ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

তিন মাস পরও ডাক্তার লিপি হত্যার কোন ক্লু খুঁজে পাওয়া যায়নি

প্রকাশিত: ২১:৪৭, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২১

তিন মাস পরও ডাক্তার লিপি হত্যার কোন ক্লু খুঁজে পাওয়া যায়নি

শংকর কুমার দে ॥ রাজধানীর কলাবাগানে ডাক্তার কাজী সাবিরা রহমান ওরফে লিপিকে গলা কেটে খুনের পর আগুনে পোড়ানোর তিন মাস পরও এর রহস্য উদঘাটন হয়নি। এমনকি চাঞ্চল্যকর এই খুনের ঘটনার তিন মাস পরও আজ পর্যন্ত ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পায়নি তদন্ত কর্তৃপক্ষ। তাছাড়া এই হত্যাকা-ের কারণ কী, কারা জড়িত তারও ক্লু খুঁজে পাওয়া যায়নি। এমনকি লিপিকে কীভাবে হত্যা করা হয়েছে, হত্যাকারীরা কীভাবে তার লাশ পোড়ানোর কাজটি করেছে ইত্যাদি বিষয়ে কোন স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়নি। খোদ রাজধানীতে একজন মহিলা ডাক্তার খুন হওয়ার তিন মাস পরেও নেপথ্য কাহিনী খুঁজে না পাওয়ার ঘটনাটিতে খুনের রহস্য ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ খবর জানা গেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রায় তিন মাস আগে রাজধানীর কলাবাগানে ডাক্তার লিপি খুন হওয়ার পর মামলাটির তদন্ত করে পুলিশ। এরপর তদন্তভার দেয়া হয় গোয়েন্দা সংস্থাকে। সর্বশেষ তদন্তভার পায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনে (পিবিআই)। রাজধানীর কলাবাগানে ফ্ল্যাটের মেঝেতে পড়েছিল চিকিৎসক কাজী সাবেরা রহমান লিপির (৪৭) নিথর মরদেহ। ভেতর থেকে বের হচ্ছিল ধোঁয়া। সোমবার সকালে ধোঁয়া দেখে বাসায় আগুন লেগেছে ভেবে প্রতিবেশীরা ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেন। খবর পেয়ে পুলিশও যায় ঘটনাস্থলে। লাশ উদ্ধারের পর দেখা যায়, ওই নারীর গলায় ধারালো অস্ত্রের গভীর ক্ষত। পিঠেও রয়েছে আঘাতের চিহ্ন। পুলিশের ধারণা, তাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। এরপর ঘটনা ভিন্নদিকে নিতে ঘরে আগুন দেয়া হয়। পুলিশ সাবলেট নেয়া বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কানিজ ফাতেমা, তার এক বন্ধু, বাড়ির এক দারোয়ান ও গৃহকর্মীসহ অর্ধশতাধিক জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। গত তিন মাসে এই খুনের রহস্য উদঘাটনের জন্য তিন তদন্ত সংস্থার হাত বদল হয়েছে। লিপির ফ্ল্যাটে সাবলেটে থাকা কানিজ সুবর্ণা, বাড়ির নিরাপত্তা প্রহরী, গৃহকর্মী, ভবনের বাসিন্দা ও লিপির সহকর্মী, স্বজনসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। কিন্তু গত তিন মাসেও খুনের রহস্য উদঘাটন হয়নি। লিপি গ্রিনলাইফ হাসপাতালের রেডিওলজি বিভাগের চিকিৎসক ছিলেন। কলাবাগানের প্রথম লেনের ৫০/১ নম্বর বাড়ির তৃতীয় তলার ফ্ল্যাটটি ভাড়া নিয়েছিলেন তিনি। তবে এর দুটি কক্ষই সাবলেট দিয়েছিলেন। একটি বেসরকারী ব্যাংকের কর্মকর্তা স্বামীর সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় ৯ বছরের মেয়েকে নিয়েই এক কক্ষে থাকতেন তিনি। কিন্তু রবিবার মেয়েকে তিনি গ্রিন রোডে নানার বাসায় রেখে এসেছিলেন। গত ৩০ মে সকালে কলাবাগান প্রথম লেনের তৃতীয় তলার ফ্ল্যাটে শোবার ঘর থেকে চিকিৎসক লিপির রক্তাক্ত ও পোড়া মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। চিকিৎসক কাজী সাবিরা রহমান ওরফে লিপি হত্যার পর তিন মাসের বেশি সময় পেরিয়েছে। তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে ধারালো অস্ত্রের আঘাত ও পোড়া দাগ ছিল। লিপি হত্যাকা-ের কারণ কী, কারা জড়িত এখন পর্যন্ত এসব প্রশ্নের জবাব মেলাতে পারেননি পুলিশ, ডিবি, পিবিআই এর তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। ঘটনাস্থলে উপস্থিত ডাঃ লিপির মামাতো ভাই রেজাউল হাসান বলেছেন, এক চিকিৎসকের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল। ওই