ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

বইমেলা ঘিরে অন্যরকম বিষাদ বেদনা

প্রাক উৎসবের সময় ভাঙ্গা হাট, বিবর্ণ ছবি

প্রকাশিত: ২৩:০৭, ২৬ জানুয়ারি ২০২২

প্রাক উৎসবের সময় ভাঙ্গা হাট, বিবর্ণ ছবি

মোরসালিন মিজান ॥ পাঠাভ্যাস বলতে এখন তো আর কিছু নেই। নেই বললেই চলে। মান সম্পন্ন প্রকাশনার সংখ্যাও কমতে কমতে তলানীতে এসে ঠেকেছে। পরিবর্তনের হাওয়ায় আরও কত কী ভেসে গেল! ভেসে যাচ্ছে। কিন্তু বইমেলার আবেদন, কী আশ্চর্য, এতটুকু কমেনি। যে আগ্রহের জায়গায় আয়োজনটি ছিল সেখানেই আছে। বইমেলা ঘিরে হৃদয়াবেগ বাড়ছে বৈ কমছে না। ভাই হারানোর ব্যথা আর মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষার গৌরবকে সচেতনভাবে এটি ধারণ করে আছে। বাংলা ভাষা সাহিত্যের চর্চা, বিকাশ, বাঙালী সংস্কৃতির বহমান উদার অসাম্প্রদায়িক ধারায় অনন্য সংযোজন অমর একুশে গ্রন্থমেলা। বাঙালী জাতিসত্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষের প্রতীক বাংলা একাডেমি আয়োজন করায় গ্রহণযোগ্যতাও দিন দিন বেড়েছে। বর্তমানে মেলায় অংশ নেয় দেশের প্রায় সবকটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। বইয়ের প্রদর্শনী বেচা কেনার এমন বর্ণাঢ্য আয়েজন পৃথিবীতেই বিরল। সকল বাঙালীর আবেগ ভালবাসার অনিন্দ্য সুন্দর প্রকাশ বইমেলা একইসঙ্গে প্রাণের মেলা হিসেবে পরিচিত। লেখক পাঠক প্রকাশকদের এমন মিলন, গল্প আড্ডা, আদান প্রদানের সুযোগ আর কোন প্ল্যাটফর্ম দিতে পারে না। শুধু বইকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হলেও, কালক্রমে এ মেলা বঙ্গ সংস্কৃতির বৃহৎ উৎসবে পরিণত হয়েছে। কিন্তু করোনাকাল শুরুর পর মেলাটিও আক্রান্ত। প্রাণের মেলা ঘিরে এখন কাজ করছে অন্যরকম বেদনা। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মেলাটি আর আগের মতো করে আয়োজন করা যাচ্ছে না। প্রতিবছর ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন মেলার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হতো। বছরের পর বছর ধরে এভাবেই চলে আসছে। কিন্তু গত বছর করোনা হানা দিলে যথাসময়ে মেলা আয়োজন সম্ভব হয়নি। ১ ফেব্রুয়ারির পরিবর্তে ১৮ মার্চ মেলা শুরু হয়। চলে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত। একই সময় করোনা সংক্রমণ বাড়ছিল। বইপ্রেমীদের উপস্থিতি ছিল হাতেগোনা। লেখক পাঠক প্রকাশকদের মিলনমেলা জমেনি। অনেক লেখক প্রকাশক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। প্রকাশকরা গত বছর করোনা সংক্রমণের মধ্যেই মেলা আয়োজনের জোর দাবি তুলেছিলেন। পরে দেখা গেছে তারাই বেশি আক্রান্ত হয়েছেন। মেলা চলাকালে একের পর এক প্রকাশকের আক্রান্ত হওয়ার খবর আসতে থাকে। মেলার আগে পরে আক্রান্ত হন অন্য প্রকাশের কর্ণধার মাজহারুল ইসলাম, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্সের স্বত্বাধিকারী কামরুল হাসান শায়ক, উৎস প্রকাশনের মোস্তফা সেলিমসহ অনেকে। মেলার আয়োজক বাংলা একাডেমিরও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কর্মকর্তা কর্মচারী আক্রান্ত হন। এমনকি মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব ড. জালাল আহমেদ আক্রান্ত হয়ে আইসোলেশনে চলে যান। আর পাঠকরা তো আক্রান্ত হয়েছেনই। এ অবস্থায় বিভিন্ন মহল থেকে মেলা বন্ধ করার