এ যুগের ফুটবল দর্শকরা বিশ^কাপে এক সময় পেলে, ম্যারাডোনা ও বর্তমানে মেসি এবং রোনাল্ডোর খেলা দেখছেন। কিন্তু দেখেননি জাদুকর সামাদের খেলা । তবে এই ফুটবল মহাতারকার খেলায় ক্যারিশমা, স্বপ্নের মতো অলৌকিক সব ঘটনা ও জাদুর প্রদর্শনীর কথা শোনেননি বা মুগ্ধ হননি এমন মানুষ কমই পাওয়া যাবে। অর্ধশত বছর আগে সামাদ যখন খেলেছেন, তখন টেলিভিশন ছিল না, ছিল না সংবাদপত্রের এত ছড়াছড়ি। ফলে সামাদ সম্পর্কে লিখিত তেমন কিছুই পাওয়া যায় না । ফলে তার সম্পর্কে যে সব চমকপ্রদ কাহিনী শোনা যায় তার মধ্যে অনেক বিভ্রান্তি ও তথ্য বিভ্রাটে ভরপুর।
জাদুকর সামাদের দিনাজপুরের পার্বতীপুর বাসভবনে থাকা নথীপত্র ও উপহার সামগ্রী মুক্তিযুদ্ধের সময় লুটপাট হয়ে গেছে। তার ২৯তম মৃত্যু দিবসে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ ২ টাকা মূল্যমানের স্মারক ডাক টিকেট ও খাম প্রকাশ করেছে। তৎকালীন তিনি ভারতে অবস্থানকালে রেলে চাকরি করতেন। সে কারণে তিনি ই বি আরের সামাদ নামেও পরিচিত ছিলেন। সাতচল্লিশে দেশ ভাগের পরে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। সে সময়ের সরকার তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে পশ্চিমাঞ্চলীয় রেলের অন্যতম ৪ লাইনের জংশন স্টেশনে প্ল্যাটফর্ম ইন্সপেক্টর পদ সৃষ্টি করে সেই পদে তাকে নিয়োগ দেয়। এখানকার রেলওয়ে সাহেপাড়ার টি ১৪৭ বাংলো টাইপের একটি বাসায় তিনি থাকতেন। এই বাসায় হতাশা ও নিঃসঙ্গতায় দিন কেটেছে তার। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৪ সাল মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তাকে সচক্ষে দেখেছি। আমি ১৯৬১ সালে তখন পার্বতীপুর শহরের জ্ঞানাঙ্কুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। স্কুল থেকে বাড়ী যাতায়াতের রাস্তা রেলওয়ে প্ল্যাটফর্মের ওপর দিয়েই । অস্বাভাবিক বড় গোঁফধারী হাল্কা পাতলা ৬ ফুটি মানুষ, পরনে ঢিলে ঢালা প্যান্ট শার্ট, কখনও হাফ প্যান্ট হাতে কালো রঙের স্টিক (লাঠি)। এই আকৃতির একটি মানুষকে প্রতিনিয়ত প্ল্যাটফর্মের ওপর দিয়ে পায়চারী করতে দেখতাম। স্থানীয় লোকজন বলত তিনি ফুটবলের জাদুকর সামাদ। আমি যখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র সে সময় সামাদ সাহেবের মৃত্যু হয়। স্কুলে এসে তার মৃত্যু সংবাদ শুনতে পাই। দিনটি ছিল ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৪ সাল। অথচ দেশবাসী তার মৃত্যুর খবর জানতে পারে ৩ দিন পর। অর্থাৎ ৫ ফেব্রুয়ারি। খবরটা ঢাকার একটি ইংরেজী দৈনিকে ছাপা হয়েছিল ছোট্র করে। মৃত্যুর বহু বছর পরে ১৯৮৯ সালে কালীবাড়ী (ইসলামপুর) কবরস্থানে তার কবরের ওপর স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়। সামাদ প্রথমে কলকাতায় খেলতেন। নেমেছিলেন ১৯১৩ সালে এ্যারিয়েন্স ক্লাবের হয়ে। এরপর তিনি কিছুদিন কলকাতার মোহামেডান ও মোহনবাগানের হয়েও খেলেন। ১৯৩৪ সালে মোহামেডানের জার্সিতে খেলে প্রথম লীগ শিরোপা জয় করেন। এরপর মেহামেডান পরপর পাঁচবার লীগ চ্যাম্পিয়ন হয়। মোহামেডান থেকে পরবর্তীতে সামাদ চলে যান ইস্ট বেঙ্গল রেলওয়ে দলে। এরপর তিনি জাতীয় দলের হয়ে তৎকালীন বার্মা (মিয়ানমার) সিলন (শ্রীলঙ্কা), হংকং, চীন, জাভা, সুমাত্রা, মালয় (মালয়েশিয়া), সিঙ্গাপুর ও ব্রিটেনে খেলতে যান। ঊনবিংশ শতকের গোড়ার দিকে কলকাতার মাঠে যেসব দর্শক সামাদের খেলা দেখেছেন তাদের অধিকাংশই বেঁচে নেই। তার মধ্যে তার সঙ্গে খেলেছেন এমন কিছু খেলোয়াড়ের স্মৃতির কথায় জানা যায় সামাদ কি ধরনের খেলোয়াড় ছিলেন, মাঠে পায়ে-বলে কেমন অলৌকিক ঘটনা ঘটাতেন। সামাদ একাই ছিলেন একটা দল। মনে হতো বাইশ জনের মধ্যে তিনিই মূল খেলোযাড়। বরিশালের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ আইনজীবী সামাদভক্ত বিডি হাবীবুল্লাহ লিখেছেন, আমি সামাদের খেলা দেখেছি। প্রথম হাফে তিনি খেলতেন না। পেলে বা ম্যারাডোনা তার খেলা দেখলে বিস্ময়ে হতবাক হতেন। বিশিষ্ট ক্রীড়া লেখক সৈয়দ শহীদ বিশে^র শ্রেষ্ঠ দশ খেলোয়াড় পুস্তকে লিখেছেন, সেরা ফর্মের সামাদ বল নিয়ে মাঠের মধ্যে যা খুশি তাই করতে পারতেন। রক্ষণভাগের কোন খেলোয়াড়ের পক্ষে তাকে গোল করা থেকে বিরত রাখা সম্ভব ছিল না। যখন তার ইচ্ছে হতো, কেবল তখন তিনি খেলতেন। একবার সর্বভারতীয় দল (আইএফএ) বার্মার রাজধানী রেঙ্গুনে গিয়েছিল কয়েকটি প্রদর্শনী ম্যাচ খেলতে। ভারতীয় একাদশ মুখোমুখি হয়েছিল ইংরেজ ফুটবলারদের নিয়ে গড়া রেঙ্গুন কাস্টম দলের বিরুদ্ধে। প্রথম হাফে ভারতীয় দল পিছিয়ে পড়ে ০-২ গোলে। তখনও সামাদের ভূমিকা একজন সাধারণ দর্শকের মতো। মাঠে সাইড লাইনের কাছে দাঁড়িয়ে। দ্বিতীয় হাফে খেলা শুরুর আগে দলের ম্যানেজার পঙ্কজ গুপ্ত সামাদের হাত চেপে ধরে বললেন, যে করেই হোক ম্যাচ জিততে হবে। অনেক কষ্টে সামাদকে রাজি করিয়ে নামানো হলো। সামাদ হাফ সীমানার সতীর্থ খেলোয়াড়ের কাছ থেকে বল নিয়ে প্রতিপক্ষের তিনজনকে কাটিয়ে প্রথম গোল করেন। এভাবে পরপর আরও দুটি গোল করে জিতিয়ে দেন ভারতীয় দলকে। মাঠে খেলা চলছে পুরোদমে। সামাদ সাইড লাইন বরাবর দাঁড়িয়ে বিশাল গোঁফ জোড়ায় তা দিচ্ছেন আর বাদাম চিবুচ্ছেন। এ অবস্থায়ও তাকে কেউ কিছু বলার সাহস পেতেন না। তাই সামাদের মেজাজ ফিরিয়ে আনতে দর্শকরা আকুল আহ্বান জানিয়ে বলত, এ সামাদ ভাইয়া থোড়া খেল দেখাইয়ে। অনুরোধ রক্ষা করলে খেল দেখানো শুরু হতো। যে খেলার মহিমা বর্ণনা করে বোঝানো কঠিন। বল নিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে ছুটে চলেছেন সামাদ।
