ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ইসি গঠন আইন পাস ॥ স্বাধীনতার ৫০ বছর পর

প্রকাশিত: ২৩:২২, ২৮ জানুয়ারি ২০২২

ইসি গঠন আইন পাস ॥ স্বাধীনতার ৫০ বছর পর

সংসদ রিপোর্টার ॥ স্বাধীনতার ৫০ বছর পর জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে সংবিধান নির্দেশিত ও বহুল আলোচিত ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ বিল-২০২২’। পাসের আগে ওই বিলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও নির্বাচন কমিশনার (ইসি) নিয়োগের জন্য গঠিত সার্চ কমিটিতে রাষ্ট্রপতির মনোনীত দুই বিশিষ্ট নাগরিকের মধ্যে একজন নারী রাখার বিধান যুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া সার্চ কমিটির কাজ ১০ দিনের স্থলে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে শেষ করার বিধান রাখা হয়েছে। এই দুটিসহ বিলে বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের আনা রেকর্ড সংখ্যক মোট ২২টি সংশোধনী প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে শুরু হওয়া অধিবেশনে বিলটি সংসদে পাসের প্রস্তাব করেন আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক। এরপর প্রায় তিন ঘণ্টার আলোচনা শেষে কণ্ঠভোটে বিলটি পাস হয়। এর আগে বিলের ওপর দেয়া জনমত যাচাই ও বাছাই কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করেন বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ও বিএনপির সংসদ সদস্যরা। তবে তাদের সেই প্রস্তাব কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে যায়। পরে বিলের ওপর সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেন জাতীয় পার্টি, বিএনপি, জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টির সদস্যরা। যার মধ্য থেকে ২২টি প্রস্তাব গৃহীত হয়। অধিবেশনে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন সার্চ কমিটিতে দুই জন বিশিষ্ট নাগরিকের মধ্যে একজন নারী রাখার প্রস্তাব দেন। আইনমন্ত্রী সেই প্রস্তাবে সায় দিলে, সংসদ তা ভোটে গ্রহণ করে। অর্থাৎ, ইসি গঠনের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে নাম সুপারিশের জন্য যে সার্চ কমিটি থাকবে সেখানে একজন নারী থাকবেন। সংসদে উত্থাপিত বিলে বলা হয়েছিল, রাষ্ট্রপতি ছয় সদস্যের অনুসন্ধান কমিটি গঠন করবেন, যার সভাপতি হবেন প্রধান বিচারপতি মনোনীত আপীল বিভাগের একজন বিচারক। সদস্য হিসেবে থাকবেন প্রধান বিচারপতির মনোনীত হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারক, মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, সরকারী কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান এবং রাষ্ট্রপতি মনোনীত দুই জন বিশিষ্ট নাগরিক। এখন রাষ্ট্রপতির মনোনীত ওই দুজন বিশিষ্ট নাগরিকের মধ্যে একজন নারী রাখার বিধান যুক্ত হয়েছে। বিলে সার্চ কমিটির কাজ ১০ কার্যদিবস করার বিধান রাখা হয়েছিল। সেটি এখন ১৫ কার্যদিবস করা হয়েছে। জাতীয় পার্টির মোঃ ফখরুল ইমামের এ সংক্রান্ত সংশোধনী সংসদ গ্রহণ করেছে। ফখরুল ইমামের মোট সাতটি সংশোধনী গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া জাতীয় পার্টির রওশন আরা মান্নান, মুজিবুল হক চুন্নু ও পীর ফজলুর রহমান এবং বিএনপির রুমিন ফারহানার তিনটি করে সংশোধনী প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। এছাড়া জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশিদ ও জাসদের হাসানুল হক ইনুর একটি করে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। সংশোধনী প্রস্তাব গ্রহণ শেষে আইনমন্ত্রী বলেন, এই বিলে যতগুলো