দাবি ওঠে। সেবার মেলা বন্ধ না হলেও, বই বিক্রি হয়েছিল যৎসামান্য। বড় ক্ষতির মুখে পড়েছিলেন প্রকাশকরা। এ বছর আশা করা হচ্ছিল স্বরূপে ফিরবে মেলা। করোনা পরিস্থিতিও নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছিল। কিন্তু মেলার প্রস্তুতি শুরুর পর হঠাৎ করেই বাড়তে থাকে সংক্রমণ। এর মধ্যেই কাজ করছিল বাংলা একাডেমি। বইয়ের স্টলের জন্য অবকাঠামো নির্মাণের কাজও প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল। ঠিক তখন আয়োজনটি পেছানোর সরকারী ঘোষণা আসে। থেমে যায় সব কাজ। গত কদিন মেলা প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখা যায়, সব কিছু কেমন স্থবির হয়ে গেছে। করাতের শব্দ, পেরেক ঠুকার আওয়াজ নেই। বাংলা একাডেমি চত্বর ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিবর্ণ ছবি। স্টলের কাঠামো দেখে মনে হচ্ছে কঙ্কাল। পরিত্যক্ত মনে হচ্ছে সব কিছু। মনে হচ্ছে মালিকানাহীন। সরকারী নির্দেশে অর্ধেক জনবল নিয়ে কাজ করছে বাংলা একাডেমি। ফলে অফিস ভবনে গিয়েও তেমন কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। যখন সবচেয়ে জমজমাট থাকার কথা তখন শূনতা ঘিরে ধরেছে পুরো প্রাঙ্গণটিকে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানটাও খা খা করছে। এখানে ওখানে বাঁশের স্তূপ। এলোমেলোভাবে নানা সরঞ্জাম ফেলে রাখা হেেছ। জনমানুষ কেউ নেই। যেন পরিত্যক্ত। মালিকানাহীন। দেখে যে কারও মনে হবে ভাঙ্গা হাট। প্রাণের মেলার এমন ছবি বইপ্রেমীদের মনকে বিষণœ করে তুলছে। মেলা প্রাথমিকভাবে দুই সপ্তাহ পেছানোর কথা বলা হলেও, কবে নাগাদ আসলে শুরু করা যাবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে লেখক প্রকাশক ও পাঠকের মনোজগতেও। বিবর্ণ বইমেলা নিয়ে কথা হচ্ছিল কবি তারিক সুজাতের সঙ্গে। তিনি বলছিলেন, কবি লেখকদের কাছে বইমেলা আলাদা তাৎপর্যের। এ সময়টাকে বিশেষভাবে অনুভব করি আমরা। লেখালেখি নিয়ে মেলায় বসে গল্প আড্ডা হয়। কিন্তু সব এভাবে থমকে যাবে, কখনও ভাবিনি। গত বছর তো মেলায় ঢুকেছি বলে মনে পড়ে না। ভেবেছিলাম এবার আবার জমে উঠবে। জমিয়ে তুলব। তা আর হচ্ছে কই? জানা যাচ্ছে, এবার প্রকাশকদেরও আগ্রহ অনেক কমে গেছে। তাদের বড় একটি অংশ করতে চাইছেন না। হতাশার কথা জানিয়ে আগামী প্রকাশনীর কর্ণধার ওসমান গনি বলছিলেন, গত বছর আমরা করোনার মধ্যেই মেলা করেছিলাম। কিন্তু মেলা করার সেই আনন্দটা পাইনি। নিজের প্যাভিলিয়নে আমি নিজে উপস্থিত ছিলাম না। চেনা আড্ডাটা হয়নি। ব্যবসায়িকভাবেও অনেক ক্ষতিগ্রস্তও হয়েছি। এবারও মেলা ঘিরে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এভাবে মেলা করা কঠিন বলে জানান তিনি। এদিকে, বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে জানা যায়, মেলার সদস্য সচিব জালাল আহমেদ এবারও করোনায় আক্রান্ত! এরই মাঝে আইসোলেশনে চলে গিয়েছেন তিনি। ফোনে এই কর্মকর্তা বলছিলেন, মেলাটা তো আমরা ভালবেসেই করি আসলে। তাই সব ভুলে শ্রম দেই। এবারও দিয়েছি। কিন্তু হঠাৎ আক্রান্ত হয়ে গেলাম। একাডেমির আরও কয়েকজন আক্রান্ত বলে জানান তিনি। দুঃখ করেই বলেন, প্রাণের মেলাটি এমন উদ্বেগের হয়ে যাচ্ছে, ভেবে কষ্ট পাচ্ছি। সব মিলিয়ে মেলা ঘিরে অন্যরকম এক বিষাদ বেদনা। এই বিষাদ বেদনার শেষ কোথায়? কবে? হায়! এ উত্তরও জানা নেই কারও।
×