ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

২৪ ঘণ্টায় পানি বেড়েছে এক থেকে দেড় ফুট নৌকা ও ভ্যানে চলাচল সাড়ে পাঁচ শ’ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্লাবিত

সিলেটে ২০ লাখ মানুষ পানিবন্দী দুর্ভোগ চরমে

প্রকাশিত: ২৩:১৬, ২০ মে ২০২২

সিলেটে ২০ লাখ মানুষ পানিবন্দী দুর্ভোগ চরমে

স্টাফ রিপোর্টার, সিলেট অফিস ॥ নগরীতে বন্যা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। বৃহস্পতিবার পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। সিলেট জেলায় ২৪ ঘণ্টায় এক থেকে দেড় ফুট পানি বেড়েছে। নগরীর সুরমা তীরবর্তী এলাকায় বানের পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। সিলেট জেলা ও নগরীতে অন্তত ২০ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। পানিবন্দী মানুষ চরম ভোগান্তি পোহাচ্ছেন। পানিবন্দী এলাকায় বিশুদ্ধ খাবার পানির সঙ্কট তীব্র হয়ে উঠছে। এ অবস্থায় জরুরী সভা ডেকে সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী করণীয় নির্ধারণ ও পরবর্তী ঘোষণার আগ পর্যন্ত বন্যা পরিস্থিতির কারণে সিসিকের সকল পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীর সব ধরনের ছুটি বাতিল করেছেন। বন্যায় আক্রান্ত এলাকার মধ্যে শাহজালাল উপশহর, ঘাসিটুলা, মাছিমপুর, ছড়ারপার, তালতলা, কুয়ারপার, মেন্দিবাগ, কামালগড়, চালিবন্দর, যতরপুর, সোবহানিঘাট, কালীঘাট, শেখঘাট, তালতলা, জামতলা, মাছুদীঘিরপার, রামের দীঘিরপার, মোগলটুলা, খুলিয়াটুলা, পাঠানটুলা, সাগরদীঘিরপার, সুবিদবাজার, শিবগঞ্জ, মেজরটিলা, মদিনা মার্কেট, দক্ষিণ সুরমার বঙ্গবীর রোড, ভার্থখলা, মোমিনখলা, পিরোজপুর, আলমপুর ও ঝালোপাড়াসহ অনেক এলাকায় বাসাবাড়িতে পানি উঠেছে। এসব এলাকায় বিভিন্ন স্থানে হাঁটু ও কোমরপানি। পানিতে ময়লা-আবর্জনা ভাসছে। ছড়াচ্ছে উৎকট দুর্গন্ধ। কোথাও কোথাও গ্যাসের লাইন থেকে গ্যাস বেরিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। পানি কবলিত এলাকায় রিক্সা ও সিএনজিচালিত অটোরিক্সা চলাচল করলেও তা সীমিত। বাসিন্দারা নৌকা ও ভ্যানে করে চলাচল করছে। জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে সিলেটের বিভিন্ন উপজেলায় থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। সীমান্তবর্তী জকিগঞ্জ, কানাইঘাট, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, কোম্পানিগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ ও বিয়ানীবাজার উপজেলায় আরও নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। কয়েকটি স্থানে বন্যার পানিতে রাস্তা তলিয়ে যাওয়ায় বৃহস্পতিবার সিলেট জকিগঞ্জ সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। ডাইকের ওপর দিয়ে গ্রামে পানি প্রবেশ করছে। এতে মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়ছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেমন ত্রাণ তৎপরতা কম, তেমনি নেই উদ্ধার তৎপরতা। বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্য সঙ্কট বিরাজ করেছে। অজানা আতঙ্কে মানুষজন নির্ঘুম রাত পার করছেন। এদিকে বুধবার রাতে সিলেটের ওপর দিয়ে প্রচ- ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেছে। সীমান্তের ওপার থেকে পাহাড়ী ঢল অব্যাহত রয়েছে। যার ফলে সুরমা, কুশিয়ারা, সারিসহ বিভিন্ন নদ নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যা কবলিত এলাকায় রাস্তাঘাট, ব্রিজ কালভার্ট, বাসাবাড়ি, দোকানপাট পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় এমনিতেই জনসাধারণের দুর্ভোগের অন্ত নেই তার মধ্যে নতুন করে যোগ হয়েছে বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট। সিলেট জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আসিফ আহমদ বলেন, ‘সিলেটের নদ-নদীর পানি অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। দুদিন আগে থেকেই সব নদ-নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। বিভিন্ন জায়গায় নদ-নদীর পাড় পানি উপচে শহর-গ্রামকে প্লাবিত করে দিয়েছে। সিলেট জেলার প্রতিটি জায়গায় পানি গত ২৪ ঘণ্টায় এক থেকে দেড় ফুট বেড়েছে। এ অবস্থায় সিলেট জেলা ও মহানগরের অন্তত ২০ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। এসব মানুষ বিশুদ্ধ পানি, খাবার, বিদ্যুত ও নানামুখী সঙ্কটে দুর্বিষহ সময় কাটাচ্ছেন। এছাড়া বানভাসি মানুষ গবাদিপশু নিয়েও মহাবিপাকে রয়েছেন। সিলেট নগরীর কিশোরী মোহন সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন রহিমা বেগম (৬৫)। একই কেন্দ্রে রয়েছেন তার ছেলে কবির হোসেন (৩৫) ও নাতি ফারহান হোসেন। বন্যা পরিস্থিতি তুলে ধরে রেজিয়া আরও বলেন, ‘একটু একটু করি পানি বাড়ছিল। মঙ্গলবার সকালে আর ঘরে থাকা যায়নি। কাঁথা-কম্বল নিয়া বাইরে আইতে ওইছে। আশ্রয় নিছি স্কুলে। ইখানে রাইত চিড়া আর গুড় দিছে। হুকনা খাওয়ার (শুকনা খাবার) গলা দিয়া নামে না। চিড়া ভিজাইয়া গুড় দিয়া মাখিয়া খাইছি।’ এদিকে নগর ছাড়াও সিলেট জেলার ১৩ উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। বিশেষ করে জকিগঞ্জ, কানাইঘাট, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, সিলেট সদর, গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার উপজেলায় সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পানি। এসব প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেমন ত্রাণ তৎপরতা কম, তেমনি নেই উদ্ধার তৎপরতা। বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্য সঙ্কট চরম আকার ধারণ করেছে। অজানা আতঙ্কে মানুষজন নির্ঘুম রাত পার করছেন। এদিকে বন্যায় সিলেট নগরসহ বিভিন্ন উপজেলার বাংলাদেশ বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড ও পল্লী বিদ্যুত সমিতির প্রায় সাড়ে ১১ লাখ গ্রাহকের মধ্যে দেড় লাখ গ্রাহক বিদ্যুত বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আছে। সিলেট বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ এবং সিলেট পল্লী বিদ্যুত সমিতি-১ ও ২-এর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। বন্যা পরিস্থিতির কারণে সিলেট বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ডের দুটি উপকেন্দ্র ও পল্লী বিদ্যুত সমিতির দুটি উপকেন্দ্রে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে চারটি উপকেন্দ্রের গ্রাহকদের বিদ্যুত সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রেও পানি ॥ বর্ষণ-পাহাড়ী ঢলে সিলেট নগরসহ জেলার অন্তত ১০টি উপজেলার বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হওয়ায় বাড়িঘর ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছে মানুষজন। সেখানেও পানিবন্দী অবস্থায় দিন কাটছে তাদের। একতলা বিশিষ্ট অনেক আশ্রয়কেন্দ্রের ভেতরেও বন্যার পানি উঠে গেছে। সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, কানাইঘাটে এমন চিত্র দেখা গেছে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, অনেক আশ্রয়কেন্দ্রের নিচতলায় পানি উঠেছে। আর একতলা আশ্রয়কেন্দ্রগুলো থেকে লোকজনকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে পানিবন্দী থাকায় জরুরী প্রয়োজনে নৌকা ব্যবহার করে অন্যত্র ঝুঁকি নিয়ে আসা-যাওয়া করতে হচ্ছে। সময় যত গড়াচ্ছে ততই বাড়ছে বানবাসী মানুষের সংখ্যা। বিভিন্ন উপজেলায় কয়েক লাখ মানুষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিভিন্ন সড়ক ডুবে গিয়ে উপজেলা ও জেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। গ্রামীণ এলাকায় জিনিসপত্রের দাম দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সাড়ে ৭০০ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ॥ সিলেটের অন্তত সাড়ে ৫০০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এছাড়া ২০০-এর মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খোলা হয়েছে আশ্রয় কেন্দ্র। ফলে জেলার অন্তত সাড়ে ৭০০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। গত ১০ মে থেকে সিলেটে ভারি বর্ষণ শুরু হয়, যা এখনও চলমান। একই সঙ্গে উজান থেকে নামছে ঢল। সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা) ইয়াসমিন নাহার রুমা বলেন, ‘পাঠদান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের ক্ষতি তো হবেই। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগে তো আমাদেরও কিছু করার নেই। পানি কমলে এই ক্ষতি পুষিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হবে।’ বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহ্বান মেয়রের ॥ উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানি আর দেশের ভেতরের অতি বৃষ্টির কারণে সিলেট নগরে সৃষ্ট বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় সরকারের পাশাপাশি বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত ॥ নিজস্ব সংবাদদাতা সুনামগঞ্জ জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় ভারি বৃষ্টিপাত না হলেও অপরিবর্তিত রয়েছে সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতি। ভারতের মেঘালয়ে মাঝারি ধরনের বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় পাহাড়ী ঢলে জেলার দোয়ারাবাজার, ছাতক, বিশ্বম্ভরপুর ও সদর উপজেলার বন্যা পরিস্থিতির বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় সুনামগঞ্জে ৫৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে এবং সুরমা নদীর পানি ষোলঘর পয়েন্টে ১৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
×