ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জাতির অহংকার

প্রকাশিত: ২৩:০৯, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২১

জাতির অহংকার

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালীকে তাঁর হাজার বছরের ইতিহাসে প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র প্রদান করেছেন, তাঁরই কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা কর্তৃক সেই রাষ্ট্রটি আজ বিশ্বমান চিত্রে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত। তাঁরই শাসনকাল ইংল্যান্ডের রানী প্রথম এলিজাবেথের শাসনকালের মতো আজ থেকে ৫০০ বছর পরেও বাঙালীর ইতিহাসে স্বর্ণযুগ হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। শেখ হাসিনার শাসনকালেই বাঙালী বিশ্বসভায় উন্নত মস্তকে দাঁড়াতে পেরেছে। বাঙালীর জন্য তাঁর ইতিহাসের প্রথম প্রকৃত স্বাধীন রাষ্ট্র সৃষ্টি করার পর বঙ্গবন্ধু মাত্র সাড়ে তিন বছর সেই রাষ্ট্রটিকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। তিনি যে রাষ্ট্রটি পেয়েছিলেন সেটি ছিল পাকিস্তান সৈন্য কর্তৃক বর্ণনাতীতভাবে বিধ্বস্ত এক দেশ, প্রতিটি খাতেই নিঃস্ব এক রাষ্ট্র-কৃষিতে, শিল্পে এমনকি সেবা খাতেও। এই বিধ্বস্ত রাষ্ট্রটিকে তিনি সাড়ে তিন বছরের মধ্যেই পুনর্নির্মাণ করেছিলেন, প্রদান করেছিলেন রাজনৈতিক কাঠামো-দশ মাসের মধ্যেই বাঙালীর প্রথম সংবিধান রচিত হয়েছিল (যা পাকিস্তান প্রদান করতে সক্ষম হয়েছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ৯ বছর পর ১৯৫৬ সালে); পরিকল্পিত পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য অর্থনৈতিক কাঠামো, প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা। ১৯৭৫ সালের মধ্যেই তিনি বাংলাদেশকে বিশ্বমানচিত্রে গৌরবের আসনে প্রতিষ্ঠা করার পথে এগিয়ে নিয়ে যান, বাংলাদেশের কৃষিকে করেন প্রায় স্বয়ম্ভর শিল্পের ক্ষেত্রেও ’৭৩-’৭৪ এ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৮ শতাংশ, যা পরবর্তী ৮ বছরের কোন আর্থিক বছরেই অর্জন করা সম্ভব হয়নি। তিনি বেঁচে থাকলে সম্ভবত দু’দশকের মধ্যেই বাংলাদেশ উন্নত রাষ্ট্রের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছত। এই রাষ্ট্রটিকে তিনি কিভাবে পুনর্গঠন করতে চেয়েছিলেন, কিভাবে বিধ্বস্ত অর্থনীতিকে উন্নয়নের পথে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, প্রতিটি বাঙালীর জন্য অর্থনৈতিক মুক্তি, স্বাস্থ্য-শিক্ষা-সংস্কৃতিঋদ্ধ জীবন চেয়েছিলেন, তা তাঁর সাড়ে তিন বছরব্যাপী শাসনকালের বিভিন্ন প্রয়াসের মধ্যে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। ৭ই মার্চ, ১৭ই মার্চ, ২৬শে মার্চ, ২১শে ফেব্রæয়ারি, ১৬ই ডিসেম্বর- এই দিনগুলো বাঙালীর হাজার বছরের ইতিহাসে স্মরণীয় দিবসের মর্যাদায় অভিষিক্ত। আজ থেকে সহস্র বছর পরেও এই দিনগুলো গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে বাঙালী স্মরণ করবে। কারণ এই দিনগুলোর ঘটনাবলীর মধ্য দিয়ে বাঙালী অর্জন করেছে ভাষার অধিকার, তার নিজের রাষ্ট্র ও স্বাধীন সত্তা। ঠিক একইভাবে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বাঙালীর ইতিহাসের ঘৃণ্যতম দিন। এই দিনটিতে কতিপয় ‘মানুষ’ নামের অযোগ্য নরপশু জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা করে। এই মানুষগুলো এতই ঘৃণ্য-হিংস্র-বিবেকহীন ছিল যে, তারা কেবল বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি, তারা হত্যা করেছে তাঁর নবপরিণীতা পুত্রবধূদের, এমনকি শিশু রাসেলকে, হত্যা করেছে ১৬ জন নিরীহ মানুষকে। বঙ্গবন্ধুর মহাপ্রয়াণের পর বাংলাদেশের ইতিহাস পিছিয়ে পড়ার ইতিহাস। বঙ্গবন্ধু একটি সাম্যভিত্তিক, অসাম্প্রদায়িক, শোষণমুক্ত-গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য যে-ভিত্তি তৈরি করেছিলেন পরবর্তী ২১ বছরে বাংলাদেশ তা থেকে