ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

গভীরতা ব্যাপকভাবে হ্রাস অবৈধ স্থাপনার উচ্ছেদ নেই ভরাট হচ্ছে ক্রমশ হারাচ্ছে গতিপথ

দখল দূষণে কর্ণফুলীর আরও বিপর্যয়

প্রকাশিত: ২৩:০৭, ২২ মে ২০২২

দখল দূষণে কর্ণফুলীর আরও বিপর্যয়

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ চট্টগ্রাম বন্দর যদি দেশের অর্থনীতির কর্মকা-ের মেরুদ- হয় তাহলে এর প্রাণ প্রবাহের শিরা কর্ণফুলী নদী। একদিকে দখল, অপরদিকে দূষণে এ নদী ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে আসছে বছরের পর বছর জুড়ে। এর ফলে কয়েকটি পয়েন্টে গতিপথ পরিবর্তিত হয়েছে। গভীরতা হ্রাস পেয়েছে মারাত্মকভাবে। সার্বিকভাবে এ নদীর আরও বিপর্যয় ঘটেছে। পরিবেশবিদদের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, এ নদীর দু’পাড়ে রয়েছে দুই সহস্রাধিক অবৈধ স্থাপনা। এসব স্থাপনার মালিক প্রভাবশালী মহল। দেশের সর্বোচ্চ আদালত এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের নির্দেশ দিয়েছেন বটে, কিন্তু তা অকার্যকর রয়ে গেছে রহস্যজনক কারণে। অবস্থা এখন এমন পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যে, নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে চর জেগে এটি ভাটির দিকে এগিয়ে আসছে, অর্থাৎ চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিসমূহের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। উচ্ছেদ প্রক্রিয়ায় রিট মামলা থেকে শুরু করে নানা প্রতিবন্ধকতা হয়েছে। এসব প্রতিবন্ধকতা চূড়ান্তভাবে অবসান হয়েছে। অথচ, দূষণ রোধে যেমন কার্যকর কোন ব্যবস্থা নেই, তেমনি অবৈধ দখল উচ্ছেদে প্রশাসনের গতি নেই। বিষয়টি বিস্ময়কর হয়ে ঠেকেছে পরিবেশবিদদের কাছে। এসব নিয়ে নতুন করে আন্দোলন শুরু হচ্ছে বলে ইঙ্গিত মিলেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম বন্দর। কর্ণফুলী নদীর পাড়ে এই বন্দরের অবস্থান। চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম দিনদিন বিস্তৃত হচ্ছে। কিন্তু পক্ষান্তরে, কর্ণফুলী সংরক্ষণ ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। এর ফলে এ নদী দিনদিন সঙ্কুচিত হচ্ছে। নদীর বিভিন্ন স্থানে জেগেছে চর। বন্দর কর্তৃপক্ষ নদীর কিছু অংশে যে ড্রেজিং করেছে সেখানে তিন কিলোমিটার জুড়ে নতুন চর সৃষ্টি হয়েছে। নদীর যে স্থানে যে পরিমাণ গভীরতা থাকার কথা সেটা এখন নেই। ফলে এ নদীকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করা হচ্ছে বলেও পরিবেশবিদদের অভিযোগ রয়েছে। চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার দফতরের সর্বশেষ তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গুগল টাইম ল্যাপস ম্যাপস অনুযায়ী কর্ণফুলী নদীর ফিরিঙ্গীবাজার ফেরিঘাট থেকে শাহ আমানত ব্রিজ পর্যন্ত তিন কিলোমিটার এলাকায় মারাত্মকভাবে ভরাট ও দখল হয়ে গেছে। এ নদীর দু’পাড় সংলগ্ন অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ সম্পর্কিত সাম্প্রতিক এক তদন্ত প্রতিবেদনে জেলা প্রশাসকের দফতর থেকে ২৫টি চিত্র উপস্থাপন করা হয়েছে। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ তৌহিদুল ইসলাম এসব তথ্য বিভাগীয় কমিশনারের গঠিত তদন্ত কমিটিতে উপস্থাপন করেছেন। এতে বলা হয়েছে, কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতুর নিচে রাজাখালী খালের মোহনায় কর্ণফুলী নদীর প্রস্থ যেমন কমে গেছে, তেমনি তিন বর্গকিলোমিটারব্যাপী চর জেগে উঠেছে। বর্তমানে চাক্তাই ও রাজাখালী খালের মুখ দখল করে গড়ে উঠা ভেড়া মার্কেট, মেরিনার্স পার্ক ও মাছ বাজার কর্ণফুলীকে ভয়াবহ ধ্বংসের কবলে ঠেলে দিয়েছে। এ এলাকায় জেগে ওঠা চরে কোন রকমের স্থাপনা নেই। নদীর পলি মাটি খনন না করার কারণে এ স্থানে নদীর অংশ প্রায় ৯৩১ মিটার থেকে ছোট হয়ে ৫৮৬ মিটার হয়েছে। সোনালি যান্ত্রিক মৎস্য সমবায় সমিতি নামের একটি প্রতিষ্ঠান জেগে ওঠা চরের পাশে ভরাট করে মাছ বাজার ও বরফকল নির্মাণ করেছে, যা প্রাকৃতিক জলাশয় সংরক্ষণ আইন, পানি আইন ও জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইনে দ-নীয় অপরাধ। পরিবেশবিদের বিভিন্ন সূত্রে জানানো হয়েছে, কর্ণফুলী নদী ক্রমশ সঙ্কুচিত হতে হতে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হচ্ছে। শাহ আমানত ব্রিজ এলাকায় মাঝ নদীতে চর, উত্তর পাশে মাঝ নদীর গভীরতা ৯ ফুট। ৮৬৬ মিটার প্রস্থের কর্ণফুলী এখন ৪১০ মিটার। নদীর তলদেশে ফাটল সৃষ্টি হওয়ায় ধসে যেতে পারে শাহ আমানত ব্রিজের দক্ষিণ পাশ। নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলন কর্ণফুলী নদীর তলদেশের বাস্তব পরিস্থিতি ও দখল নিয়ে দুই মাসের একটি জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করেছে চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলন। এতে বলা হয়েছে, কর্ণফুলী নদীর স্বাভাবিক গতি প্রবাহ ফিরিঙ্গীবাজার ফেরিঘাট এলাকার উত্তর পাশে চরপাথরঘাটা ব্রিজ ঘাট সংলগ্ন তীরের উত্তর পাশে ২৫ ফুট। মাঝ নদী বরাবর ৩৮ ফুট। উত্তর পাশে ফিরিঙ্গীবাজার ব্রিজঘাট এলাকায় ২৪ ফুট। এ স্থানে নদীর স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ রয়েছে। এর ঠিক ৫শ’ মিটার উজানে চাক্তাই খালের মোহনার উত্তর পাশে কর্ণফুলীর প্রকৃত সীমানা থেকে ৩শ’ ফুট নদীর অংশে গভীরতা মাত্র দুই ফুট। মাঝ নদী বরাবর ১৩ দশমিক ৬ ফুট। দক্ষিণ পাশে তীরের কাছাকাছি গভীরতা ৪৮ ফুট। এর প্রায় ৫শ’ ফুট উজানে উত্তর পাশে রাজাখালী খালের মোহনায় মাঝ নদীতে গভীরতা মাত্র ৪ ফুট। কিন্তু শাহ আমানত সেতুর তিন নম্বর পিলার বরাবর নদীর পশ্চিমাংশে গভীরতা ৬০ দশমিক ৯ ফুট। এর জরিপে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, শাহ আমানত ব্রিজের উত্তর পাশে ১ ও ২ নম্বর পিলারের মধ্যবর্তী স্থানে গভীরতা থাকার কথা ২৫ ফুট, কিন্তু বর্তমানে সেখানে গভীরতা মিলিছে ৭ দশমিক ৭ ফুট। প্রসঙ্গত, ২০১০ সালে জনস্বার্থে এ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ হাইকোর্টে কর্ণফুলী নদী রক্ষায় এ দু’পাড়ের সকল স্থাপনা উচ্ছেদে রিট মামলা দায়ের করেন। দীর্ঘদিন শুনানির পর হাইকোর্ট উত্তর ও দক্ষিণ পাড়ের ২ হাজার ১৮৭ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের নির্দেশনা প্রদান করেন। অবৈধ স্থাপনার এ তালিকা প্রণয়ন করেছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। হাইকোর্টের নির্দেশে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন উচ্ছেদ অভিযান শুরু করেন। ৫ দিনে মাত্র আড়াইশ’র বেশি স্থাপনা উচ্ছেদের পর তা বন্ধ হয়ে যায়। উচ্ছেদের বিরুদ্ধে মাছ বাজারসহ বিভিন্ন স্থাপনার পক্ষে আরও একটি রিট মামলা দায়ের করে উচ্চ আদালত। বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার দফতরকে আদেশ দেয়া হয়। আদেশের পর দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়। চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার দফতর এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে কোন আপত্তি নেই বলে জানিয়ে দেয়। কিন্তু এরপরও এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ শুরু হয়নি। জেলা প্রশাসনের অফিস সূত্রে জানা গেছে, রাজাখালি ও চাক্তাই কালের মোহনাজুড়ে যে মাছ বাজার, বরফকল ও হিমাগার গড়ে উঠেছে তা এ নদীর জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করে ক্রমাগত ক্ষতিসাধন করে যাচ্ছে। ২০১৪ সালের ১৬ জুলাই নদীরক্ষা টাস্কফোর্স কমিটির সভায় চাক্তাই ও রাজাখালি খালের সীমানা নির্ধারণের সিদ্ধান্ত হয়। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে অবৈধ দখলদারদের তালিকা প্রণয়ন করে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন জমা দেয় জেলা প্রশাসন। সাত বছরের বেশি সময়ের আগের এ তালিকা অনুযায়ী উচ্ছেদ কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে কিছুটা রহস্যজনকভাবে, আর কিছুটা উচ্চ আদালতে রিট মামলার কারণে। দখলদারদের তালিকায় রয়েছে বড় বড় ব্যবসায়ী, কিছু রাজনৈতিক নেতা, কিছু আবাসন শিল্প মালিক।
×