একে একে চার পাঁচজনকে কাটিয়ে প্রতিপক্ষের গোলরক্ষকের কাছে এসে সতীর্থ খেলোয়াড়কে বল দিয়ে হেঁকে উঠতেন, নে গোলে মার। একবার ইউরোপীয় দলের বিরুদ্ধে ভারতের খেলা চলছিল। ভারত তখন ১ গোলে পরাজয়ের পথে। খেলা শেষ হতে তখন মাত্র ৩ মিনিট বাকি। এ মুহূর্তে পঙ্কজ গুপ্তের অনুরোধে সেন্টারলাইন থেকে প্রায় একা ড্রিবল করতে করতে দুবার বল নিয়ে গেলেন প্রতিপক্ষের পোস্টে। আর দুটোই গোল। সামাদের পুরো নাম সৈয়দ আবাদুস সামাদ। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান শহরের ভুরী গ্রামে জন্ম ১৮৯৫ সালের ৬ ডিসেম্বরে। একবার ভারতের হয়ে ইন্দোনেশিয়ার জাভায় সামাদ খেলেছেন। সেখানে গিয়ে তিনি যে ঘটনা ঘটিয়েছেন তাতে দুনিয়ার ফুটবলপ্রেমী মানুষ চমকে উঠেছিল। জাদুর মতো ঘটনা। ইন্দোনেশিয়া একাদশ আর ভারতীয় একাদশের মধ্যে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে ম্যাচে। দুই দলেরই রয়েছে তুখোড় সব খেলোয়াড়। চেষ্টা করেও কোন পক্ষই গোল করতে পারছে না। ঠিক সেই সময় ভারতীয় দলের তরুণ ফুটবলার সামাদ প্রতিপক্ষের কয়েক খেলোয়াড়কে অসাধারণ দক্ষতায় কাটিয়ে তীব্র শট করলেন গোল পোস্টে। তবে বল বারে লেগে ফিরে এলো মাঠে। বিস্মিত হলেন তিনি। গোল হলো না কেন? কিছুক্ষণ পর আবারও সামাদের তীব্র শটের বল গোল পোস্টের ক্রসবারে লেগে ফিরে এলো। এবার সামাদ রেফারিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন। বললেন, গোল পোস্টের উচ্চতা আন্তর্জাতিক মাপের চেয়ে কম আছে। তা না হলে আমার দুটো শটেই গোল হতো। ফিতে দিয়ে মেপে দেখা গেল সত্যিই গোল পোস্টের উচ্চতা আন্তর্জাতিক মাপের চেয়ে ৪ ইঞ্চি কম। ভারতীয় দলের অধিনায়ক হিসেবে জীবনের শেষ খেলা খেলেছিলেন ইংল্যান্ডের সার্ভিসেস একাদশের বিরুদ্ধে। এই ম্যাচে সামাদের অসাধারণ ফুটবল নৈপুণ্য দেখে ইংল্যান্ডের তৎকালীন সেরা লেফট আউট কম্পটন চমকে উঠেছিলেন। ভারতের ফুটবল নক্ষত্র সন্তোষ নন্দী, সামাদের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছেন, তার সঙ্গে ফুটবল খেলেছি। তাকে আমি ফুটবলের দেবতা বলে মানি।
আমার শ^শুরমশাই দ্রোণাচার্য বাঘা সোম ফুটবলের একাল-সেকাল নিয়ে আলোচনায় বলেছেন, পেলের চেয়েও সামাদ অনেক বড় মাপের ফুটবলার ছিলেন। সামাদ সাহেবের পায়ের সেই জাদু আর কোন ফুটবলারের পায়ে দেখিনি। কলকতার মাঠে তার আত্মপ্রকাশ ১৯১৩ সালে। সেটা আমার দেখার সৌভাগ্য হয়নি। তবে জেনেছি এ্যারিয়ান ক্লাবের সেক্রেটারি প্রফুল্ল মুখার্জীর কাছ থেকে। তিনিই শিয়ালদহ স্টেশনে গিয়েছিলেন সামাদকে আনতে। যার বর্ণনা দিতে গিয়ে প্রফুল্ল বাবু বলেছেন, দেখলাম ছয় ফুটের মতো লম্বা মানুষটা ট্রেন থেকে নামছেন। গলায় রুপোর মাদুলি। দেখার মতো গোঁফ। পরনে লুঙ্গি। হাতে টিনের একটা বাক্স। কথা বলতেন একটু জোরে, অনেকটা ধমকের সুরে। পরিচয় পর্ব শেষ হওয়ার পর আমি সামাদকে শিয়ালদার টাওয়ার হোটেলে তুললাম। পরের দিন সামাদকে অভ্যর্থনা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় এ্যারিয়ান্স ক্লাবের তাঁবুতে। মাঠে সামাদ সব সময়ই হাসি-খুশি থাকতেন। লম্বা দুটি পা ছিল, সে কারণে স্ট্যাপিংটাও বড় ছিল। সারাক্ষণই দৌড়ঝাঁপের মধ্যে থাকতেন না। বরং দাঁড়িয়ে থেকে গোঁফে তা দিতেন। আর মাঝে মধ্যে বল চেয়ে নিয়ে তার অলৌকিক সেই কা-গুলো করে দেখাতেন দর্শকদের। আর ছিনিয়ে আনতেন দলের অসাধারণ সব জয়। যা গৌরবময় ইতিহাস হয়ে থাকবে চিরদিন।