প্রায় সবক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে। সংবিধানকে সামরিক ফরমানের মাধ্যমে পরিবর্তন করে বাংলাদেশকে একটি সাম্প্রদায়িক ও শোষণভিত্তিক দেশে রূপান্তর করা হয়। আইনের যে-মূলভিত্তি অন্যায়-অপরাধের বিচার এবং ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা তার মর্মমূলেই আঘাত হানা হয়। ’৭৫ উত্তর শাসকরা সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার মতো একটি বিশাল অপরাধকে সাংবিধানিক বৈধতা দেয়, এই হত্যাযজ্ঞকে বিচারবহিভর্‚ত বিষয় (ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে) ঘোষণা করে। বঙ্গবন্ধু যখন নিহত হন সে সময় তাঁর দু’কন্যা বিদেশে থাকায় প্রাণে রক্ষা পান। ইতিহাস ও সমাজ-সচেতন যেকোন ব্যক্তি উপলব্ধি করবে ’৭৫-উত্তর বাংলাদেশের ইতিহাস একই সঙ্গে গভীর বেদনা ও বেদনাকে জয় করে বিজয়ের ইতিহাস। এই বিজয়ের এবং বাঙালীর পুনরুজ্জীবনের হোতা বা সাগ্নিক জাতির জনকের কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা। ভাবতে অবাক লাগে, শেখ হাসিনা (এবং শেখ রেহেনা) কিভাবে এত বড় বিপর্যয়কে জয় করতে পেরেছিলেন? বাবা, মা, ভাই, বোনসহ প্রায় ২০ জনের মতো নিকট আত্মীয়কে হারিয়েও তাঁরা যে তাঁদের জীবনকে সুস্থতার পথে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন এটিই পরম বিস্ময়ের। প্রায় দীর্ঘ ৬ বছর প্রবাসজীবন সমাপ্ত করে ১৯৮১ সালের মে মাসে শেখ হাসিনা যখন স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে বৃত হয়ে, তখন এই দেশে সামরিক ও আধা সামরিক সরকার রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। তিনি এদেশে ফিরে এসেছিলেন গণতন্ত্রের বহ্নিশিখা হিসেবে। তাঁকে দেশে ফিরে প্রায় দেড় দশক ধরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করতে হয়েছে। তাঁকে যাঁরা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে ফিরিয়ে এনেছিলেন তাঁদের অনেকেই ভেবেছিলেন, তিনি থাকবেন নামেমাত্র আওয়ামী লীগের সভাপতি, তাঁকে সামনে রেখে তাঁরাই আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তাকে ব্যবহার করে রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন; আওয়ামী লীগকেও নিয়ন্ত্রণ করবেন। কিন্তু অচিরেই তাঁরা এমন এক নেত্রীকে দেখতে পেলেন, যিনি সব হারিয়ে বাংলাদেশের জন্য সবকিছু ত্যাগে প্রস্তুত। আপাত কোমল হলেও সংকল্পে কঠিন, লক্ষ্য-অর্জনে দৃঢ়-প্রতিজ্ঞ। ॥ দুই ॥ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের দীর্ঘ ২১ বছর পরে আবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হয় ১৯৯৬ সালে। মধ্যবর্তী এই ২১ বছরে যারা ক্ষমতায় ছিল- সেই বিএনপি, জামায়াত শাসকবর্গ বাংলা ভাষাভাষী বাঙালীর হাজার বছরের যে শ্রেষ্ঠ অর্জন মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, সেই মহাইতিহাস, মরণজয়ী যুদ্ধের ইতিহাস দুই প্রজন্মকে (১৯৭০, ১৯৮০ দশকে জন্ম নেয়া দু’প্রজন্মকে) জানতে দেয়নি, প্রায় ভুলিয়ে দিয়েছিল। তারা আরও ভুলিয়ে দিয়েছিল, এই বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মহানায়ক শ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। তাদের শুনতে দেয়নি তাঁর সেই ৭ই মার্চের স্বাধীনতার ভাষণ, যা বিগত আড়াই (২৫০০) হাজার বছরের ইতিহাসে স্বাধীনতার জন্য যেসব অসাধারণ ভাষণ দেয়া হয়েছে সেসব ভাষণের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। বঙ্গবন্ধুর আগে আর কোন দেশের রাজনৈতিক নেতা এ রকম বজ্রকণ্ঠে প্রায় অসাধারণ ছন্দোবদ্ধ বাক্য-বিন্যাসে দশ লাখ জনতার সামনে স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ তাঁর ভাষণের এই শেষ বাক্যটি ছিল মহাকাব্যিক, যা একটি মহাজাতির স্বপ্নকে রূপ দিয়েছিল। ’৭৫-উত্তর আড়াই দশকে এই অসাধারণ ভাষণটি, যা আজ বিশ্বমর্যাদাভ‚ষিত, তা স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস বা একুশে ফেব্রæয়ারি কোন দিনই প্রচারিত