ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ডেসটিনি টু ইভ্যালি ডিজিটাল ফাঁদ ৯ সুদবিহীন উচ্চ মুনাফার প্রলোভন ও ধর্মীয় অনুভ‚তি কাজে লাগানো হচ্ছে

এমএলএমের মোড়কে শরিয়তসম্মত ব্যবসা!

প্রকাশিত: ২৩:৩৩, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২১

এমএলএমের মোড়কে শরিয়তসম্মত ব্যবসা!

রহিম শেখ ॥ একসময় বহু স্তর বিপণন কোম্পানি ডেসটিনি ও যুবকের প্রতারণার ঘটনায় আলোড়ন সৃষ্টি হলেও বেশি মুনাফার লোভ দেখিয়ে মানুষের টাকা আত্মসাতের ঘটনা কোনভাবেই বন্ধ হচ্ছে না। বরং দিন দিন আরও বাড়ছে। কখনও সমবায় প্রতিষ্ঠানের নামের শেষে ব্যাংক শব্দটি ব্যবহার করে, আবার কখনও সরাসরি মাল্টিপারপাস বা মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) ব্যবসার নামে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাত করা হচ্ছে। করোনায় মানুষের আয় কমে যাওয়া ও বেকারত্ব বৃদ্ধির সুযোগে নতুন মোড়কে এমএলএম ব্যবসা ও ‘হায় হায়’ কোম্পানির তৎপরতা বহুগুণে বেড়ে গেছে। এসব প্রতিষ্ঠান গ্রাহক টানতে সুদবিহীন উচ্চ মুনাফার প্রলোভন ও ধর্মীয় আবেগ কাজে লাগানো হচ্ছে। এতে বেশি মুনাফার প্রত্যাশায় গ্রামের সহজ-সরল মানুষগুলো না বুঝেই পা দিচ্ছেন তাদের প্রতারণার ফাঁদে। স¤প্রতি ১৭ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন এহসান গ্রæপের চেয়ারম্যান মোঃ রাগীব আহসান। এক লাখ টাকার বিপরীতে গ্রাহকদের মাসে দুই হাজার টাকা মুনাফার প্রলোভন দিয়ে প্রায় লক্ষাধিক গ্রাহকের কাছ থেকে এই টাকা নেয়া হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাগীব আহসান ২০০৬-০৭ সালে তিনি ইমামতির পাশাপাশি ‘এহসান এস মাল্টিপারপাস’ নামে একটি এমএলএম কোম্পানিতে ৯০০ টাকা বেতনের চাকরি করতেন। মূলত এই প্রতিষ্ঠানে চাকরির সুবাদে এমএলএম কোম্পানির আদ্যোপান্ত রপ্ত করেন তিনি। পরে নিজে ২০০৮ সালে ‘এহসান রিয়েল এস্টেট’ নামে একটি এমএলএম কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিল আয়োজনের নামে ‘শরিয়তসম্মত সুদবিহীন বিনিয়োগ’-এর প্রচার চালিয়ে প্রতারণার ফাঁদ পাতেন রাগীব আহসান। আবাসন প্রতিষ্ঠান, দোকান ও ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ কথিত বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের আড়ালে এক লাখের বেশি গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। প্রতারিত হওয়াদের একজন পিরোজপুরের রানীপুরের মনি আক্তার। জনকণ্ঠকে বলেন, ‘২০১০ সালে রাগীব আহসানের নূরে মদিনায় সাত বছরের জন্য ডিপিএস খুলি। সেখানে ১২ লাখ টাকা জমা করেছি। লাভসহ ১৫ লাখ টাকা দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু সময় শেষ হলেও কোন টাকা দেয়নি। গত দুই মাস বলেছে দুই বছর সময় লাগবে। আমার মা ও ভাইও প্রতারিত হয়েছে।’ রাগীব আহসানের প্রতিষ্ঠানের প্রতারণার শিকার আরেক গ্রাহক রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানা এলাকার পূর্ব রাজাবাজারের বাসিন্দা শেখ হুমায়ূন কবির। এক চেকেই এহসান গ্রæপের কাছে তার পাওনা ১১ কোটি ২০ লাখ টাকা। আরও কয়েকটি চেকেও প্রতিষ্ঠানটির কাছে তার বড় অঙ্কের পাওনা রয়েছে। পাওনা আদায়ে আদালতে মামলাও করেছেন হুমায়ূন কবির। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ‘মুফতি মানুষ, ওয়াজ নসিহত করেন। মসজিদের ইমাম ছিলেন, নূরে মদিনা ক্যাডেট মাদ্রাসার অধ্যক্ষ তিনি। নাম মাওলানা মুফতি রাগীব আহসান। তিনি এহসান গ্রæপের চেয়ারম্যান। তার সঙ্গে আছেন আরও কয়েকজন বড় বড় মাওলানা। তাদের ‘সুদবিহীন’ শরিয়তসম্মত ব্যবসায় বিনিয়োগের কথা শুনে আমিসহ অনেকেই টাকা জমা রাখি। শেষ পর্যন্ত দেখি তারাও প্রতারক। আমাদের টাকা আত্মসাত করে আত্মগোপনে চলে যায়।’ শুধু হুমায়ূন কবিরই নন, ‘শরিয়তসম্মত ব্যবসা’র নামে এরকম বিপুলসংখ্যক গ্রাহকের কাছ থেকে ব্যবসা ও বিনিয়োগের কথা বলে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এহসান গ্রæপ। রাগীব আহসানের বিরুদ্ধে ঢাকার সিএমএম আদালতে ১১ কোটি ২০ লাখ টাকার চেক প্রতারণার মামলা করেছেন শেখ হুমায়ূন কবীর। তিনি ১০ কোটি টাকার চেক প্রতারণার আরও একটি মামলা করেন ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে। পাওনা ২ কোটি ৮০ লাখ টাকার দাবিতে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে মামলা করেছেন আরেক গ্রাহক পিরোজপুরের মোঃ মাহমুদুল হাসান। এর আগে দ্য ঢাকা মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ ব্যাংক নামের একটি সমবায় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অবৈধ ব্যাংকিংয়ের প্রমাণ পায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম বন্ধে প্রায় চার বছর আগে ব্যবস্থা নিতে অর্থ মন্ত্রণালয়, সমবায় অধিদফতর ও দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) চিঠি দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এর পরই প্রতিষ্ঠানটি আদালতে রিট করে কার্যক্রম অব্যাহত রাখে। সরেজমিনে ঢাকা মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ ব্যাংকের মালিবাগ শাখায় গিয়ে দেখা যায়, ভেতরে ব্যাংকের মতোই অবয়ব। টাকা জমা ও উত্তোলনের জন্য রয়েছে পৃথক কাউন্টার। সঞ্চয় ¯িøপের মাধ্যমে টাকা জমা এবং চেক বইয়ের মাধ্যমে গ্রাহকরা টাকা তুলছেন। গ্রাহক পরিচয়ে ওই শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপক অলোক কুমার দাসের কাছে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘এটি একটি ব্যাংক।’ বাংলাদেশ ব্যাংকের তালিকাভুক্ত কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘না, আমাদেরটা নন-সিডিউলভুক্ত ব্যাংক। সমবায় অধিদফতরে নিবন্ধিত।’ এরপর তিনি তাঁদের বিভিন্ন আমানত প্রকল্প সম্পর্কে একটা ধারণা দেন। তিনি জানান, ১ জুলাই থেকে তাঁদের বিভিন্ন আমানত প্রকল্পের মুনাফার হার কিছুটা কমিয়ে আনা হয়েছে। এক লাখ টাকা বা তদুর্ধ আমানত পাঁচ বছরের জন্য কেউ রাখলে এখন ৯ শতাংশ মুনাফা দেয়া হচ্ছে। জুলাইয়ের আগে এই সুদের হার ছিল আরও বেশি। এছাড়া যে কোন প্রাথমিক জমা টাকা সাড়ে সাত বছরে দ্বিগুণ ও ১২ বছরে তিন গুণ হয়। অথচ ব্যাংকগুলোতে টাকা রাখলে এখন সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ সুদও মিলছে না। চলতি বছরের মার্চে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশদ তদন্তে স্মল ট্রেডার্স কো-অপারেটিভ (এসটিসি) ব্যাংকের বিরুদ্ধে অবৈধ ব্যাংকিংয়ের প্রমাণ মেলে। এরপরই প্রতিষ্ঠানটির সব কার্যক্রম বন্ধে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ও সমবায় অধিদফতরে চিঠি দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোঃ সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘ঢাকা মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ ব্যাংক, এসটিসি ব্যাংকসহ যে প্রতিষ্ঠান নামের শেষে ব্যাংক শব্দ যুক্ত করে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে সেগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লাইসেন্সভুক্ত না হওয়ায় সরাসরি কোন ব্যবস্থা আমরা নিতে পারি না। তারা যে সংস্থার লাইসেন্সভুক্ত তারা এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে।’
×