ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

যাত্রাবাড়ী থেকে ১২ কোটি টাকার আইস জব্দ ॥ দু’জন গ্রেফতার

নিরাপদে দেশে ঢুকছে ভয়ঙ্কর আইস

প্রকাশিত: ২৩:০৯, ১৭ অক্টোবর ২০২১

নিরাপদে দেশে ঢুকছে ভয়ঙ্কর আইস

আজাদ সুলায়মান ॥ ভয়ঙ্কর আইস আসছে খুব সহজেই। এজন্য খুব বেশি একটা বেগ পেতে হয় না। বিজিবি, কোস্টগার্ড, পুলিশ আনসারসহ অন্যান্য বাহিনীর টহলকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নির্বিঘেœ আসছে ছোট বড় সব ধরনের চালান। মিয়ানমার থেকে টেকনাফ ও সেন্টমার্টিনের মধ্যবর্তী নৌপথ দিয়ে দেশে আসছে ভয়ঙ্কর মাদক আইস। কখনও আচার, কাপড়ের প্যাকেট আবার কখনও চায়ের ফ্লেভারের প্যাকেটে। টেকনাফে আইসের চালান কয়েক স্থানে মজুদ রাখা হয়। এরপর সুযোগ বুঝে বিভিন্ন যানবাহনে করে ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে নেয়া হয়। দেশের সবকটা বাহিনীর নজরদারি ও টহল থাকার পরও আসছে এই মাদক। কিভাবে সম্ভব সে উত্তর দিতে পারছে না কোন বাহিনী। আইসের কোন চালান যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হাতে জব্দও হলে কোন ধরনের পেমেন্ট নেয় না মিয়ানমারের মাদক কারবারিরা। এখনকার সবচেয়ে বড় আলোচিত মাদক হলো আইস বা ক্রিস্টাল মেথ। ক্রিস্টাল মেথ বা আইসে ইয়াবার মূল উপাদান এমফিটামিনের পরিমাণ অনেক বেশি থাকে। তাই মানবদেহে ইয়াবার চেয়েও অনেক বেশি ক্ষতি করে এই আইস। এটি সেবনের ফলে অনিদ্রা, অতি উত্তেজনা, স্মৃতিভ্রম, মস্তিষ্ক বিকৃতি, স্ট্রোক, হৃদরোগ, কিডনি ও লিভার জটিলতা এবং মানসিক অবসাদ ও বিষণœœতা তৈরি হয়। ফলে আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। শারীরিক ও মানসিক উভয় ক্ষেত্রে এর নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। এই মাদক প্রচলনের ফলে তরুণ-তরুণীদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং অস্বাভাবিক আচরণ করতে দেখা যায়। মাদকাসক্তরা নানা অপরাধে জড়িত হয়ে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে অভিভাবকরাও আসক্ত হয়ে পড়ছে। মাদক কারবারি ও মাদকসেবীদের দেয়া তথ্য মতে- আইস তেমন ব্যয়বহুল মাদক নয়। কিন্তু এটা বেশ লাভজনক। কারণ মিয়ানমারে এক গ্রাম আইসের দাম দেড় থেকে দুই হাজার টাকা। আর বাংলাদেশে এর দাম ১৫ থেকে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। প্রতি গ্রামে ১৩ থেকে ২৩ হাজার টাকা বেশি লাভ পেতে মিয়ানমার থেকে তাই দেশে আইস নিয়ে আসেন কক্সবাজারের টেকনাফের বাসিন্দা হোছেন ওরফে খোকন। এ আইস বিক্রি হয় ঢাকা ও চট্টগ্রামে। এটা এত লাভের কারবার যে, মাত্র দুটো চালানেই কোটিপতি। র‌্যাবের মতে- আগে আইস থাইল্যান্ড বা অন্যান্য দেশ থেকে মিয়ানমার হয়ে দেশে আসত। এখন মিয়ানমারে আইস তৈরি করা হয়। হোছেনের সঙ্গে মিয়ানমারের মাদক কারবারিদের সুসম্পর্ক