হতো না। জননেত্রী শেখ হাসিনা তাই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর এই দেশটিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য, মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করার জন্য ১৯৮১ থেকে যে-উদ্যোগ শুরু করেন, সেই প্রয়াস খুব সহজ ছিল না। তাঁকে অতিক্রম করতে হয়েছে বিশাল বিশাল বাধা। এমনকি ক্ষমতায় আসার অনেক আগেই যখন তিনি বাংলার মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম শুরু করেছিলেন, সেই সময়ে ১৯৮৮ সালের ২৪শে জানুয়ারি তাঁকে হত্যার প্রচেষ্টা চালানো হয়। কারণ, তিনি সেই সময়ে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার সপক্ষে জনগণের গণতন্ত্রের আকাক্সক্ষাকে রূপ দেয়ার জন্য চট্টগ্রামের এক সভায় যোগ দিতে এসেছিলেন। চট্টগ্রামের জনগণ তাঁকে মানবব্যুহ রচনা করে রক্ষা করেছিল। ২২ জন আত্মবিসর্জন দিয়েছিলেন। এরপরেও বারবার তাঁকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা হয়েছে। এর কারণ, ’৭৫ পরবর্তীকালে যারা ক্ষমতায় আসীন ছিল, তারা বাংলাদেশের আদর্শে বিশ্বাসী ছিল না। বাঙালীর সংস্কৃতি, বাঙালীর সাহিত্য, বাঙালীর ঐতিহ্যকে তারা কখনও নিজের বলে গ্রহণ করেনি। তারা ছিল ধর্ম-ব্যবহারকারী প্রতিক্রিয়াশীল। এই গোষ্ঠীটি মনে করেছিল, শেখ হাসিনা যেহেতু বঙ্গবন্ধুর কন্যা, তাঁর আদর্শের অনুসারী, তাঁর রাজনৈতিক অস্তিত্ব যদি অক্ষুণœ থাকে তাহলে তা তাদের স্বার্থকে, সাম্প্রদায়িক-অগণতান্ত্রিক রাজনৈতিক আদর্শকে বিপন্ন করবে। সেই জন্যই বারবার তাঁর জীবননাশের চেষ্টা। ২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট এই কারণেই তাঁর ওপর নেমে এসেছিল রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস (জামায়াত-বিএনপির), যাতে তিনি (১৯৯৬ সালের মতো) আবার ক্ষমতায় ফিরে আসতে না পারেন। ॥ তিন ॥ ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসীন হয়েই শেখ হাসিনা অনেক জনকল্যাণমূলক, জনবান্ধব পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। এর প্রথম পদক্ষেপটি ছিল, বাংলাদেশকে দারিদ্র্যমুক্ত করা, ক্ষুধামুক্ত করা। ১৯৯৮ সালে প্রায় সারা বাংলাদেশজুড়ে সর্বগ্রাসী এক বিরাট বন্যা হয়েছিল। এই বন্যায় দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ কৃষিভ‚মি জলমগ্ন ছিল। কোন কোন জায়গা থেকে ৭-৮ মাসেও বন্যার জল সরেনি। অনেক অর্থনীতিবিদ ও বিদেশী বিশেষজ্ঞ ধারণা করেছিলেন, এই বন্যায় বড় ধরনের খাদ্যঘাটতি দেখা দেবে, বহু লোক মারা যাবে। শেখ হাসিনা ও সেই সময়কার কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এই বিপদের মোকাবেলা করেন, কোন দুর্ভিক্ষ হতে দেননি; নিরন্ন মানুষের কাছে খাদ্য পৌঁছিয়ে দিয়েছিলেন। প্রায় ১ কোটি মানুষকে বিজিএফ কার্ডের মাধ্যমে খাদ্য সরবরাহ করা হয়েছিল। কেবল তা’ই নয়, বাংলাদেশের কৃষিকে স্বয়ম্ভর করার জন্য এর পরের বছর থেকে ডবিøউটিও, ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের ভ্রƒকুটি উপেক্ষা করে কৃষিতে বিশাল পরিমাণে ভর্তুকি প্রদান শুরু করা হয়; প্রায় বিনামূল্যে বিতরণ করা হয় হাইব্রিড বীজ, পাশাপাশি জৈবিক সার, আমদানিকৃত কীটনাশক ও ডিপটিউবলের মাধ্যমে পানি উত্তোলনের জন্য স্বল্পমূল্যে জ্বালানি। ফলস্বরূপ ১৯৯৯-২০০০, ২০০০-২০০১ এই দু’অর্থবছরে বাংলাদেশ কৃষিতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে। দুর্ভাগ্য, দেশরতœ শেখ হাসিনা সরকারের এই কৃষিনীতি পরবর্তী জোট সরকার অনুসরণ না করার ফলে বাংলাদেশ আবার কৃষিতে পরনির্ভর হয়ে পড়েছিল। ক্ষমতায় এসেই (১৯৯৬ সালে) শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে নতুন পথে পরিচালিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। জনগণের, সাধারণ মানুষের কল্যাণে দুটি বিশেষ কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়, একটি হলো বৃদ্ধদের জন্য বয়স্ক ভাতা, অন্যটি