ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কবিতার আহ্বান, ফিরে আসুন হাসান আরিফ

জীবন কি জাগে নাই মরণের আবরণ ভেঙে...

প্রকাশিত: ২৩:১৬, ৯ ডিসেম্বর ২০২১

জীবন কি জাগে নাই মরণের আবরণ ভেঙে...

মোরসালিন মিজান ॥ আপনি চলে যাবেন? আপনিও? না, মানব না। কেউই মানার জন্য প্রস্তুত নয়, হাসান আরিফ। খ্যাতিমান আবৃত্তি শিল্পী সংস্কৃতিকর্মীদের ভীষণ ভীষণ প্রিয় আরিফ ভাই, ফিরতে হবে আপনাকে। ফিরতেই হবে। অন্তত আপনার চলে যাওয়ার সময় হয়নি। অনেক দিন ধরে শরীরে গোলমাল। হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। আগেও তো ভর্তি হয়েছেন। কিন্তু এবার আইসিইউতে কেন? আপনার মতো প্রাণবান মানুষকে কেন আলাদা করে লাইফসাপোর্ট নিতে হবে? একটু বরং বিশ্রাম নিন সেখানে। তার পর চলে আসুন। যে জায়গা আপনার সেই প্রিয় টিএসটি, শহীদ মিনার, শিল্পকলা একাডেমি অপেক্ষা করে আছে। আপনিই তো বলেছিলেন, আমরা আমাদের সাধ্য অনুযায়ী চেষ্টা করে যাব এবং আগামী প্রজন্মকেও এই বার্তাটা আমরা দিয়ে যাব যে, তুমি শহীদ মিনারে দাঁড়িয়েই তোমার যে কোন উৎসব, যে কোন জাতীয় দিবস, যে কোন সংগ্রাম যে কোন শপথ, সেটি গ্রহণ করবার চেষ্টা করো। কারণ শহীদ মিনার, এটি শুধু একটি স্থাপত্য নয়। এখানে এমন এক তীর্থভূমি যে ভূমিতে দাঁড়িয়ে আমি আমার আত্মপরিচয়টাকে নতুন করে দেখেছিলাম। এবং যে ভূমি আমাকে স্বাধীনতার দিকে নিয়ে গেছে এবং যেখান থেকে আজও আমি দেশের প্রতি, মানুষের প্রতি অন্যায় হলে প্রতিবাদ করি। আমার সকল সম্ভাবনায় যে উচ্ছ্বাস তার প্রথম নিশ^াসটুকু আমি মিনারে দাঁড়িয়ে ছাড়তে চাই বা গ্রহণ করতে চাই। আপনার এ কথামতো আপনার জন্য অপেক্ষা করে আছে শহীদ মিনারের আগামী সমবেশ। আপনি আসুন। নিশ্বাস নিন প্রাণভরে। মনে পড়ছে, শহীদ মিনারের সমাবেশে দাঁড়িয়ে স্বাগত বক্তব্য রাখার সময় বিখ্যাত সব কবিতার পঙ্ক্তি আপনার কণ্ঠে খেলা করত। স্বাগত বক্তব্যকেও কবিতায় রূপান্তরিত করতেন আপনি। বিশ^াসযোগ্য করে তুলতেন আপনার উচ্চারিত প্রতিটি শব্দকে। যে কণ্ঠে এত আবেগ, এত প্রেম, এত বিদ্রোহ, সে কণ্ঠেই লোকজ সুরের মোহমায়া। আপনার কণ্ঠটাকেই মনে হতো হৃদয়। সেই হৃদয় কজনের আছে, বলুন? আপনার কণ্ঠে নতুন প্রাণ পাওয়া অজ¯্র কবিতা এখন কাঁদছে। আরও কত কবিতা লিখে চলেছেন সমকালীন কবিরা। কে সেগুলো থেকে সর্বোত্তমটি চুপিসারে পকেটে পুরে নিয়ে যাবে? কে পড়বে এত দরদ দিয়ে? আপনার মতো করে পড়বে কে, বলুন? তাই আপনাকে চাই। চাই বলতে গিয়ে, বিশ^াস করুন, চোখ ভেসে যায় চোখের জলে। ভেজা চোখে আপনাকে বলছি, আসুন। ফিরে আসুন। আপনাকে ফিরতেই হবে। তা না হলে এত কেন ভালবাসায় জড়িয়েছিলেন? কবিতার কচিকণ্ঠ, নাটকের, গানের প্রতিশ্রুতিশীল শিল্পী আপনার কাছ থেকেই তো শিখেছে। গ্রহণ করেছে। আরও কত চাওয়ার আছে তাদের। পাওয়ার আছে আপনার কাছ থেকে। আপনি কী করে তাদের নিরাশ করবেন? মাত্র কদিন পর ১৬ ডিসেম্বর। প্রতিবারের মতোই বিজয় উৎসবের আয়োজন করবে সাংস্কৃতিক জোট। এই তো সেদিন টিএসসিতে প্রথম প্রস্তুতি সভাটা হলো। আপনি সাধারণ সম্পাদক হিসেবে জোটের সভায় ঠিক এসে উপস্থিত হলেন। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপনকালে কেমন হবে বিজয় উৎসব, কুদ্দুছ ভাইয়ের (জোট সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ) সঙ্গে কথা বলে তার রূপরেখা দাঁড় করালেন। আজ যখন বিজয় দিবসের মাহেন্দ্রক্ষণ ঘনিয়ে এসেছে তখন আপনি হাসপাতালে শুয়ে। এ কেমন কথা? আপনাকে ছাড়া বিজয়কে কোন রঙে সাজাব আমরা? এই তো সেদিন শিল্পকলা একাডেমিতে নূর ভাইয়ের (আসাদুজ্জামান নূর) ৭৫তম জন্মদিন উদ্যাপন করা হলো। তার জন্য নুরুলদীনের সারাজীবন নতুন করে তৈরি করলেন আপনি। উৎসব শুরুর আগে রিহার্সেল। আপনি ব্যাকস্টেজে বসে দেখছিলেন। সে কী আনন্দ আপনার চোখে মুখে। মঞ্চের কোথায় নূর ভাই দাঁড়াবেন, আপনি আহ্কাম ভাই (আহ্কাম উল্লাহ) মিলে ঠিক করলেন। হঠাৎ আলো এসে পড়ল আপনার মুখে। মনে হলো, আপনিই নুরলদীন। উৎসব শেষে শিল্পকলার ভিআইপি কক্ষে মেরাথন আড্ডা হলো সেদিন। রামন্দেু দা (রামেন্দু মজুমদার), ফেরদৌসী আপা (ফেরদৌসী মজুমদার), আতাউর রহমান, নূর ভাই, বাচ্চু ভাই (নাসির উদ্দীন ইউসুফ) সবাই সেখানে উপস্থিত। তবুও আপনাকে ঘিরে আলাদা এক আড্ডা জমে উঠেছিল। এমন আবৃত্তি শিল্পী কম পাওয়া যাবে যে বা যারা আপনার পাশে দাঁড়িয়ে, গায়ে জড়িয়ে ধরে ছবি তুলেননি। সেদিনও হাসতে হাসতে আপনি বলেছিলেন, ছবি তুলে রাখ। কখন চলে যাই। তাই বলে সত্যি সত্যি চলে যাওয়ার ফন্দি? তা হবে না? আরিফ ভাই, সাংস্কৃতিক আন্দোলন সংগ্রামে থাকা পূর্বসূরিদের কত শত গল্প, গল্প তো নয়, ইতিহাস। আপনি সেসব ইতিহাসের তরুণতম সাক্ষী। আপনিই তো শুনিয়েছেন আজকের প্রজন্মের সংস্কৃতি কর্মীদের। অথচ আজ হঠাৎ কী হলো যে, আপনার মুখে কথা নেই? মানতে পারছি না, আরিফ ভাই। আমাদের দিনগুলো কালো মেঘে ঢেকে যাচ্ছে। বাইরে অবেলার বৃষ্টি। কাঁদছে আকাশ। আমাদেরও চোখ একইরকম জলে ভেজা। জেনে রাখুন, আপনারই জন্য। সেই করোনাকাল শুরু হওয়ার পর থেকে বেদনার সঙ্গে বসবাস। কত শিল্পী সাহিত্যিক বিদগ্ধজন ছেড়ে গেছেন আমাদের। কিন্তু আপনি পুরনো ও নতুনের মধ্যে সেতুবন্ধন। পুরনো নতুন সবাই আপনাকে চায়। ফিরতেই হবে আপনাকে। ফেসবুকে ইউটিউবে ছড়িয়ে থাকা আপনার আবৃত্তি শুনছি এখনও। কোন কোন কবিতা বুকে কাঁপন ধরিয়ে দেয়। সৈয়দ হকের তেমন এক কবিতার আশ্রয়ে আপনি বলছেন, ‘নিজেই তাজ্জব তুমি একদিকে যাইবার চাও/অথচ আরেক দিকে খুব জোরে দেয় কেউ টান।/সে তোমার পাওনার এতটুকু পরোয়া করে না,/খেলা যে দেখায় তার দ্যাখানের ইচ্ছায় দেখায়,/ডাহুক উড়াইয়া দিয়া তারপর আবার ধরে না...।’ ধরতে হবে। সবার কথা ভেবে হলেও ডাহুকটাকে ধরুন। ধরতেই হবে, আরিফ ভাই। ‘জীবন কি জাগে নাই মরণের আবরণ ভেঙে...।’ ভেঙে আসুন। ‘তোমাকে আমার অব্যক্ত কথাগুলো আর বলা হলো না।’ বলতে হবে। আপনিই উচ্চারণ করেছিলেন, ‘অপেক্ষায় থেকো অনাবিল রোদ/জোৎ¯œার ধবধবে পবিত্র প্লাবন।’ অপেক্ষায় আছে। আপনি ফিরে আসুন, হাসান আরিফ। প্রিয় আরিফ ভাই।
×