স্টাফ রিপোর্টার ॥ পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আন্দোলনসহ রাজনৈতিক কৌশল ঠিক করতে কেন্দ্রীয় নেতাদের মতামত নেয়া শুরু করেছে বিএনপি। প্রথম দিন মঙ্গলবার বিকেলে বিএনপি চেয়ারপার্সনের গুলশান কার্যালয়ে ভাইস চেয়ারম্যান ও উপদেষ্টাদের নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছেন দলীয় হাইকমান্ড। এ সময় বক্তব্য রাখতে গিয়ে অধিকাংশ নেতাই দল গুছিয়ে আন্দোলনে যাওয়ার পক্ষে মত দেন।
শুরুতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বৈঠকে অংশ নেয়া নেতাদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখেন। এ সময় তিনি পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বর্তমান পরিস্থিতিতে বিএনপির কি করা উচিত, আর আন্দোলন করতে হলে এর রূপরেখা কেমন হওয়া উচিত, সর্বস্তরে দলকে শক্তিশালী করতে কি কি করা প্রয়োজন এবং চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে কিভাবে মুক্ত করা যায় সেসব বিষয়ে নির্বাহী কমিটির নেতাদের মতামত দিতে বলেন। পরে এক এক করে বেশ ক’জন তাদের মতামত তুলে ধরেন। তাদের মধ্যে বেশিরভাগ নেতাই অবিলম্বে দলের জাতীয় কাউন্সিল করে নতুন নির্বাহী কমিটি গঠনসহ সর্বস্তরে দল গুছিয়ে নতুন উদ্যমে আন্দোলন করার প্রস্তাব করেন। আন্দোলন করে রাজপথে শক্তি সঞ্চয় করে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি জোরদার করার কথাও বলেন তারা। এ ছাড়া কিভাবে দলের নেতাকর্মীদের মামলা থেকে মুক্ত করে সাংগঠনিক কার্যক্রম আরও জোরদার করা হয় সেদিকে নজর দিতে হাইকমান্ডের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
বৈঠকে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত ছিলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এ ছাড়া মঞ্চে ছিলেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু। স্থায়ী কমিটির সদস্যদের মধ্যে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের শিলংয়ে রয়েছেন স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ। আর দল থেকে পদত্যাগ করেছেন লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান। মারা গেছেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, তরিকুল ইসলাম, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহ। বর্তমানে অসুস্থ ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া।
বৈঠকে ভাইস চেয়ারম্যান ও চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা মিলে ৬২ জন অংশ নেন। ভাইস চেয়ারম্যানদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, নিতাই রায় চৌধুরী, মাহমুদুল হাসান, মীর নাসির উদ্দিন, বরকত উল্লাহ বুলু, আব্দুল আউয়াল মিন্টু, শামসুজ্জামান দুদু, শওকত মাহমুদ, জয়নাল আবেদীন প্রমুখ। ৩৫ জন ভাইস চেয়ারম্যানের মধ্যে সেলিমা রহমান ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু পরে স্থায়ী কমিটির সদস্য হয়েছেন। অন্য ভাইস চেয়ারম্যানদের মধ্যে ২০১৮ সালের ১৯ ডিসেম্বর ইনাম আহমেদ চৌধুরী আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। ২০১৯ সালের নবেম্বরে দল থেকে পদত্যাগ করে এখন বিদেশে অবস্থান করছেন এম মোরশেদ খান। মোসাদ্দেক আলী ফালুও রয়েছেন দেশের বাইরে। আর বিভিন্ন মামলার আসামি হয়ে পলাতক রয়েছেন শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ। কারাগারে রয়েছেন আবদুস সালাম পিন্টু। গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন এ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন। মারা গেছেন সাদেক হোসেন খোকা, চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ ও ব্যারিস্টার আমিনুল হক।