রয়েছে। তিনি বার্মিজ আচার ও কাপড় আনার নাম করে অবৈধভাবে নিয়মিত মিয়ানমারে যাতায়াত করতেন। বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে কোন আইসের চালান ধরা পড়লে সেই অর্থ আর তাকে পরিশোধ করতে হয় না। তাই এ চক্র ঝুঁকিমুক্তভাবে আইসের চালান নিয়ে আসছিল বাংলাদেশে। শনিবার যাত্রাবাড়ী থেকে আটককৃত চালান সবচেয়ে বড়। ৫ কেজির এ চালান এবং বিদেশী অস্ত্র ও গুলিসহ টেকনাফ কেন্দ্রিক আইস সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতা মোঃ হোছেন ওরফে খোকন ও সহযোগী মোহাম্মদ রফিককে গ্রেফতারের পর এসব তথ্য জানিয়েছে র‌্যাব। তাদের কাছ থেকে অবিশ্বাস্য সব তথ্য পেয়েছে র‌্যাব। তার দেয়া তথ্য যদি সত্যি হয়- তাহলে সামনে অপেক্ষা করছে এক ভয়াবহ পরিণাম। র‌্যাব সদর দফতরের গোয়েন্দা শাখা ও র‌্যাব-১৫ এর যৌথ অভিযানে শনিবার ভোরে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। অভিযানের সময় জব্দ হওয়া আইসের বাজার মূল্য প্রায় সাড়ে ১২ কোটি টাকা। দেশে এখন পর্যন্ত এটাই সর্বোচ্চ পরিমাণের আইসের চালান। এছাড়াও তাদের কাছ থেকে দুটি মোবাইল, তিনটি মিয়ানমারের সিমকার্ড এবং মাদক কারবারিতে ব্যবহৃত ২০ হাজার টাকা জব্দ করা হয়। এ বিষয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, ২০১৮ সালের ৩ মে র‌্যাবের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে প্রধানমন্ত্রী মাদকের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দেন। শুরু হয় র‌্যাবের ‘চলো যাই যুদ্ধে, মাদকের বিরুদ্ধে’ অভিযাত্রা। সাম্প্রতিক সময়ে টেকনাফ কেন্দ্রিক কয়েকটি মাদক চক্র বেশ কিছুদিন ধরে পার্শ্ববর্তী মিয়ানমার থেকে মাদকদ্রব্য আইস নিয়ে আসছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে র‌্যাব গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে। এরই ধারাবাহিকতায় র‌্যাব সদর দফতরের গোয়েন্দা শাখা এবং র‌্যাব-১৫ এর যৌথ অভিযানে টেকনাফ কেন্দ্রিক আইসের সর্ববৃহৎ চালানসহ দু’জনকে গ্রেফতার করা হয়। র‌্যাব জানিয়েছে, বিশাল এক সিন্ডিকেট আনছে আইস। যা ইয়াবার চেয়েও ভয়ঙ্কর। গ্রেফতারকৃত হোছেন ওরফে খোকন টেকনাফ কেন্দ্রিক মাদক সিন্ডিকেটের অন্যতম। সে কাপড় ব্যবসা, বার্মিজ আচার ও চায়ের ব্যবসার কথা বলে অবৈধভাবে মিয়ানমারে যাতায়াত করে। এর আড়ালে মূলত তিনি ইয়াবা নিয়ে আসেন। গত পাঁচ বছর যাবত হোছেন ওরফে খোকন ইয়াবা কারবারে জড়িত। তবে বেশ কয়েক মাস ধরে তিনি আইসের চালান আনতে শুরু করে। ইতোমধ্যে তার সঙ্গে মিয়ানমারের মাদক কারবারিদের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি হয়েছে। হোছেনের সিন্ডিকেটে রয়েছে ২০-২৫ জন। টেকনাফে তার পরিচিতি হোছেন নামেই। তার নামে বিভিন্ন থানায় অস্ত্র ও মাদকসহ অন্তত সাতটি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। র‌্যাবের