সংশোধনী গ্রহণ করেছেন, এর আগে কখনও এত বেশি সংশোধনী কোন বিলে গ্রহণ করা হয়নি। সংসদে পাস হওয়া বিলটি সংসদ সচিবালয় থেকে পাঠানো হবে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে। রাষ্ট্রপতি সই করার পর গেজেট আকারে প্রকাশ হলেই প্রথমবারের মতো প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে আইন পাবে বাংলাদেশ। এর আগে গত রবিবার আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক ওই বিলটি সংসদে উত্থাপনের পর তা অধিকতর পরীক্ষার জন্য সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে বিলের দুটি ধারায় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনসহ পাসের সুপারিশ করে গত বুধবার সংসদে প্রতিবেদন জমা দেয় আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। বিরোধী দলের বক্তব্যের জবাবে আইনমন্ত্রী ॥ সংসদে পাস হওয়া ইসি গঠন আইনে কাউকে ইনডেমনিটি দেয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ইনডেমনিটির ওই পথে হাঁটে না। ইনডেমনিটি কথা শুনলেই আওয়ামী লীগের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। বিএনপি ইনডেমনিটি দিয়ে আমাদের রক্ত ক্ষরণ করিয়েছে। এই আইনে লিগ্যাল কাভারেজ দেয়া হয়েছে। এই আইনের মধ্যে কেউ অন্যায় করে থাকলে তাকে প্রকেটশন দেয়া হয়নি। জাতির পিতাকে হত্যার কথা স্বীকার ও খুনীদের পুনর্বাসিত করার কথা মেনে জনগণের কাছে মাফ চাইলে আওয়ামী লীগ বিএনপির সঙ্গে ঐকমত্যে আসবে বলে জানান তিনি। এর আগে বিলের ওপর আনীত জনমত যাচাই ও বাছাই কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ও বিএনপির সংসদ সদস্যরা বিলে ইমডেমনিটির বিধান রাখার অভিযোগ করেন। এছাড়া খসড়া আইনটি ‘তড়িঘড়ি করে’ আনা হয়েছে বলেও দাবি করেন। এ প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী বলেন, আমি বলেছি এটা তড়িঘড়ি করে করার আইন নয়, এটা সত্য। বর্তমান কমিশনের মেয়াদের মধ্যে আইন করা সম্ভব নয়, এটাও বলেছি। কারণ আমি বলেছিলাম করোনাকালে সীমিত সময়ের জন্য সংসদ বসে, এরমধ্যে এই আইন পাস করা কঠিন হবে। সংসদকে শ্রদ্ধা জানিয়েই এটা বলেছিলাম। তিনি বলেন, সুজনের একটি প্রতিনিধি দল আমার কাছে গিয়ে আইনের একটি খসড়া দিয়ে পাসের প্রস্তাব করেন। আমি আইনটি পাস করার জন্য সময় লাগবে বলে তাদের জানাই। তারা অর্ডিনেন্স করে এটা করার প্রস্তাব দেন। আমি বললাম সংসদকে পাস কাটিয়ে এই আইন করব না। সংসদে নেয়া ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ এই আইন আমরা করব না। আইনমন্ত্রী বলেন, রাষ্ট্রপতির সঙ্গে যেসব দল সংলাপ করতে গিয়েছে এবং যারা যাননি তারা সকলে নতুন আইনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন। গত ১৭ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপ করে। রাষ্ট্রপতি আইনের বিষয়ে তার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন। এরপর বিলটি আনা হয়েছে। তিনি বলেন, এ আইনের কথা অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছে। ২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যখন রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপ হয়, তখনই এই আইনের বিষয়ে কথা হয়েছিল। তখন প্রধানমন্ত্রী এই আইনটি করার জন্য বলেছিলেন। তিনি আরও বলেন, এই আইন করার প্রক্রিয়া শুরুর পর যারা বাইরে কথা বলেন, তাদের আন্দোলন সৃষ্টির চেষ্টার যে টুলস বা মসলা সেটা আর থাকেনি। সেজন্যই তারা উঠে পড়ে লেগেছেন, এটা তড়িঘড়ি করে কেন করছেন। তারা বলছেন, এটা ইসি করার আইন হয়নি। সার্চ কমিটি গঠন করার আইন হয়েছে। আইনে সার্চ কমিটি গঠনের প্রস্তাবনা