বৈঠকে বিএনপি চেয়ারপার্সনের ৭৪ জন উপদেষ্টার মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, আমান উল্লাহ আমান, আবদুস সালাম, হাবিবুর রহমান হাবিব, মিজানুর রহমান মিনু, মনিরুল হক চৌধুরী, এ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার, মশিউর রহমান, লুৎফর রহমান খান আজাদ, আবুল খায়ের ভুঁইয়া, ফজলুর রহমান, অধ্যাপক সুকোমল বড়ুয়া, আফরোজা খানম রীতা অধ্যাপক তাজমেরী এস ইসলাম, ইসমাইল জবিউল্লাহ, গোলাম আকবর খন্দকার, অধ্যাপক শাহেদা রফিক, আতাউর রহমান ঢালী, গাজী মাজহারুল আনোয়ার, হেলালুজ্জামান তালুকদার লালু, নজমূল হক নান্নু, শাহজাহান মিয়া, আবদুল কাইয়ুম, আবদুল লতিফ, খন্দকার মুক্তাদির আহমেদ, এসএম ফজলুল হক, আবদুল হাই, ভিপি জয়নাল আবেদীন, একরামুজ্জামান, মইনুল ইসলাম শান্ত, মাহবুবুর রহমান, বোরহান উদ্দিন, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম, অধ্যাপক আব্দুল কুদ্দুস, আবদুল হাই শিকদার, তাহসিনা রুশদীর লুনা প্রমুখ। উপদেষ্টাদের মধ্যে মারা গেছেন হারুনুর রশীদ খান মুন্নু, ফজলুর রহমান পটল, ফজলুল হক আসপিয়া, কাজী আসাদ ও সঞ্জীব চৌধুরী।
বৈঠকের কার্যবিবরণী লেখাসহ বিভিন্ন দাফতরিক কাজে সহযোগিতার জন্য উপস্থিত ছিলেন বিএনপির দফতরের দায়িত্বে নিয়োজিত সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, সহ-দফতর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু, মুনির হোসেন, বেলাল আহমেদ ও বিএনপি চেয়ারপার্সনের এপিএস এবিএম আবদুস সাত্তার ও গুলশান কার্যালয়ের দাফতরিক কাজে নিয়োজিত রিয়াজ উদ্দিন নসু।
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ বিএনপির জাতীয় কাউন্সিলের পর খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে গঠিত হয় ৫৯২ সদস্যের নির্বাহী কমিটি। এ কমিটিতে ৩৫ জন ভাইস চেয়ারম্যান রয়েছেন। এ ছাড়া চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা রয়েছেন ৭৪ জন। মঙ্গলবারের বৈঠকে উপস্থিতি ছিলেন ১০৯ জনের মধ্যে ৬২ জন।
আজ বুধবার দ্বিতীয় দিনের বৈঠক হবে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব, যুগ্ম মহাসচিব, সাংগঠনিক সম্পাদক, সম্পাদক ও সহ-সম্পাদকদের নিয়ে। বর্তমানে দলটির নির্বাহী কমিটিতে ১ জন সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব, ৭ জন যুগ্ম মহাসচিব, ১০ জন সাংগঠনিক সম্পাদক এবং বিভিন্ন সম্পাদক পদে রয়েছেন ১৬১ জন।
আগামীকাল বৃহস্পতিবার তৃতীয় দিনে বিএনপির ১১টি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। প্রথম দিনের মতো দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিনের বৈঠকেও লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি সভাপতিত্ব করবেন তারেক রহমান। এছাড়া মঞ্চে থাকবেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যরা। এর আগে বিএনপির নির্বাহী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া কারাবন্দী হওয়ার ৫ দিন আগে ২০১৮ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি। তখন নির্বাহী কমিটির সকল সদস্যকে নিয়ে পূর্ণাঙ্গ নির্বাহী কমিটির বৈঠক হলেও এবার হচ্ছে ধাপে ধাপে। এ ছাড়া এবার নির্বাহী কমিটির সদস্য পদে থাকা ৩৬৫ জন সদস্যকে বৈঠকে ডাকা হয়নি। তবে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে করোনা পরিস্থিতির কারণে এভাবে ধাপে ধাপে বৈঠক করা হচ্ছে।
প্রেস ব্রিফিং ॥ এদিকে মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৮টায় বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির উত্তরণে দলের করণীয় সম্পর্কে সিনিয়র নেতাদের মতামত নিয়েছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। আজকের সভায় দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও দলের সাংগঠনিক অবস্থা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। উপস্থিত ৬২ জনের মধ্যে ২৮ জন বক্তব্য রাখেন। এর বেশি কিছু এখন বলার নেই। তবে ৩ দিনের বৈঠক শেষে বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমকে বিস্তারিত জানানো হবে।
ফখরুল বলেন, বৈঠকে অধিকাংশ নেতা বলেছেন, বর্তমান সরকারের অধীনে কোন নির্বাচন নয়। এছাড়া তারা নিরপেক্ষ ব্যক্তি নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার এবং নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন এবং দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে এবং আন্দোলন জোরদার করার পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেন। কেউ কেউ দলের অঙ্গসংগঠনগুলো বিশেষ করে যুব দল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্র দলকে আন্দোলনমুখী করার জন্য পুনর্গঠনের কথা বলেন।