ভাষ্যমতে- হোছেনের অপর সহযোগী গ্রেফতার মোহাম্মদ রফিক পেশায় একজন অটোরিক্সাচালক। এর আড়ালে তিনি মাদক কারবারি চক্রের সদস্য। মিয়ানমার থেকে নৌপথে টেকনাফে আনার পর ইয়াবা ও আইসের চালান রফিকের অটোরিক্সায় পৌঁছে যায় নিরাপদ স্থানে। টেকনাফে নিজস্ব সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মজুদ রাখে ও সুযোগ বুঝে ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ বেশ কয়েকটি স্থানে পৌঁছে দেয়। কিভাবে আনা হচ্ছে এসব চালান এমন প্রশ্নই এখন বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। জানতে চাইলে র‌্যাব পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, মিয়ানমার থেকে টেকনাফ হয়ে ঢাকায় আমিয়ানমার থেকে টেকনাফ ও সেন্টমার্টিনের মধ্যবর্তী সমুদ্রপথ এলাকায় মালবাহী বোটে করে আসছে ইয়াবা ও আইসের চালান। নিরাপদে মাদকের চালান খালাস করতে ব্যবহার করা হয় লাইট সিগন্যাল। পরে তারা সুবিধাজনক সময়ে বোট ভিড়িয়ে খালাস করে ও টেকনাফের বিভিন্ন নিরাপদ বাসায় মজুদ করে। এরপর আচারের প্যাকেট, বিভিন্ন চায়ের ফ্লেভারের প্যাকেট ও বার্মিজ কাপড়ের প্যাকেটে ঢাকায় আনা হচ্ছে আইস ও ইয়াবার চালান। কারণ চট্টগ্রামে ও ঢাকার অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে আকাশচুম্বী চাহিদা রয়েছে। তাদের চাহিদা অনুযায়ী আইসের চালান আসছে। চট্টগ্রাম হয়ে বিভিন্ন যানবাহন ছাড়াও নিজস্ব যানবাহন ব্যবহার করে উত্তরা, বনানী, গুলশান, ধানমন্ডি ও মোহাম্মদপুরসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় তাদের সিন্ডিকেট সদস্য ও ডিলারদের কাছে পৌঁছে দেয় আইস ও ইয়াবার চালান। জানা গেছে, ইয়বার চেয়েও দামী মাদক হচ্ছে আইস। ঝুঁকি নিয়ে আনা গেলে এক চালানেই রাতারাতি কোটিপতি। এমন তথ্য জানিয়েছে খোদ হোছেন ও রফিক। তারা র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, ইয়াবার সঙ্গে বাংলাদেশে আইসের কারবার ছড়িয়ে দিতে কম মূল্যে বিক্রি করছে আইস। এক গ্রাম আইসের দাম মিয়ানমার কারবারিরা রাখছে ২ থেকে ৩ হাজার টাকা। যা বাংলাদেশে বিক্রি হচ্ছে ১৫ থেকে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। এটি লাভজনক হওয়ায় আইসে ঝুঁকছে মাদক কারবারিরা। গড়ে তুলছে সুসম্পর্ক। দুই দেশের মাদক কারবারিদের মধ্যে এতটাই সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছে যে, কোনভাবে আইসের কোন চালান যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক জব্দও হয় তবে সেজন্য কোন ধরনের পেমেন্ট নেয় না মিয়ানমারের মাদক কারবারিরা। তবে এসব মাদকের দাম পরিশোধ করা হয় হু-ি বা অন্য বিকল্প উপায়ে। পাশাপাশি অবৈধভাবে নিয়মিত মিয়ানমারে যাতায়াত করতেন গ্রেফতার হোছেন। মাদকের চালান খালাসের সময় মিয়ানমারের সিম ব্যবহার করতেন তিনি।
×