ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

লাফিয়ে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগী ॥ শিশুরা বেশি আক্রান্ত

প্রকাশিত: ২২:১১, ১ আগস্ট ২০২১

লাফিয়ে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগী ॥ শিশুরা বেশি আক্রান্ত

শরীফুল ইসলাম ॥ দেশে ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদফতর ও সিটি কর্পোরেশনগুলোর অবিরাম চেষ্টার পরও সর্বস্তরের মানুষের সচেতনতার অভাবে এখন পর্যন্ত সফলতা আসেনি। তাই প্রতিদিনই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। আর আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে শিশুর সংখ্যাই বেশি। এর ফলে ডেঙ্গু এখন জনমনে আশঙ্কা বাড়াচ্ছে। কীটতত্ত্ববিদদের মতে, এবার ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশার বংশ বিস্তারের জন্য পরিবেশ অনুকূলে থাকায় এ রোগের প্রকোপও বেশি। ম্যালেরিয়া রোগের ক্ষেত্রে সাধারণ মশা যেখানে একজনের বেশি মানুষের দেহে রোগ সৃষ্টি করতে পারে না, সেখানে একটি এডিস মশা ৮ থেকে ১২ জন মানুষের দেহে আক্রমণ করে ডেঙ্গু রোগের সৃষ্টি করতে পারে। তাই এবার এডিস মশার সংখ্যা বেশি হওয়ায় কারণে দেশে ডেঙ্গু রোগের প্রকোপও বেশি। কীটতত্ত্ববিদদের গবেষণালব্ধ তথ্য থেকে জানা যায়, ডেঙ্গু মশার বংশ বিস্তারের জন্য যেখানে জীবন চক্র ১২ দিনের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা সেখানে এখন পরিবেশ অনুকূলে থাকায় ৭ থেকে ৮ দিনের মধ্যেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে দ্রুত এডিস মশার বংশ বিস্তার হওয়ায় ডেঙ্গু রোগের প্রকোপও দ্রুতই বাড়ছে। একদিকে তাপমাত্রা বেশি ও অন্যদিকে ঘন ঘন বৃষ্টি হওয়ায় এডিস মশার বংশ বিস্তার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে সময় কম লাগছে। বৃষ্টি বা অন্য কোন উপায়ে যে কোন স্থানে জমে থাকা স্বচ্ছ পানিতে এডিস মশা ডিম পাড়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে লার্ভা পর্যায়ের সৃষ্টি হয়। ৪ থেকে ৬ দিনের মধ্যে লার্ভা থেকে পিউপা পর্যায়ে যায় এবং পিউপা থেকে ১ দিনের মধ্যেই এডিস মশা উড়তে পারে এবং পূর্ণাঙ্গ মশা হিসেবে বিচরণ করে। এদিকে শনিবার দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৯৬ জন। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্র্তি রোগীর সংখ্যা সর্বমোট ২ হাজার ৬৫৮ জন। আগের বছর দেশে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে সর্বমোট হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ১ হাজার ৪০৫ জন। আর এবার আরও এক সপ্তাহ আগেই ২০২০ সালের ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা অতিক্রম করে ফেলেছে। আর অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগের মৌসুম হওয়ায় শেষ পর্যন্ত এবার যে রোগীর সংখ্যা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তাই ডেঙ্গু নিয়ে এবার দেশের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী তাজুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় বিরামহীনভাবে কাজ করে যাচ্ছে। মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হচ্ছে। সিটি কর্পোরেশনগুলোর মেয়ররাও ডেঙ্গুর বাহক এডিস মসা নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে। তারা জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্যও কাজ করে যাচ্ছে। বর্তমানে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। তাই এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ কমিয়ে আনতে সর্বস্তরের জনগণেরও সহযোগিতা লাগবে। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক ও মুখপাত্র অধ্যাপক ডাঃ নাজমুল ইসলাম জনকণ্ঠকে জানান, ডেঙ্গু মোকাবেলায় স্বাস্থ্য অধিদফতর নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এ রোগের প্রকোপ যাতে কমে আসে সে জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। এ ছাড়া স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও সিটি কর্পোরেশনগুলোও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন কর্মসূচী হাতে নিয়েছে। ডেঙ্গু রোগের সুচিকিৎসার জন্য ইতোমধ্যেই ৫ হাসপাতালকে বিশেষায়িত হাসপাতাল হিসেবে রাখা হয়েছে। এ ছাড়াও সারাদেশের সকল হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে চিরুনি অভিযান চালাচ্ছে। কীটতত্ত্ববিদরা ডেঙ্গু নিয়ে জরিপ করছে। আর সেই জরিপ রিপোর্ট অনুসারে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। সার্বিকভাবে ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ন্ত্রণ ও রোগীরা যাতে সঠিক চিকিৎসা পান সে জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে মনিটরিং করা হচ্ছে। প্রতিদিনই কোথায় কি অবস্থা খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে এবং ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে আপডেট দেয়া হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদফতর সার্বক্ষণিকভাবেই কাজ করে যাচ্ছে। তবে শুধু স্বাস্থ্য অধিদফতর বা সিটি কর্পোরেশনগুলো তৎপর হলে চলবে না। দেশের সর্বস্তরের মানুষকে সচেতন হতে হবে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। বাড়িঘর ও আশপাশের এলাকা নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। ২০২০ সালে দেশে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ৭ জন মানুষ। আর এবার ইতোমধ্যেই ৪ জন মারা গেছে। এবার মারা যাওয়া ৫ জনের মধ্যে ৪ জনের বয়সই ৫ বছরের নিচের বয়সী শিশু। এর মধ্যে ৩ জন মারা গেছে ঢাকা শিশু হাসপাতালে। এরা হলো- ১৪ মাসের রওজা, আড়াই বছরের তুবা ও ৪ বছর বয়সী মোমিন। এ ছাড়া রাজধানীর সিটি হাসপাতালে মারা গেছে ১০ বছর বয়সী শিশু জিয়ন। ঢাকা শিশু হাসপাতালের চিকিৎসকরা ডেঙ্গু থেকে শিশুদের রক্ষা করতে কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে- প্রতিটি শিশুকে ডেঙ্গু থেকে নিরাপদ রাখতে শরীর সার্বক্ষণিক ঢেকে রাখতে হবে। তাদের মশারির ভেতর রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। এ ছাড়া শিশুদের সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে এবং জ্বর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কীটতত্ত্ববিদ ড. শেফালী বেগম জনকণ্ঠকে জানান, ডেঙ্গু রোগ হয় এডিস মশার আক্রমণে। বাসাবাড়িতে বিভিন্নভাবে জমে থাকা স্বচ্ছ পানি বা আশপাশে জমে থাকা বৃষ্টির পানিতে এডিস মশা ডিম পাড়ে। এই ডিম থেকে হয় লার্ভা। আর এই লার্ভাগুলো পূর্ণাঙ্গ মশা হওয়ার পর মানুষের দেহে ডেঙ্গু রোগ ছড়ায়। যতই কীটনাশক স্পে করা হোক না কেন এভাবে এডিস মশা নিধন করা সম্ভব নয়। তাই বাসাবাড়ি ও আশপাশের এলাকা সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। কোথাও পানি জমতে দেয়া যাবে না। ফুলের টব বা ডাবের খোসাসহ কোন কিছুতেই যাতে পানি জমে থাকতে না পারে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। আর শুধু সরকার, স্বাস্থ্য অধিদফতর কিংবা সিটি কর্পোরেশনের দিকে তাকিয়ে থাকলে হবে না। যার যার অবস্থানে থেকে মশা নিধনে কাজ করতে হবে। বাসাবাড়ি ও আশপাশের এলাকা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। তিনি আরও জানান, এবার ১ থেকে ১০ বছরের শিশুদের ডেঙ্গু রোগ বেশি হচ্ছে। তাই শিশুদের শরীর সব সময় ঢাকা রাখতে হবে। তাদের ফুলহাতা জামা পড়াতে হবে। আর শিশুসহ সবাইকে ঘুমের সময় মশারি টানাতে হবে। আর ডাব খেয়ে যত্রতত্র খোসা ফেলা যাবে না। আর একদিকে পরিষ্কার, আরেকদিকে ময়লা আবর্জনা ফেলে পরিবেশ নষ্ট করা যাবে না। যদি সবাই সচেতন না হয় এডিস মশা বা ডেঙ্গু রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। স্বাস্থ্য অধিদফতরের দেয়া তথ্যানুসারে এ বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২ হাজার ৬৫৮ জন।
×