বাস্তুহীন মানুষের জন্য ‘ঘরে ফেরা কর্মসূচি’ বা আশ্রয়স্থল তৈরি, বর্তমানে যা ‘আশ্রয়ণ’ প্রকল্প হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে। এই প্রকল্পের অধীনে এ পর্যন্ত প্রায় ৩,০০,০০০ (তিন লাখ) গৃহহীন মানুষকে গৃহ প্রদান করে সেই আশ্রয়ের গৃহের স্বত্বাধিকারী করা হয়েছে। ১৯৯৬-এর আগে, শেখ হাসিনা সরকারের আগে পূর্ব পাকিস্তানে বা বাংলাদেশে কোন প্রকৃত সোশ্যাল সিকিউরিটি বা সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা ছিল না। তিনিই প্রথম বাংলাদেশে এই ব্যবস্থার সূচনা করেন। মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়ার জন্য তিনি কমিউনিটি ক্লিনিকেরও প্রবর্তন করেছিলেন। তাঁর পরিকল্পনা ছিল দশ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন, যার মাধ্যমে কেবল শহরের মানুষ নয়, গ্রামের মানুষও স্বাস্থ্যসেবা পায়। দুঃখের বিষয়, এই প্রকল্পও পরবর্তী জোট সরকার বহাল রাখেনি। ক্ষমতায় এসে হাসিনা সরকার এই সেবা আবার চালু করে। বর্তমানে বাংলাদেশের কমিউনিটি ক্লিনিকের সংখ্যা প্রায় চৌদ্দ হাজার (১৪,০০০)। এসব ক্লিনিক গ্রামাঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে বড় ভূমিকা রাখছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ যখন দীর্ঘ ২১ বছর পরে ক্ষমতাসীন হয় সেই সময়ে এই দেশে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি, আওয়ামীবিরোধী শক্তির প্রভাব ছিল প্রায় সর্বক্ষেত্রে। এ কারণে তিনি এই পর্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ যথাযথভাবে শুরু করতে পারেননি, ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ প্রত্যাহার করতেও তাঁকে বিরাট বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। পূর্ববর্তী পার্লামেন্ট অর্থাৎ ২০০১-০৬ কালপর্বের পার্লামেন্টে বঙ্গবন্ধু হত্যাকর্মযজ্ঞের অন্যতম প্রধান নেতা রশিদকেও পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত করে আনা হয়েছিল। এছাড়া অন্য হত্যাকারীরাও বিভিন্ন দেশে, বাংলাদেশের দূতাবাসসমূহে অফিসার পদে সমাসীন ছিল। এসব বাধা সত্তে¡ও শেখ হাসিনা দৃঢ় চিত্তে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে এগিয়ে গেছেন। পার্লামেন্টকে শক্তিশালী করতে প্রবর্তন করেন পার্লামেন্টারি কমিটি, যেসব কমিটিতে সদস্য ও চেয়ারম্যান অন্তর্ভুক্ত করা হয় বিরোধী দল থেকেও। ১৯৯৬-২০০১ কালপর্বে দেশরতœ শেখ হাসিনা সরকারের দুটি অবদান অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। একটি হলো পার্বত্য শান্তিচুক্তি, অপরটি হলো ভারতের সঙ্গে গঙ্গা পানি বণ্টনচুক্তি। বর্তমানে অনেকেরই হয়ত এই সত্যটি জানা নেই, বিশ্বজুড়ে উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে একসময় হিমালয়ে যে-উচ্চতায় প্রচুর বরফ জমতো সেসব অঞ্চল এখন বরফহীন; বরফ জমে তার অনেক উপরে। ফলে গঙ্গার পানি-প্রবাহ উজানের দেশেই (টঢ়ঢ়বৎ জরঢ়ধৎরধহ) অনেক কমে গেছে। তাই এই সরকার ভারতের সঙ্গে দ্রæত একটি পানিচুক্তি সম্পাদন করতে সচেষ্ট হয়, যাতে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশ নির্ধারিত পরিমাণ পানি পায় চুক্তি অনুযায়ী। নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য এই চুক্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি। (পানি পাওয়ার জন্যই বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার ভারতের সঙ্গে তিস্তাচুক্তি করতে আগ্রহী, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বাধার কারণে তা এখনও পর্যন্ত সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি)। এই কালপর্বে (১৯৯৬-২০০১) হাসিনা সরকারের আরও একটি বৃহৎ অর্জন রয়েছে, তা হলো পার্বত্য শান্তিচুক্তি। ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত পার্বত্য শান্তিচুক্তির মাধ্যমে দেশের প্রায় এক দশমাংসজুড়ে যে-প্রচণ্ড অশান্তি ও যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছিল, তার অবসান ঘটে। এই চুক্তির ফলে বাংলাদেশের এক বিরাট অঞ্চলে কেবল যে শান্তিই ফিরে এসেছে তা নয়, বহু সাধারণ মানুষ ও সৈনিকের জীবনহানির আশঙ্কারও পরিসমাপ্তি ঘটেছে। এই ধরনের চুক্তির জন্য বিশ্বের অনেক নেতাই শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। পার্বত্য শান্তিচুক্তিটি এমন একটি অসাধারণ চুক্তি, যার জন্য শেখ হাসিনাও শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য ছিলেন, তাঁকে এই পুরস্কার দেয়া উচিত ছিল। শান্তি স্থাপনে এর চেয়ে অনেক ছোট উদ্যোগকেও শান্তি পুরস্কারে ভ‚ষিত করা হয়েছে। আরেকটি ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের স্বার্থ ও অধিকার রক্ষার জন্য যে-অনমনীয় চারিত্রিক দৃঢ়তার প্রমাণ রেখেছিলেন, যা আজ অনেকে ভুলে গেছে, যা স্মরণীয় হয়ে থাকা আবশ্যক, তা হলো, সে সময় মার্কিন রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফর। বিশ্বজুড়ে তখন একটি ধারণা ছিল, বাংলাদেশ গ্যাসের ওপরে ভাসছে, বাংলাদেশের ভ‚-গর্ভে বিশাল পরিমাণে গ্যাস রয়েছে। ক্লিনটন তাই হাসিনা সরকারকে অনুরোধ করেছিলেন বিভিন্ন দেশী-বিদেশী গ্যাস কোম্পানির মাধ্যমে এই গ্যাস বিদেশে রফতানি করার জন্য, বিশেষত পার্শ্ববর্তী দেশসমূহে। শোনা যায়, এই গ্যাস রফতানিতে তৎকালীন মার্কিন উপ-রাষ্ট্রপতি বিশেষভাবে আগ্রহী ছিলেন। হাসিনা রাজি হননি। তিনি স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, আমরা এখনও জানি না, বাংলাদেশের ভ‚-গর্ভে কী পরিমাণ গ্যাস রয়েছে। বাংলাদেশ ৫০ বছরের প্রয়োজনীয় গ্যাস রিজার্ভ রেখেই কেবল উদ্বৃত্তটুকু রফতানি করবে, অন্যথায় নয়। শোনা যায়, শেখ হাসিনার গ্যাস রফতানিতে এই অসম্মতি বিশ্বের বহু শক্তিশালী রাজনীতিবিদ ও কর্পোরেশনকে ক্ষুব্ধ করেছিল। এ সময়েই বিএনপির অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান বিদেশী শক্তিসমূহকে সন্তুষ্ট করতে, পক্ষে আনার জন্য মন্তব্য করেছিলেন, মাটির তলায় গ্যাস রেখে দিয়ে আমাদের কি লাভ? বর্তমানে আমরা জানি, বস্তুত বাংলাদেশে মাটির নিচে আমাদের প্রয়োজনীয় গ্যাসও নেই। ॥ চার ॥ ২০০৯ সালে দেশরত্ন শেখ হাসিনা দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশকে যেভাবে রূপান্তরিত করেছেন, তার ফলে বাংলাদেশ আজ বিশ্বে উন্নয়নের পথ-প্রদর্শক, এক বিরাট বিস্ময়। গত বারো বছরে শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে একটি প্রকৃত স্বাধীন রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করেছেন, যে রাষ্ট্র তাঁর অস্তিত্বের জন্য, তাঁর উন্নয়নের জন্য কোন পরাশক্তির ওপর নির্ভরশীল নয়। বিশ্বের বৃহৎ সব শক্তি, বৃহৎ সব কর্পোরেশন, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, আইএমএফ, ডবিøউটিও প্রভৃতি ‘বৃহৎ পুঁজির’ প্রতিভ‚দের ভ্রƒকুটি বা নির্দেশ আজ বাংলাদেশ উপেক্ষা করতে সক্ষম। এর সম্পূর্ণ কৃতিত্ব বঙ্গবন্ধু-তনয়া দেশরতœ শেখ হাসিনার। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয়, তখন বাংলাদেশের প্রায় ৬০-৭০ শতাংশ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল, ২০ শতাংশ লোক ছিল চরম দারিদ্র্যক্লিষ্ট। প্রায় ৭০ শতাংশ লোক ছিল কৃষিজীবী। বাংলাদেশের এই অর্থনৈতিক চিত্র আজ আর নেই, তা সম্পূর্ণ রূপান্তরিত। আগেই উল্লেখ করেছি, বাংলাদেশের কৃষি ছিল অনুন্নত। কৃষিপণ্য, খাদ্যদ্রব্যের জন্য বাংলাদেশকে পাত্র নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দ্বারস্থ হতে হতো। বাংলাদেশের বার্ষিক বাজেট প্রণয়নের জন্য প্রতিবছর বাংলাদেশকে সাহায্যের আবেদন নিয়ে ‘প্যারিস’ এবং অন্যান্য জায়গায় ধর্ণা দিতে হতো। দেড় দশক আগেও বৈদেশিক ঋণ ছাড়া বাংলাদেশের বাজেট প্রণয়ন সম্ভব হতো না। আজ বাংলাদেশই অন্যান্য দেশকে তাদের প্রয়োজনে ঋণ দেয়। বিশ্ব আজ বিস্মিত চোখে দেখছে বাংলাদেশ আজ কত বিশাল