাইরাসটি। অতীতেও ঘটেছিল এর প্রাদুর্ভাব ॥ এর আগেও ভাইরাসটির প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়েছিল। ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে মাঙ্কিপক্সের প্রাদুর্ভাব হয়েছিল। আমদানি করা প্রাণীর দেহ থেকে দেশটিতে এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। সেই সময় দেশটির ছয়টি প্রদেশের ৭১ জনের শরীরে মাঙ্কিপক্স শনাক্ত হয়েছিল। কি বলছেন দেশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা ॥ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিরেটাস অধ্যাপক ডাঃ এ বি এম আব্দুল্লাহ জনকণ্ঠকে বলেন, চলমান প্রাদুর্ভাবে এখন পর্যন্ত মাঙ্কিপক্স শনাক্তের ঘটনাগুলো কিছুটা অস্বাভাবিক। যেসব দেশে এই ভাইরাসটি নিয়মিত ছড়িয়ে পড়ে না, সেসব দেশেও বর্তমানে এই ভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হচ্ছে। বর্তমানে শনাক্ত হওয়া এই ভাইরাসের উৎস এবং এর রূপ বদল ঘটেছে কিনা তা বোঝার চেষ্টা করছেন বিজ্ঞানীরা। তবে আমরা বলব যেহেতু এর কোন ওষুধ বা প্রতিষেধক এখনও নেই তাই এটি দেশে প্রবেশে সর্বোচ্চ সতর্কতা নিশ্চিত করতে হবে। না হলে করোনার মতো আরেকটি বড় মহামারী আসতে পারে। তিনি আক্রান্ত দেশগুলো থেকে এই মুহূর্তে প্রবাসীদের দেশে না ফেরারও আহ্বান জানান। একই কথা বলেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডাঃ লেনিন মাহবুব। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, মাঙ্কিপক্স রোগের জন্য এখনও সুনির্দিষ্ট কোন টিকা বা ওষুধ আবিষ্কার হয়নি। তবে ডব্লিউএইচও জানিয়েছে, স্মলপক্স বা গুটিবসন্তের জন্য ব্যবহৃত টিকা মাঙ্কিপক্স প্রতিরোধে ৮৫ শতাংশ কার্যকর। বিমানবন্দরে বিশেষ সতর্কতা ॥ মাঙ্কিপক্স বিষয়ে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ সতর্কই আছে বলে জানিয়েছেন বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম. মফিদুর রহমান। সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানান, মাঙ্কিপক্স নিয়ে ঢাকাসহ দেশের সব বিমানবন্দর সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশে আসা সব যাত্রীকে স্ক্রিনিং করা হবে। স্বাস্থ্য অধিদফতরে সতর্কতা ॥ স্বাস্থ্য অধিদফতর দাবি করছে মাঙ্কিপক্স শনাক্তকরণের প্রাথমিক টেস্ট কিট রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) এর কাছে রয়েছে। এ বিষয়ে অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা জনকণ্ঠকে বলেন, ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাপী আতঙ্ক ছড়ানো মাঙ্কিপক্স রোগ প্রতিরোধে সতর্কতা জারি করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। সন্দেহজনক ও লক্ষণযুক্ত মাঙ্কিপক্স রোগীদের ঢাকায় আইসোলেশনের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা ও আইইডিসিআরে তাদের বিষয়ে তথ্য পাঠানোর নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। মাঙ্কিপক্স নিয়ে গুজব ॥ এদিকে বাংলাদেশে মাঙ্কিপক্সে একজন শনাক্ত হয়েছেন বলে একটি পোস্ট নিজেদের ফেসবুক পেজে পোস্ট করেছে ওয়ার্ল্ড অব মেডিক্যাল সেভিয়ার্স (ডব্লিউএমএস) নামের একটি গ্রুপ। মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত একজন রোগীর ছবি দিয়ে ফেসবুক গ্রুপটি বলছে, বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত একজন শনাক্ত হয়েছেন। যা পুরোপুরি গুজব বলে জনকণ্ঠকে নিশ্চিত করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডাঃ শারফুদ্দিন আহমদ। প্রথম কোয়ারেন্টাইন দেশ ॥ জানা যায়, ‘মাঙ্কিপক্স’ রুখতে প্রথম দেশ হিসেবে বেলজিয়ামে কোয়ারেন্টাইন জারি করলেও বর্তমানে সবচেয়ে দ্রুত আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে যুক্তরাজ্যে। কি বলছেন আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা ॥ জাতিসংঘের স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞরা আফ্রিকার বাইরে ১৪টি দেশে মাঙ্কিপক্স দেখা দেয়ায় এ নিয়ে জেনেভায় এক আলোচনায় ডব্লিওএইচওর প্রধান টেড্রোস আধানম গেব্রিয়াসেস আসন্ন চ্যালেঞ্জের বিষয়ে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, অবশ্যই মহামারি (কোভিড-১৯) বিশ্বের একমাত্র সমস্যা নয়।
×