সংসারে ১২ বছর বয়সী এক সন্তান রয়েছে। কয়েকবছর আগে চিকিৎসক স্বামী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলে তিনি ব্যাংক কর্মকর্তা শামসুদ্দিন আজাদকে বিয়ে করেন। এ সংসারেও ৯ বছর বয়সী মেয়ে সন্তান রয়েছে। তবে স্বামীর সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হওয়ায় লিপি তার মেয়েকে নিয়ে ফ্ল্যাটটিতে থাকতেন। ঘটনা শুনে বাসায় এসেছিলেন শামসুদ্দিন আজাদও। তিনি বলেছেন, এটি একটি হত্যাকা-। বিষয়টি অন্যদিকে ডাইভার্ট করার জন্য আগুনের ঘটনা সাজানো হয়েছে। কেন এমন হলো, বুঝতে পারছি না। তদন্তের পর পুলিশ বিস্তারিত বলতে পারবে বলে আশা করি। ওই ফ্ল্যাটে সাবলেট থাকা কানিজ ফাতেমা পুলিশকে জানিয়েছেন, সকালে তিনি হাঁটতে বের হয়েছিলেন। হেঁটে আসার পর বাসায় ফিরে দেখেন ডাঃ লিপির রুম বন্ধ। ভেতর থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে তিনি আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। সঙ্গে সঙ্গেই দারোয়ানকে ডেকে চাবি এনে রুমের তালা খুলে দেখতে পান, চিকিৎসক সাবেরা ফ্লোরে পড়ে আছেন। তখন ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেয়া হয়। সবাই ভেবেছিলেন, তিনি আগুনে পুড়ে মারা গেছেন। আতঙ্কে তিনি তার বন্ধুকেও খবর দেন। সিআইডির ক্রাইম সিনের এক সদস্য জানান, তাদের মনে হয়েছে, এটি পরিকল্পিত হত্যাকা-। ধারালো অস্ত্র দিয়ে ওই চিকিৎসকের শ্বাসনালি কেটে ফেলা হয়েছে। তাছাড়া গলা ও পায়ের সামান্য অংশ দগ্ধ ছিল। আলামত দেখে মনে হয়েছে, রবিবার মধ্যরাতের পর এ হত্যাকা- ঘটেছে। ফায়ার সার্ভিসের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষের কর্মকর্তা জানান, কলাবাগানের বাসাটিতে আগুন লাগার খবর পান তারা। সেখানে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ধোঁয়া দেখতে পেয়েছিল। ওই কক্ষ থেকে নারীর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনে (পিবিআই) এর একজন কর্মকর্তা বলেছেন, গত ২২ আগস্ট মামলাটির তদন্তভার পেয়েছে পিবিআই। প্রথম তদন্ত সংস্থা কলাবাগান থানা পুলিশের কাছ থেকে সব ধরনের ডকুমেন্ট থানা থেকে পাওয়া গেছে। এর আগে এই খুনের ঘটনার তদন্ত করেছে ডিবি। এখন তদন্ত করছে পিবিআই। এখনও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া গেলে খুনের রহস্য উদঘাটনের বিষয়টি খুবই সহজ হবে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা সংস্থার (ডিবি) একজন কর্মকর্তা জানান, চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকা-ের শুরু থেকে থানা পুলিশের সঙ্গে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ছায়া তদন্ত করে। লিপির ফ্ল্যাটে সাবলেটে থাকা কানিজ সুবর্ণা, বাড়ির নিরাপত্তা প্রহরী, গৃহকর্মী, ভবনের বাসিন্দা ও লিপির সহকর্মী, স্বজনসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তিকে বিভিন্ন সময়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। লিপির সঙ্গে পরিবার বা কর্মস্থলে কারও বিরোধ ছিল কি না, তা বেরিয়ে আসবে বলে তদন্ত সংশ্লিষ্টদের আশা ছিল। হত্যাকান্ডের পেছনে কাজ করতে পারে বলে সন্দেহ করা হচ্ছিল। তবে, সে রকম কোন তথ্য দিতে পারেননি তার স্বজন কিংবা সহকর্মীরা। কলাবাগান পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, হত্যাকান্ডের শিকার ওই চিকিৎসকের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনের ফরেনসিক পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু সেখানেও হত্যার কোন আলামত পাওয়া যায়নি। পাশাপাশি কললিস্টের সূত্র ধরে বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। নানা বিষয়ে জেরা করা হলেও হত্যাকান্ডের সঙ্গে তাদের কারও সংশ্লিষ্টতা আছে, এ রকম সন্দেহজনক কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। হত্যার কারণ বা খুনীদের বের করা যাবে এমন ক্লু খুঁজে পাওয়া যায়নি।
×