প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী বলেন, ইসি গঠনে সার্চ কমিটি গঠনের বিষয়ে ২০১২ সালে রাজনৈতিক দলগুলো সম্মত হয়েছিল। তখন থেকেই এই সার্চ কমিটির ধারণা এসেছে। এটা কল্পনা থেকেও আসেনি আকাশ থেকেও পড়েনি। এটা তো নতুন আবিষ্কার নয়। সার্চ কমিটির মাধ্যমে গঠিত দুই কমিশন হয়েছে। যার কারণে এটা গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। ফলে জনমত যাচাই তো দশ বছর ধরে হয়ে গেছে। বিষয়টি হলো তালগাছটি না পেলে অনেক কমপ্লেইন থাকে। তিনি বলেন, দুইজন বিশিষ্ট নাগরিক কারা হবে, সেটা নিয়ে কথা হচ্ছে। আমরা তো আইনে কোথাও বলিনি, সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে তাদের নিয়োগ দেয়া যাবে না। বিশিষ্ট নাগরিকের ক্রাইটেরিয়া তো বলে দেয়া হয়নি। আমরা কেবল রাষ্ট্রপতিকে এই সুযোগটি দিয়েছি। বিএনপির এমপিদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘উনারা তো তালগাছ চান। উনারা কিছুই মানেন না যতক্ষণ তালগাছটা উনাদের না হয়। এই সংসদই বলেছিল তত্ত্ববধায়ক সরকার হবে তিন টার্মের জন্য। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে মামলা হলে কোর্ট দুটি বিধানকেই অবৈধ ঘোষণা করে। তারপরও উনারা এটার কথা বলবেন। উনারা আদালতের রায়ও মানেন না। উনাদের কথা হলো যেটা পাকিস্তানের কায়েদ-ই-আজম মোহাম্মদ আলী করেছেন সেটা ভাল। কিন্তু যুদ্ধ করে জাতির পিতা যেটা করে দিয়েছেন সেটা ভাল না।’ বিএনপির এমপিদের ঐকমত্যের দাবির প্রসঙ্গে আনিসুল হক বলেন, ঐকমত্য করতে হলে উনাদের সত্যকে স্বীকার করতে হবে। আর সত্যটি হচ্ছে বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সত্য হচ্ছে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট উনারা মানে বিএনপি বঙ্গবন্ধুকে খুন করেছেন। সত্য হলো- উনারা ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করতে দেননি। খুনীদের পুনর্বাসিত করেছেন। এসব সত্য মেনে বিএনপি জনগণের কাছে মাফ চাইলে আমরা ঐকমত্যে আসব। এই প্রস্তাব গ্রহণ করলে আমরা ঐকমত্যে আসব। সার্চ কমিটির মাধ্যমে গঠিত আগের দুই কমিশনকে হেফাজত প্রশ্নে আইনমন্ত্রী বলেন, ইনডেমনিটি আর লিগ্যাল কাভারেজ এক কথা নয়। ইনডেমনিটি হচ্ছে অন্যায় করার পরে তাকে প্রকেটশন দেয়ার জন্য আইন করা। লিগ্যাল কাভারেজ হচ্ছে যে কোন বৈধ কাজ যেটার লিগ্যাল কাভারেজ ছিল না সেটা তার আওতায় আনা। ইনডেমনিটি কথা শুনলেই হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। ইনডেমনিটি আওয়ামী লীগ দেয় না, এটা বিএনপি দেয়। তারা ইনডেমনিটি দিয়ে আমাদের রক্তক্ষরণ করিয়েছে। দীর্ঘ ২১ বছর আমাদের অপেক্ষা করিয়েছে জাতির পিতার হত্যার বিচার করতে। ইনডেমনিটির কথা আর আমাদের কাছে শুনাতে আইসেন না। আমরা ওই পথে হাঁটি না। এই আইনে লিগ্যাল কাভারেজ দেয়া হয়েছে। ২০১২ সালে যে কাজটা করা হয়েছে সেটা থেকে শুরু করে সেটার লিগ্যাল কাভারেজ। এই আইনের মধ্যে কেউ অন্যায় করে থাকলে তাকে প্রকেটশন দেয়া হয়নি। সেই কারণে তাদের যেসব প্রস্তাব গ্রহণ করা যায় না। তাদের বলব এই প্রস্তাব প্রত্যাহার করতে অনুরোধ করব। বিলের ওপর আলোচনায় বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্যরা ॥ বিলের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে বিএনপির সংসদীয় দলের নেতা মোঃ হারুনুর রশীদ এই আইন পাসকে সরকারের কূটকৌশল আখ্যা দিয়ে বলেন, ২০১৪ সালে বিনা ভোটের নির্বাচন হয়েছে, ২০১৮ সালে দিনের ভোট রাতে হয়েছে। এই আইনের মাধ্যমে আগামীতে দিনের বেলা নতুন কৌশলে নির্বাচন করবে কিনা, তা নিয়ে মানুষের প্রশ্ন আছে। তিনি বলেন, সংবিধানে বলা আছে নির্বাহী বিভাগের দায়িত্ব ইসিকে সহায়তা করা। কিন্তু না করলে কী হবে তা বলা নেই। এসব নিয়ে একটি পুরো আইন হওয়া উচিত। বিএনপির আরেক সদস্য রুমিন ফারহানা বলেন, সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করতে বাধ্য। স্বাধীনভাবে রাষ্ট্রপতি কোন কাজ করতে পারেন না। কিন্তু রাষ্ট্রপতিকে একটি ইল্যুশন হিসেবে সামনে আনা হয়। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার জন্য আন্দোলন করেছিল। তখন রজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থার ঘাটতি ছিল। এখন সে ঘাটতি আরও বেড়েছে। জাতীয় থেকে স্থানীয় সব নির্বাচন মাগুরার নির্বাচনের চেয়ে খারাপ হয়। সুতরাং ’৯৬ সালের চেয়ে এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার আরও বেশি দরকার। তিনি আরও বলেন, আদালত বলেছিল সংসদ চাইলে আরও দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে। সংবিধান সংশোধন কমিটিতে সব দল এই ব্যবস্থা রাখার পক্ষে মত দিয়েছিল। পরে অজানা কারণে এটি বাতিল করা হয়। এখন যে পরিস্থিতি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া কোন নির্বাচনই সম্ভব না। জাতীয় পার্টির ফখরুল ইমাম বলেন, সংবিধানের ৪৮ অনুচ্ছেদ সংশোধন না করে এই আইন করা হলে তা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে। এই আইনে প্রস্তাবিত সার্চ কমিটির সদস্য নির্বাচনের সংসদ সদস্যদের ভূমিকা রাখার বিধান যুক্ত করার দাবি করেন তিনি। জাতীয় পার্টির শামীম হায়দার পাটোয়ারি বলেন, সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদে শ্যাল শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নিয়েই কাজ করতে হবে। আইনে না থাকলেও যেটা হবে তা হলো, অনুসন্ধান কমিটি ১০ জনের নাম প্রস্তাব করবেন। সে প্যানেল যাবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে। তিনি পাঁচজন নির্বাচন করে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবেন। রাষ্ট্রপতি তাদের নিয়োগ দেবেন। তবে এটা যে অসাংবিধানিক তা নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কারণে সবচেয়ে বেশি ভুগতে হয়েছে জাতীয় পার্টিকে। এটি একটি অসাংবিধানিক ফর্মুলা বলে উল্লেখ করেন জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ। আইনটি প্রণয়ন ভাল উদ্যোগ উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেরিতে হলেও আইনটি হচ্ছে। অনেকে আইনটিকে তড়িঘড়ির কথা বলেছেন। কিন্তু এর আগে তো বলা হয়েছিল ১৫ দিনে এই আইন করা সম্ভব। তাহলে কে তড়িঘড়ির প্রশ্ন আসছে কেন? সার্চ কমিটির সদস্য সংসদ থেকে এলে বিতর্ক হতো না বলে তিনি মন্তব্য করেন। বর্তমান নির্বাচন কমিশন শতভাগ আমলানির্ভর উল্লেখ করে জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, বাংলাদেশে কী বিচারপতি ও আমলা ছাড়া বিশ্বাস করার মতো কেউ নেই? রাজনীতিবিদ বা সংসদ সদস্যদের কী বিশ্বাস করা যায় না? আওয়ামী লীগ এত বড় রাজনৈতিক দল, আপনাদের (আওয়ামী লীগ) ক্যান্টনমেন্টে জন্ম হয়নি। তাহলে আপনারাও কেন বিচারপতি ও আমলার ওপর নির্ভর করবেন? সাবেক সিইসি এটিএম শামসুল হুদার বক্তব্যের সমালোচনা করে তিনি বলেন, যে আমলা এরশাদ, বিএনপি, আওয়ামী লীগ সব সরকারের আমলে আরামে চাকরি করেছেন, পরে চাকরি শেষে আবার পঁচ বছরের জন্য সিইসি হয়েছেন। তারা ওপরেরটা খান নিচেরটাও খান। স্পীকারের মাধ্যমে মনোনয়নে দুইজন সংসদ সদস্যকে সার্চ কমিটির সদস্য হিসেবে রাখার প্রস্তাব করেন তিনি। জাপার রওশন আরা মান্নান বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর চাহিদার প্রতি সম্মান দেখিয়ে সরকার এই আইনটি করছে। কিন্তু সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ রেখে কিভাবে আইনটি হবে জানি না। আলোচনা ছাড়া তাড়াহুড়া করে আইনটি পাস করলে দেশে আবারও অস্থিরতা সৃষ্টি হবে। আশা করব স্বচ্ছতা ও দক্ষতা বজায় রেখে সরকার সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে ইসি গঠন করবে। তাহলে দেশটি শান্ত থাকবে। পীর ফজলুর রহমান বলেন, এই আইনের বিষয়ে মানুষের কৌতূহল রয়েছে। সকলে এটা নিয়ে কথা বলছেন। এই আইনটি নিয়ে সংসদের ভেতরে ও বাইরে যেসব রাজনৈতিক দল রয়েছে তাদের সঙ্গে আলোচনা করলে আরও সমৃদ্ধ হতো। এই আইনে বিগত দুটি কমিশনকে যে হেফাজত দেয়া হয়েছে এটার দরকার ছিল না। এখানে তত্ত্বাধবায়ক সরকার আনার কথা বলে বিএনপি তাদের পূর্বের বক্তব্য অনুযায়ী ‘পাগল আর কোন শিশু’কে আনতে চান সেটা বুঝতে পারছেন না বলে তিনি উল্লেখ করেন। গণফোরামের সংসদ সদস্য মোকাব্বির খান বলেন, দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা নেই। এই ইসির সুবিধাভোগী ছাড়া সকলেই বলবে তারা ব্যর্থ। সরকারের আকাক্সক্ষার বাইরে কিছু করতে পারে না কমিশন। তিনি বলেন, আমরা রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে গিয়ে যে আইন গঠনের প্রস্তাব দিয়েছি, এই আইনে তার প্রতিফলন ঘটেনি। আইনটি বঙ্গবন্ধুর আকাক্সক্ষার সঙ্গে মিল নেই। সরকারের শরিক দলের সদস্যরা যা বললেন ॥ ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, বিএনপি আইন নয় সরকারের উৎখাত চায়। তাদের সঙ্গে আলোচনা করে লাভ নেই। এর আগে আইনমন্ত্রী বলেছিলেন, আইনটি করার জন্য সময় প্রয়োজন। এই আইনটি নিয়ে অনেক প্রশ্ন উত্থাপন হয়েছে। সেগুলো নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার। তিনি নির্বাচন কমিশন গঠনে একটি সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব করেন। অনুসন্ধান কমিটি যে নামগুলো দেবে সেগুলো জাতীয় সংসদের কার্যউপদেষ্টা কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব দিয়ে তিনি বলেন, এটা হলে তা অনেক ইনক্লুসিভ হবে। এছাড়া অনুসন্ধান কমিটি যে নামগুলো প্রস্তাব করবে সেগুলো অন্তত প্রকাশ করতে হবে। এরপর জনমত বিবেচনা করে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেবেন। এমন ব্যবস্থা রাখার দাবি জানান তিনি। সংশোধনী প্রস্তাব দিয়ে জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, বিএনপি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। তারা একটি অস্বাভাবিক সরকার আনতে চায়। তাদের এমপিরা এখানে সংশোধনী প্রস্তাব দিলেও বিএনপি নেতারা ইতোমধ্যে নির্বাচন বর্জন করার ঘোষণা দিয়েছেন। নির্বাচনের আগেই ক্ষমতা নিশ্চিত করা তাদের উদ্দেশ্য। তিনি বলেন, বিএনপি বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা মানে কিনা, ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণা, যুদ্ধাপরাধ, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার এসব মানে কিনা স্পষ্ট করতে হবে। এসব না মানলে এই যুদ্ধ বন্ধ হবে না। তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারে অনেক ফাঁক ফোকর ছিল, এর মধ্য দিয়ে ইয়াজউদ্দীনকে ক্ষমতায় এনে নির্বাচন করতে চেয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ছুতোয় বিএনপি একটি অস্বাভাবিক সরকার গঠন করতে চায়। অনুসন্ধান কমিটি যে ১০ জনের নাম প্রস্তাব করবেন তাদের নাম ঠিক করার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি অনুসন্ধান কমিটিকে কোন পরামর্শ দিতে পারবেন না, এমনটি নিশ্চিত করার আহ্বান জানান তিনি। ওয়ার্কার্স পার্টির মোস্তফা লুৎফুল্লাহ বলেন, যারা দ্রুত আইন দাবি জানিয়েছিলেন আইনটি করার উদ্যোগ নেয়ার পর তারাই আবার উল্টে গেলেন। তিনি অনুসন্ধান কমিটি যেসব নাম প্রস্তাব করবে সেগুলো জাতীয় সংসদের কার্যউপদেষ্টা কমিটিতে পাঠানোর বিধান যুক্ত করার প্রস্তাব দেন। সিইসি ও ইসিদের যোগ্যতা-অযোগ্যতা ॥ আইনের বিধান অনুযায়ী সিইসি ও ইসি পদে কাউকে সুপারিশের ক্ষেত্রে তিনটি যোগ্যতা থাকতে হবে। এক্ষেত্রে তাকে বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে, ন্যূনতম ৫০ বছর বয়স হতে হবে এবং কোন গুরুত্বপূর্ণ সরকারী, বিচার বিভাগীয়, আধা সরকারী বা বেসরকারী বা স্বায়ত্তশাসিত পদে বা পেশায় পদে তার অন্যূন ২০ বছর কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এই পদের জন্য ছয়টি অযোগ্যতা বিলে উল্লেখ করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে আদালত অপ্রকৃতিস্থ ঘোষণা করলে, দেউলিয়া হওয়ার পর দায় থেকে অব্যাহতি না পেলে, কোন বিদেশী রাষ্ট্র্রের নাগরিকত্ব নিলে কিংবা বিদেশী রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা বা স্বীকার করলে, নৈতিক স্খলনজনিত ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে কারাদ-ে দ-িত হলে, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনালস) এ্যাক্ট-১৯৭৩ বা বাংলাদেশ কোলাবরেটরস (স্পেশাল ট্রাইব্যুনালস) অর্ডার-১৯৭২ এর অধীনে কোন অপরাধের জন্য দ-িত হলে এবং আইনের দ্বারা পদাধিকারীকে অযোগ্য ঘোষণা করছে না, এমন পদ ব্যতীত প্রজাতন্ত্রের কর্মে লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত থাকলে। সার্চ কমিটির কাজ কী হবে ॥ পাস হওয়া বিলে সার্চ কমিটির (অনুসন্ধান কমিটি) কাজ সম্পর্কে বলা হয়েছে, এ কমিটি স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করে দায়িত্ব পালন করবে। আইনে বেঁধে দেয়া যোগ্যতা, অযোগ্যতা অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও সুনাম বিবেচনা করে সিইসি ও ইসি পদে নিয়োগের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করবে। এ অনুসন্ধান কমিটি সিইসি ও কমিশনারদের প্রতি পদের জন্য দুই জন করে ব্যক্তির নাম সুপারিশ করবে। কমিটি গঠনের ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশ রাষ্ট্রপতির কাছে জাম দিতে হবে। সার্চ কমিটি সিইসি এবং নির্বাচন কমিশনার পদে যোগ্যদের অনুসন্ধানের জন্য রাজনৈতিক দল এবং পেশাজীবী সংগঠনের কাছ থেকে নাম আহ্বান করতে পারবে। পানি পান নিয়ে আইনমন্ত্রীর রসিকতা ॥ নির্বাচন কমিশন আইন পাসের সময় কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে ক্লান্ত হয়ে পানি পান করতে হলো আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে। এরমধ্যেও রসিকতা ছাড়েননি তিনি। সংসদে বৃহস্পতিবারের অধিবেশনে নির্বাচন কমিশন গঠনের আইন পাস হয়। বিল পাসের সময় জাতীয় পার্টি, বিএনপি, জাসদ, ওয়ার্কাস পার্টি ও গণফোরামের সংসদ সদস্যের বিভিন্ন সমালোচনার জবাব দেন আইনমন্ত্রী। বিলটির ওপর জনমত যাচাই ও বাছাই কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাবে বিরোধী সংসদ সদস্যরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সমালোচনা করেছিলেন। জবাব দিতে উঠে আধ ঘণ্টার বেশি সময় বক্তব্য দেন আনিসুল হক। এক পর্যায়ে স্বগতোক্তি করেন, ‘আমাকে পানি খেতে হবে।’ এর কিছু পরে সংসদ কক্ষের কর্মচারী পানি এনে দেন মন্ত্রীকে। স্পীকারের অনুমতি নিয়ে পানি পান করে রসিকতা করে আনিসুল হক বলেন, ‘অনেকদিন পর এমপিরা আমাকে পানি খাইয়ে দিয়েছেন।’ এসময় সংসদ কক্ষে হাসির রোল ওঠে। পরে মন্ত্রী আবার বলেন, ‘আমি আগেই বলেছি, এমপিরা আমাকে পানি খাইয়ে দিয়েছেন।’ ইসি গঠনের আইন নিয়ে সংসদের ভেতরে ও বাইরের সব সমালোচনার বিস্তারিত জবাব দেন আইনমন্ত্রী।
×