প্রজেক্ট, মেগা প্রজেক্ট নিজ অর্থনৈতিক শক্তিতে তৈরি করছে। এক দশক আগেও আমাদের দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা বলেছিলেন, ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের অর্থনৈতিক সাহায্য ব্যতিরেকে পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব নয়। আজ আমরা নিজস্ব অর্থায়নে বিশাল পদ্মা সেতু নির্মাণ করেছি। যে খাদ্যের জন্য আমরা এক সময়ে অন্যের মুখাপেক্ষী ছিলাম, সেই খাদ্যপণ্যসমূহের ক্ষেত্রেও আজ আমরা সম্পূর্ণভাবে স্বনির্ভর। পাকিস্তানের চরম অবহেলার কারণে ১৯৭১ সালে যখন বাংলাদেশ ছিল খাদ্য আমদানিকারক একটি দেশ, তখন অনুর্বর পশ্চিম পাকিস্তান ছিল খাদ্যে স্বয়ম্ভর দেশ। ১৯৭১-এ বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি। কৃষি উৎপাদন ছিল মাত্র ১ কোটি টন। আজ বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। জনসংখ্যা বৃদ্ধি দ্বিগুণেরও বেশি হওয়ায় আজ বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদনের জন্য জমির পরিমাণও (বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণের জন্যও) বেশ খানিকটা কমে গেছে। বছরে প্রায় ১ শতাংশ করে কমছে। কিন্তু তা সত্তে¡ও বাংলাদেশে আজ কৃষিপণ্য উৎপাদন প্রায় ৪ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ৩ কোটি ৭৫ লাখ টনে পৌঁছেছে। বাংলাদেশ এখন বিভিন্ন কৃষিপণ্য রফতানিকারক দেশেও রূপান্তরিত হয়েছে। কেবল ধান নয়, সবজি উৎপাদনের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ আজ বিশ্বে ৪র্থ স্থানের অধিকারী। স্বাদু জলের মাছ উৎপাদনের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের অবস্থান ৪র্থ স্থানে। এই কৃষিবিপ্লবের মাধ্যমে বাংলাদেশকে হাসিনা সরকার কেবল এক অনন্য গৌরবের অধিকারীই করেনি, বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তাও নিশ্চিত করেছে, যেখানে আজ তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশ, উন্নয়নশীল দেশ, এমনকি অনেক উন্নত দেশও খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে শঙ্কামুক্ত নয়। ১৯৭১ সালে দেশ যখন স্বাধীন হয়- আগেই উল্লেখ করেছি এদেশে পাটশিল্প ছাড়া প্রায় কোন শিল্পই ছিল না। শিল্পে নিয়োজিত লোকসংখ্যা ছিল নয় শতাংশের নিচে। দেড় দশক আগেও বাংলাদেশে নির্মিত শিল্পসামগ্রীর সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। শিল্পসামগ্রী তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামোই ছিল না, বিদ্যুতই ছিল না। দেড় দশক আগে বাংলাদেশে বিদ্যুত উৎপাদনের পরিমাণ ছিল মাত্র ৩৪০০ মেগাওয়াট। বর্তমানে তা ২৫ হাজার ২৩৫ মেগাওয়াট। ভাবতে অবাক লাগে, যেখানে বারো বছর আগে বিদ্যুত কেন্দ্রের সংখ্যা ছিল মাত্র ২৭টি, সেখানে বর্তমানে বিদ্যুত কেন্দ্রের সংখ্যা ১৪৬টি। এই বিদ্যুতায়নের ফলে আজকের বাংলাদেশের গ্রামে, এমনকি প্রত্যন্ত গ্রামেও বিদ্যুত পৌঁছে গেছে। শতভাগ বিদ্যুতায়িত হয়েছে দেশ। বিদ্যুত প্রাপ্তির সহজলভ্যতায় গ্রামবাসী আজ নগরজীবনের বহু সুবিধাই ভোগ করতে সক্ষম হচ্ছে। টেলিভিশন, মোবাইল, ইন্টারনেট ইত্যাদির মাধ্যমে রাতভর কর্মপ্রবাহ এবং আনন্দ উপভোগ তাদের কাছে সহজলভ্য হয়েছে। সোভিয়েত বিপ্লবের পর সোভিয়েত ইউনিয়নকে দারিদ্র্যমুক্ত করতে দ্রæত উন্নয়নের পথে নিয়ে যেতে লেনিন দুটো বিষয়ের ওপর, মাধ্যমের ওপর জোর দিয়েছিলেন, একটি বিদ্যুত, অপরটি শিক্ষা। তিনি যথার্থই উপলব্ধি করেছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করতে হলে, দ্রæত শিল্পায়িত করতে হলে বিদ্যুতই মাধ্যম। বঙ্গবন্ধু-তনয়া শেখ হাসিনাও তাঁর প্রজ্ঞার আলোকেই উপলব্ধি করেছেন বাংলাদেশকে অতি দ্রæত বিদ্যুতায়িত করতে হবে। এই বিদ্যুতায়নের ফলে, বাংলাদেশে আজ নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব শিল্পই গড়ে উঠেছে। রেডিমেড গার্মেন্টস শিল্প (বিশ্বে এই শিল্পে বাংলাদেশের অবদান এখন