ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

নাগরিক স্মরণসভা

সৃজনে সংগ্রামে বেঁচে থাকবেন হাসান আরিফ

প্রকাশিত: ০১:১৬, ২২ মে ২০২২

সৃজনে সংগ্রামে বেঁচে থাকবেন হাসান আরিফ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ হাসান আরিফ শুধু একজন প্রখ্যাত আবৃত্তিশিল্পী ছিলেন না, ছিলেন সংস্কৃতিচর্চার অগ্রদূত। সংস্কৃতিচর্চাকে ছড়িয়ে দিতে চষে বেড়িয়েছেন সারা দেশের পথে-প্রান্তরে। উল্টোদিকে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ এই শিল্পী ও সংগঠন জাতীয় জীবনের নানা ক্ষেত্রে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। স্বাধীনতাপরবর্তী দেশের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে ছিলেন সামনের সারিতে। এসব আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়ার পাশাপাশি অনুপ্রাণিত করেছেন সকলকে। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন থেকে যুদ্ধাপরাধবিরোধী আন্দোলনসহ সকল প্রগতিশীল আন্দোলনে রেখেছেন সাহসী ভূমিকা। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার পথরেখায় শোষণমুক্ত ও অসাম্প্রদায়িক স্বদেশ বিনির্মাণের কাজ করেছেন আমৃত্যু। তাই এই কীর্তিমানের শরীরী মৃত্যু হলেও বেঁচে থাকবেন আপন সৃজনে সংগ্রামে। এভাবেই বিশিষ্টজরা মূল্যায়ন করলেন বরেণ্য আবৃত্তিশিল্পী ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফকে। শনিবার বিকেলে কেন্দ্রীয় শহীদমিনারে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট আয়োজিত নাগরিক স্মরণসভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। শিল্পের ভুবনে সৃজনের অনিঃশেষ ফল্গুধারা প্রতিপাদ্যে অনুষ্ঠিত এই স্মরণসভায় অংশ নেন রাজনীতিবিদ, নাট্যজন, শিক্ষাবিদ, সংস্কৃতিজনসহ সমাজের নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ। অনুষ্ঠানের শুরুতে হাসান আরিফের প্রতিকৃতিতে পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করেন সকলে। এরপর জোটের সঙ্গীতশিল্পীরা গেয়ে শোনায় হাসান আরিফকে নিবেদিত সঙ্গীত ‘তোমারো পতাকা যারে দাও, তারে বহিবারে দাও শকতি’। গানের পর জোটের আবৃত্তিশিল্পীরা পরিবেশন করে দেশের আন্দোলন-সংগ্রাম ও ইতিহাস আশ্রিত হাসান আরিফ নির্দেশিত নির্দেশিত আবৃত্তি প্রযোজনা ‘মহাবিজয়ের মহানায়ক’। হাসান আরিফকে নিবেদিত নাসির উদ্দীন ইউসুফ রচিত শোকগাথা পাঠ করেন বরেণ্য আবৃত্তিশিল্পী ভাস্কর বন্দোপাধ্যায়। এই শোকবচন পাঠের পর সেটি তুলে দেয়া হয় হাসান আরিফের বোন রওশন আরা তুলির হাতে। স্মরণসভায় হাসান আরিফকে নিবেদিত কথামালায় অংশ নেন আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পাটির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, বাংলাদেশের কমিউনিটি পার্টির নেতা অধ্যাপক এম এম আকাশ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ, প্রফেসর ডাঃ কামরুল হাসান খান, নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামান নূর, নাট্যজন মামুনুর রশীদ, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক, সংস্কৃতিজন নাসির উদ্দীন ইউসুফ, জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি কবি মুহাম্মদ সামাদ, ম. হামিদ, শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী, নৃত্যশিল্পী সংস্থার সভাপতি মিনু হক, যাত্রাশিল্পী মিলন কান্তি দে, পথনাটক পরিষদের সভাপতি মিজানুর রহমান, রাবেয়া রওশন তুলি, সাংবাদিক মুন্নী সাহা প্রমুখ। সভাপতিত্ব করেন সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি লেখক ও গবেষক গোলাম কুদ্দুছ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন জোটের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আবৃত্তিশিল্পী মোঃ আহ্্কাম উল্লাহ্। জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, আমার পরম শ্রদ্ধেয় এবং হৃদয়ের মানুষ হাসান আরিফ। কুমিল্লা থেকে বেড়ে ওঠা মানুষটির সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল এরশাদবিরোধী আন্দোলনে। মামুনুর রশীদ বলেন, হাসান ছিলেন একজন আবৃত্তিকার। এই শিল্পমাধ্যমটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনুশীলন চর্চা ও দক্ষতা। তবে আরিফকে আমরা শুধু তার আবৃত্তির জন্য স্মরণ করছি না। কারণ হাসান আরিফের একটা ব্যাখ্যা এবং দর্শন ছিল। যে মানুষের সে মানুষকেই আমরা শ্রদ্ধা করি। এম এম আকাশ বলেন, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে হাসান আরিফকে রেড স্যালুট জানাই। তাকে শ্রদ্ধা জানাই। কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করছি এই মানুষটিকে। কারণ হেফাজত যখন শাপলা চত্বরে জড়ো হয়েছিল এবং আমাদের পার্টি অফিসে আগুন দিয়েছিল তখন সাহস নিয়ে খুব মানুষই আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু এই মানুষটি তার সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে আমাদের পার্টি অফিসের সামনে অবস্থান নিয়েছিলেন। তিনি একইসঙ্গে ছিলেন যোদ্ধা এবং সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের অগ্রপথিক। মুহাম্মদ সামাদ বলেন, আরিফের চিন্তা এবং দর্শনকে আমরা অনুসরণ করেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। তার কাছে আমাদের ঋণের শেষ নেই। রাজনীতির সমান্তরালে এই মানুষটি দেশের আবৃত্তিশিল্প তথা সংস্কৃতিচর্চার অসামান্য অবদান রেখেছেন। গোলাম কুদ্দুছ বলেন, একইসঙ্গে একজন দেশপ্রেমিক এবং নিবেদিত সংস্কৃতিসেবীর নাম হাসান আরিফ। একইসঙ্গে সৃজনে ও সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন এই মানুষটি। প্রেমের কবিতা থেকে সংগ্রামের কবিতাকে অনবদ্যভাবে প্রকাশের বিশেষ দক্ষতা ছিল তার। কবিতার সঙ্গে সঙ্গীতের কোলাজে যে ধারাটি বর্তমানে গড়ে উঠেছে সেটিতেও আরিফ ছিল অনন্য। অন্যদিকে গত ৩৫ বছরের দেশের এমন কোন আন্দোলন-সংগ্রাম নেই যেখানে আরিফের ভূমিকা নেই। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন থেকে যুদ্ধাপরাধবিরোধী আন্দোলনে সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে। সকলকে উদ্বুদ্ধ করেছে। আমৃত্যু সেটি একটি গণতান্ত্রিক, শোষণমুক্ত ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্নকে লালন করেছে। সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়নের মাধ্যমেই শ্রদ্ধা ও ভালবাসা জানাতে হবে তাকে। পাশাপাশি হাসান আরিফের সৃজনকর্ম সংরক্ষণে সরকারীভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
×