ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

হিন্দু বিধবারা স্বামীর সব সম্পত্তিতে ভাগ পাবেন

প্রকাশিত: ২৩:৪৯, ১৩ অক্টোবর ২০২১

হিন্দু বিধবারা স্বামীর সব সম্পত্তিতে ভাগ পাবেন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বসতভিটাসহ স্বামীর সব সম্পত্তিতে হিন্দু বিধবারা ভাগ পাবেন- উল্লেখ করা ঐতিহাসিক রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট। এক্ষেত্রে হিন্দু উইমেন্স রাইটস টু প্রপার্টি এ্যাক্ট (১৯৩৭ সাল) বাংলাদেশে প্রযোজ্য হবে বলেও রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে। মঙ্গলবার রায় প্রকাশের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন মামলার অন্যতম আইনজীবী ব্যারিস্টার সৈয়দ নাফিউল ইসলাম। তিনি বলেন, বিচারপতি মোঃ মিফতাহ উদ্দিন চৌধুরীর একক হাইকোর্ট বেঞ্চের স্বাক্ষরের পর ২২ পৃষ্ঠার এ রায় প্রকাশ হয়েছে। রায়ে আদালত বলেছেন, আইনে কোন সুনির্দিষ্ট সম্পত্তির কথা নেই। ‘সম্পত্তি’ শব্দের অর্থ সব সম্পত্তি যেখানে স্থাবর বা অস্থাবর, বসতভিটা, কৃষিভূমি, নগদ টাকা বা অন্য কোন ধরনের সম্পত্তি। কৃষিজমি ও বসতভিটার মধ্যে পার্থক্য করার সুযোগ নেই এবং এ ধরনের সম্পত্তি বিধবার বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয়। এর আগে গতবছরের ২ সেপ্টেম্বর খুলনার হিন্দু পরিবারের সম্পত্তি নিয়ে করা এক আবেদনের (রিভিশন) শুনানি শেষে বিচারপতি মোঃ মিফতাহ উদ্দিন চৌধুরীর একক হাইকোর্ট বেঞ্চ ওই রায় দেন। খুলনার বটিয়াঘাটার জ্যোতিন্দ্র নাথ ম-লের করা আবেদন (রিভিশন মামলা) খারিজ করে বিচারপতি মোঃ মিফতাহ উদ্দিন চৌধুরীর একক হাইকোর্ট বেঞ্চের দেয়া রায়ে এ পর্যবেক্ষণ এসেছে। আদালতে আবেদনকারীর আইনজীবী ছিলেন মোঃ আব্দুল জব্বার। বিপক্ষে আইনজীবী ছিলেন নাফিউল ইসলাম। এ্যামিচি কিউরি হিসেবে এ মামলায় মতামত দিয়েছেন আইনজীবী উজ্জল ভৌমিক। আইনজীবী নাফিউল ইসলাম বলেন, খুলনার রাজবিহারী ম-লের দুই ছেলে। তারা হলেন- জ্যোতিন্দ্রনাথ ম-ল ও অভিমন্যু ম-ল। অভিমন্যু ১৯৫৮ সালে মারা যান। এ অবস্থায় মৃত ভাইয়ের স্ত্রী (গৌরী দাসী) কৃষিজমি পাবেন না, শুধু বসতভিটা থেকে অর্ধেক পাবেন- এমন দাবি নিয়ে ১৯৮৩ সালে নিম্ন আদালতে মামলা করেন জ্যোতিন্দ্র নাথ। মামলায় পক্ষ যথাযথভাবে না করায় ১৯৯৬ সালে তা খারিজ করে রায় দেন আদালত। তবে গৌরীর কৃষিজমির সম্পত্তি পাবেন না বলে পর্যবেক্ষণ দেয়া হয়। এ রায়ের বিরুদ্ধে খুলনার যুগ্ম-জেলা জজ আদালতে আপীল করেন জ্যোতিন্দ্রনাথ। আদালত ২০০৪ সালের ৭ মার্চ রায় দেন। রায়ে বসতভিটা ও কৃষিজমিতে গৌরী দাসীর অধিকার থাকবে বলা হয়। এ রায়ের বিরুদ্ধে ২০০৪ সালে হাইকোর্টে রিভিশন আবেদন করেন জ্যোতিন্দ্রনাথসহ অন্যরা। রিভিশন আবেদনের শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট রায় দেন। রায়ের পর উজ্জল ভৌমিক বলেন, ‘রায়ের এই পর্যবেক্ষণের আইনগত বাধ্যবাধকতা আছে। দেশের নিম্ন আদালত এই পর্যবেক্ষণ মানতে বাধ্য। এই রায়ের ফলে দেশের হিন্দু বিধবা নারীরা (জীবনস্বত্ব) তার স্বামীর রেখে যাওয়া কৃষি জমি ভোগ-দখল করতে পারবেন। এতদিন বিধবা নারীরা শুধু অকৃষি জমির অধিকারী ছিলেন। এখন স্বামীর সব সম্পত্তিতে বিধবা নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলো।’ তিনি আরও বলেন, ১৯৩৭ সালের আগে হিন্দু বিধবারা সম্পত্তির অধিকার পেত সন্তানের অবর্তমানে। ১৯৩৭ সালে ‘দ্য হিন্দু ওমেন’স রাইট টু প্রোপার্টি এ্যাক্ট’ করার পরে স্বামীর রেখে যাওয়া যে কোন (কৃষি-অকৃষি) সম্পত্তিতে সন্তানের সঙ্গে হিন্দু বিধবা নারীকে সমান অধিকার দেয়া হয়। অর্থাৎ বিধবার যদি ছেলেও থাকে তাহলে সে সমান সম্পত্তি পাবে। বিধবার যদি তিনটি ছেলে থাকে তাহলে সে সম্পত্তি সমান চারভাগ হবে, দুই ছেলে থাকলে সমান তিন ভাগ হবে। এক ছেলে থাকলে সমান দুই ভাগ হবে, এ রকম। ১৯৩৭ সালের এই আইনটি চ্যালেঞ্জ করলে ইন্ডিয়ার ফেডারেল কোর্ট ১৯৪১ সালে কৃষি জমির অধিকারের ক্ষেত্রে হিন্দু বিধবাদের অধিকার বাতিল করে দেয়। আইনজীবী উজ্জল ভৌমিক বলেন, ‘১৯৭২ সালের আগে ইন্ডিয়ার ফেডারেল কোর্টের রায় অনুযায়ী এই বিধানই চলে আসছিল। কিন্তু দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালে ১৯৩৭ সালের ‘দ্য হিন্দু ওমেন’স রাইট টু প্রোপার্টি এ্যাক্ট’ সরাসরি গ্রহণ করে বাংলাদেশ সরকার। ‘মূল আইনটিতে যেহেতু হিন্দু বিধবাদের সম্পত্তির অধিকারের ক্ষেত্রে স্বামীর যে কোন সম্পত্তির কথা বলা আছে, সেই আইনটিকেই বিচারিক ঘোষণার মাধ্যমে আরও পরিষ্কার করল।’ বিভিন্ন সময় বাংলাদেশের আদালত ভারতের ফেডারেল কোর্টের ১৯৪১ সালের দেয়া রায় অনুসরণ করেছে জানিয়ে এ আইনজীবী বলেন, ‘যেমন বিচারপতি হাবিবুর রহমানের একটি রায়ে বলা হয়েছিল, হিন্দু বিধবারা স্বামীর কৃষি জমিতে অধিকার পাবেন না। আবার বিচারপতি মোস্তফা কামাল রায়ে (যেটি ৩৪ ডিএলআর) বলেছেন, কৃষি জমিতে অধিকার পাবেন। ভাগ-বাটোয়ারার মামলায় এ রকম সাংঘর্ষিক রায় আছে আমাদের। একমাত্র এই স্বত্ত্ব মামলাটিতেই এ বিষয়টি পরিষ্কারভাবে আসল।’ মামলার কাগজপত্র থেকে জানা যায়, খুলনার বটিয়াঘাটার হালিয়া গ্রামের অভিমুণ্য ম-ল মারা যাওয়ার পর তার রেখে যাওয়া কৃষি জমি স্ত্রী গৌরী দাসীর নামে রেকর্ড হয়। এই রেকর্ড সংশোধনের জন্য ১৯৯৬ সালে খুলনার সহকারী জজ আদালতে মামলা করেন গৌরী দাসীর দেবর জ্যোতিন্দ্র নাথ ম-ল। আদালত ওই বছরের ৩০ মে তার আবেদন খারিজ করে দেয়। ১৯৪১ সালের ইন্ডিয়ার ফেডারেল কোর্ট এবং বাংলাদেশের হাইকোর্টের বিভিন্ন রায় অনুসরণ করে জ্যোতিন্দ্র নাথ ম-লের আবেদনটি খারিজ করা হলেও রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলে দেয়, গৌরী দাসী স্বামী অভিমূণ্য ম-লের কৃষি সম্পত্তিতে অধিকার পাবেন না।
×