তৃতীয়) ছাড়াও বাংলাদেশ এখন ঔষধ, সিরামিক, প্লাস্টিক, ছোট ছোট জাহাজ ইত্যাদি বহু সামগ্রী সারা বিশ্বে রফতানি করে। বাংলাদেশ এখন আর কৃষিসর্বস্ব দেশ নয়। দেশীয় উৎপাদনে উন্নত দেশের মতো বাংলাদেশে এখন শিল্প খাত ও সেবা খাতের অবদান কৃষি খাত থেকে অনেক বেশি, যদিও এখনও কৃষি খাতে নিয়োজিত লোকের সংখ্যা এই দুই খাত থেকে তুলনামূলকভাবে বেশি। একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বে নগরবাসীর সংখ্যা গ্রামবাসীর থেকে বেড়ে গেছে, যদিও এই উপমহাদেশে এখনও তা ঘটেনি, এখনও গ্রামবাসীর সংখ্যাই অধিক। কিন্তু দ্রæত এই তারতম্য তিরোহিত হচ্ছে। আজ বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রেই উন্নত বিশ্বের মুখ্য অবদানগুলোর অংশীদার, ৪র্থ শিল্পবিপ্লবের অংশীদার, প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিপ্লবকে অতিক্রম করে ৪র্থ বিপ্লবেরও দ্বারপ্রান্তে। এক যুগে আগে শেখ হাসিনা সরকার বাংলাদেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশে রূপান্তরের উদ্যোগ গ্রহণ করে। তার ফলে, আজ মোবাইল ব্যবহারকারী বাংলাদেশীর সংখ্যা প্রায় ১৩ কোটি অতিক্রম করেছে। ইন্টারনেটের ব্যবহার আজ প্রত্যন্ত গ্রামেও পৌঁছে গেছে। ১৫ বছর আগে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইন্টারনেট সেবা, অনলাইন সেবা জনগণের কল্পনারও বাইরে ছিল। তখন একটি মোবাইল ফোন পেতে ১ লাখ টাকা খরচ করতে হতো, এখন তা একজন কৃষিশ্রমিক বা শিল্পশ্রমিকের কাছেও সহজলভ্য। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ইন্টারনেটের যে বহুমুখী বিস্তৃতি ঘটেছে, সহজলভ্য হয়েছে, তা ভারত, পাকিস্তান, সিংহলের মতো দেশেও হয়নি। শিক্ষার ক্ষেত্রেও আজ আর বাংলাদেশ ১৯৭১ সালের মতো পিছিয়ে নেই। সেই সময়ে শিক্ষার প্রায় সবক্ষেত্রে বাংলাদেশ ছিল একটি অতি অনগ্রসর দেশ। ১৯৭১ সালে যেখানে প্রায় ৫০ শতাংশ লোক অক্ষরজ্ঞানবর্জিত ছিল, সেই সংখ্যা আজ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে এসেছে। প্রায় ৭০ শতাংশ লোক এখন অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন। ৮০-৯০ শতাংশ শিশু প্রাথমিক শিক্ষার আওতাভুক্ত। বঙ্গবন্ধুই তাঁর শাসনামলে মেয়েদের জন্য ৫ বছর পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করেছিলেন। বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষা সবার জন্যই বাধ্যতামূলক। শিশুদের স্কুলে পাঠানোর জন্য বিরাটভাবে উপবৃত্তির প্রচলন করা হয়েছে। প্রত্যেক মায়ের মোবাইল নাম্বারে এই উপবৃত্তি পৌঁছে দেয়া হয়। বছরের পয়লা জানুয়ারি ৩৫ কোটি বই শিক্ষার্থীদের কাছে বিনামূল্যে পৌঁছে দেয়া হয়। বছরের প্রারম্ভে প্রায় কয়েক কোটি শিক্ষার্থীকে এভাবে বই বিতরণ সারা বিশ্বেই একটি অনন্য উদাহরণ। কোন দেশই শিক্ষাকে এভাবে এগিয়ে নেয়ার জন্য এ ধরনের বিশাল উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। ১৯৩০-এর দশকে রবীন্দ্রনাথ রাশিয়া ভ্রমণে গিয়ে ‘রাশিয়ার চিঠি’তে লিখেছিলেন, ‘আমি শিক্ষার পুণ্যভ‚মিতে এসেছি’। আজকে বাংলাদেশকেও শিক্ষার পুণ্যভূমি হিসেবে বিবেচনা করা চলে, শিক্ষাকে প্রায় প্রতিটি শিশুর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেয়ার প্রচেষ্টার কারণে। এই উদ্যোগে হয়ত এখনও অনেক ত্রæটি রয়েছে। তবুও অনস্বীকার্য এটি একটি বিশাল ও মহৎ উদ্যোগ। ॥ পাঁচ ॥ ২০১৯ সালের মার্চ মাস থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় দু’বছরের বেশি সময়ব্যাপী এক বিরাট মহামারী সারা বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছে, অর্ধকোটির বেশি লোকের জীবনহানি ঘটিয়েছে। বাংলাদেশেও প্রায় ২৫ হাজার লোকের জীবনহানি ঘটেছে। তবুও বলা চলে, শেখ হাসিনা সরকার বিচক্ষণতার সঙ্গে এই অতিমারীর প্রকোপ থেকে বাংলাদেশের জনগণকে রক্ষায় সচেষ্ট ছিল, সচেষ্ট রয়েছে। এই অতিমারী বা কোভিড-১৯ পেন্ডেমিক সারা বিশ্বের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করেছে। বহু দেশের অর্থনীতি কেবল স্তব্ধই হয়নি, তাদের উন্নয়নে প্রবৃদ্ধির বদলে বিশালভাবে সঙ্কোচন ঘটেছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশসমূহ, ভারত, ইন্দোনেশিয়া ইত্যাদি অনেক দেশেরই অর্থনৈতিক সঙ্কোচন উল্লেখযোগ্য। জনগণের জীবনমানে বিরাট আঘাত এসেছে। বাংলাদেশের মানুষ যে অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে সম্পূর্ণ রক্ষা পেয়েছে তা নয়; কিন্তু এদেশে জীবনহানি ও অর্থনৈতিক আঘাত অন্যান্য দেশের মতো তীব্র নয়। এই সরকারের সবচেয়ে বড় সাফল্য এখানেই যে, তারা এই মহামারীর মধ্যেও অর্থনীতির চাকাকে সচল রেখেছে, প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের ওপরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। গত একদশকে উন্নয়নের মহাসোপানে তোলার জন্য যে বিরাট উদ্যোগগুলো গ্রহণ করা হয়েছে, হাসিনা সরকার সেগুলোকে কেবল চলমানই রাখেনি, যথেষ্ট এগিয়ে নিতেও পেরেছে। উল্লেখ্য, বিশাল পদ্মা সেতুর কাজ এগিয়েছে ৯৪.২৫ শতাংশ, বহুল প্রত্যাশিত মেট্রোরেল প্রকল্পের অগ্রগতি হয়েছে ৪৩ শতাংশ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রের সার্বিক অগ্রগতি হয়েছে ৩৭.২৯ শতাংশ, মাতারবাড়ি বিদ্যুত কেন্দ্রের অগ্রগতি হয়েছে ৪৮.৫৩ শতাংশ, রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্রের অগ্রগতি হয়েছে ৬৮.৮৫ শতাংশ এবং দোহাজারী-ঘুমধুম ডুয়েলগেজ ট্র্যাক প্রকল্পের অগ্রগতি হয়েছে ৬১ শতাংশ। এছাড়াও কর্ণফুলী নদীর তলদেশে তৈরি হচ্ছে কর্ণফুলী টানেল-বঙ্গবন্ধু টানেল, এই টানেলও সমাপ্তির পথে বহুদূর এগিয়েছে। এই উপমহাদেশে নদীর তলদেশে এ ধরনের কোন টানেল ইতিপূর্বে নির্মিত হয়নি, এটিই প্রথম। এইসব মেগাপ্রকল্পের সঙ্গে তৈরি হচ্ছে এক শ’ অর্থনৈতিক জোন। মীরসরাই অর্থনৈতিক জোনে এরই মধ্যে বহু বিদেশী কর্পোরেশন ও দেশী উদ্যোক্তা বড় ধরনের বিনিয়োগের প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে এসেছে। দেশরতœ শেখ হাসিনার এসব মেগা প্রকল্প যখন শেষ হবে, তখন বাংলাদেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের যে ভিত্তিভূমি তৈরি হবে, তা বাংলাদেশকে ২০৪১ সালের মধ্যেই একটি উন্নত দেশে রূপান্তরিত করবে। গত এক দশকে দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের অগ্রগতি যে অভাবিত ও তুলনাহীন তা এই উপমহাদশের দুটি বৃহত্তর দেশ, খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধতর দেশ পাকিস্তান ও ভারতের সঙ্গে তুলনা করলেই বোঝা যাবে। বর্তমানে (২০২১) বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় যখন ২২২৭ ডলার, তখন পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় মাত্র ১৫৪৩ ডলার, বাংলাদেশ থেকে ৪৫ শতাংশ কম, কিন্তু এই পাকিস্তানেরই (পশ্চিম পাকিস্তান) মাথাপিছু আয় ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ (পূর্ব পাকিস্তান) থেকে ৭০ শতাংশ বেশি ছিল। বাংলাদেশ মাথাপিছু উন্নয়নে এ বছর ভারতকেও পেছনে ফেলেছে; ভারতের মাথাপিছু আয় ১৯৪৭ ডলার। কেবল মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রেই নয় মানব উন্নয়নের প্রায় সব সূচকেই বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে এগিয়ে রয়েছে, ভারত থেকেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু যে দেশটিকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন, যে দেশটি তখন বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোর একটি ছিল, সেই দেশটিকে আজ তাঁর তনয়া তাঁর আজন্ম-লালিত স্বপ্ন ‘সোনার বাংলায়’, ক্ষুধামুক্ত-দারিদ্রমুক্ত-স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও সংস্কৃতি-ঋদ্ধ মানবিক দেশে রূপান্তরিত করার স্বর্ণসোপানে নিয়ে গেছেন। ভবিষ্যত প্রজন্মের হাতেই আজ অর্পিত জাতির জনকের স্বপ্নকে এবং তাঁর কন্যার মহাপ্রয়াসকে পূর্ণতা দেয়ার ভার।
×