ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

তুচ্ছ অজুহাতে বের হচ্ছে মানুষ রাস্তায় যানও বেড়েছে

প্রকাশিত: ২১:৫৫, ২৬ জুলাই ২০২১

তুচ্ছ অজুহাতে বের হচ্ছে মানুষ রাস্তায় যানও বেড়েছে

আজাদ সুলায়মান ॥ চলছে রাজধানীসহ দেশব্যাপী কঠোর লকডাউন। তৃতীয় দিন রবিবার রাজধানীতে দেখা গেছে- মানুষ ও যানের সংখ্যা বাড়ছে। তুচ্ছ অজুহাতে মানুষ বের হয়ে বিচিত্র সব কা- ঘটাচ্ছে। ম্যাজিস্ট্রেট, র‌্যাব ও সেনাবাহিনীর সদস্যদের কাছে ধরা খেয়ে অনেককেই জরিমানা গুনতে হয়েছে। রবিবার দুই যুবক মাছ কেনার জন্য ধানমন্ডি থেকে কাপ্তানবাজার এসে জরিমানা দিয়েছেন ৫০০ টাকা। আরেক যুবক বিমানবন্দর থেকে একটি মোবাইল আনতে গিয়েও জরিমানা দেন। আবার মাস্ক ছাড়া বের হবার দায়েও জরিমানা গুনেছেন অনেক মানুষ। হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকার দরুন জরিমানা দিয়ে আফসোস করেন এক যুবক। রাজধানীর শাহবাগ ধানমন্ডি ও মোহাম্মদপুরে দেখা গেছে র‌্যাব, সেনাবাহিনী ও পুলিশের ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান ও চেকপোস্ট। তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন। তবে কঠোর বিধিনিষেধে জরুরী প্রয়োজনে রাজধানীর সড়কে যাতায়াতের একমাত্র বাহন রিক্সা। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে রিক্সা চালকরা যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। যাত্রীদর অভিযোগ- এবারের লকডাউনে সড়কে অন্য যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। এ অবস্থায় যাত্রীদের জিম্মি করে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছেন রিক্সা চালকরা। একশ টাকার ভাড়া চারশত টাকায় হাকা হচ্ছে। এদিন সরেজমিনে দেখা যায়, রাজধানীতে তুচ্ছ অজুহাতে বের হলেই জরিমানা ও শাস্তির মুখে পড়তে হয়েছে। জরুরী প্রয়োজন ছাড়া কেউ যানবাহন নিয়ে রাস্তায় বের হয়েছে কি না, মাস্ক পরিধানসহ প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে মানুষ রাস্তায় চলাচল করছে কি না তা কঠোরভাবে মনিটরিং করা হচ্ছে। সন্তোষজনক জবাব না পেলে যানবাহন ও ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। ঈদের ছুটি শেষে রবিবার ব্যাংক, বীমা ও শেয়ারবাজারের কার্যক্রম শুরু হওয়ায় রাস্তায় যানবাহনের সংখ্যা গত দু’দিনের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। শাহবাগ এলাকায় সকাল থেকে পুলিশের অপরাধ ও ট্রাফিক বিভাগ চেকপোস্ট বসিয়ে যানবাহন থামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। সকালে র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পলাশ কুমার বসুর নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম শুরু হয়। এ সময় শাহবাগ অভিমুখে আসা প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, জিপ, মোটরসাইকেল ও রিক্সাসহ বিভিন্ন যানবাহন থামিয়ে তাদের বাইরে বের হওয়ার কারণ জানতে চাওয়া হয়। শাহবাগ এলাকার আশপাশে কয়েকটি হাসপাতাল থাকায় অনেকেই হাসপাতালে এসেছেন বলে জানান। কেউ আবার ব্যাংক ও বীমা প্রতিষ্ঠানে কাজে যাচ্ছেন বলে জানান। ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে যারা বের হয়েছেন তারাও নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে বলে জানান। তবে কেউ কেউ জরুরী প্রয়োজনে বাইরে বের হয়েছেন বললেও এর পক্ষে প্রমাণ দেখাতে না পারায় তাদের জরিমানা করা হয়। এ বিষয়ে র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পলাশ কুমার বসু বলেন, একান্তই জরুরী ও অত্যাবশ্যক কারু ছাড়া বা বিধিনিষেধের নির্দেশনার আওতার বাইরে যারা রয়েছেন তারা শুধু বের হতে পারছেন। এর বাইরে আমরা কিন্তু চেকপোস্ট বসিয়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে জিজ্ঞাসাবাদ করছি, যাদের কারণ যথোপযুক্ত মনে হচ্ছে না তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে- জরিমানাও করা হচ্ছে। এক সিগারেটেই ৫০০ টাকা ॥ শাহবাগে বারডেম হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে মাস্ক খুলে সিগারেট খাচ্ছিলেন ফারুক আহমেদ নামের এক ব্যক্তি। বিষয়টি চোখে পড়ে পাশেই থাকা র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের। এ সময় ম্যাজিস্ট্রেট ডাক দেন ফারুককে। তাৎক্ষণিকভাবে হাত থেকে সিগারেট ফেলে দেন তিনি। হাসপাতালের সামনে ও ভ্রাম্যমাণ আদালতের পাশে দাঁড়িয়ে মাস্ক খুলে এভাবে সিগারেট ফুঁকতে থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে ফারুক জানান- তিনি বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছিলেন। বাসা থেকে বের হয়ে হাসপাতালে প্রবেশের আগে দোকান দেখে সিগারেট খেতে মন চাইলে সিগারেট ধরান। এজন্য তিনি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ক্ষমা চান। এ সময় ম্যাজিস্ট্রেট ওই ব্যক্তিকে পাঁচশত টাকা জরিমানা করেন। তিনি আফসোস প্রকাশ করে বলেন, এক সিগারেটেই নেই টাকা ৫০০। আর খাবো না হাসপাতালের সামনে। মাস্ক ছাড়া রেহাই নেই ॥ কঠোর লকডাউনের তৃতীয় দিনে কারণে-অকারণে লোকজনের বাইরে বের হওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। বিভিন্ন স্থানে চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশিও চালাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কেউ নিয়ম না মানলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। রবিবার দুপুর ১টার কিছু পরে মিরপুরের দশ নম্বর গোলচত্বরে বিজিবির তত্ত্বাবধানে মোবাইল কোর্টের কার্যক্রম শুরু হয়। এ সময় মাস্ক না পরা ও বিনা প্রয়োজনে বাইরে বের হয়ে লকডাউনের আইন অমান্য করায় ২২ জনকে জরিমানা করা হয়। তবে কত টাকা জরিমানা করা হয়েছে তা জানাননি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট খায়রুন নাহার। করোনা প্রতিরোধে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী লকডাউন বাস্তবায়নে কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কেউ আইনের ব্যত্যয় ঘটালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট সোপর্দ করছে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট খায়রুন নাহার আরও বলেন, মাস্কবিহীন কাউকেই ছাড় দেয়া হচ্ছে না। করোনা প্রতিরোধে সবাইকেই মাস্ক পরিধান করতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই। কেউ আইন অমান্য করলে জরিমানা করা হবে। দৌড়ে গিয়ে জরিমানা ৫০০ টাকা ॥ তুচ্ছ কারণে ঘরের বাইরে বের হওয়া কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। তারপরও বের হচ্ছে মানুষ। সিঙ্গাপুর থেকে শখ করে ছোট ভাইয়ের পাঠানো মোবাইল সেট আনতে গিয়ে পাঁচশত টাকা জরিমানা গুনেছেন পুরান ঢাকার নয়াবাজার এলাকার বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম। রবিবার ভোরে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সিঙ্গাপুর ফেরত ছোট ভাইয়ের এক সহকর্মীর কাছ থেকে মোবাইলটি আনতে গিয়েছিলেন তিনি। মোবাইল নিয়ে সাইফুল বিদেশ ফেরত অন্যান্য যাত্রীদের সঙ্গে ভ্যানে করে বাসায় ফিরছিলেন। শাহবাগ মোড়ে এ সময় র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পলাশ কুমার বসুর নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চলছিল। এ সময় কর্তব্যরত পুলিশ ভ্যানগাড়ি যাত্রীদের বাইরে বের হওয়ার কারণ জানতে চাইলে অধিকাংশই বলেন তারা বিদেশ ফেরত যাত্রী এবং তারা পাসপোর্ট ও টিকেট দেখান। কিন্তু তা যুক্তিযুক্ত না হওয়ায় তাকে ৫০০ টাকা জরিমানা করা হয় এবং ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক করা হয়। জবাবে সাইফুল বলেন, জরুরী না হলেও মোবাইলটি আনা আমার খুব প্রয়োজন ছিল। সাইফুল ইসলামের এমন যুক্তি শুনে সন্তুষ্ট হতে পারেননি র‌্যাবের ম্যাজিস্ট্রেট। পরে তিনি বিধিনিষেধের নিয়ম অমান্য করায় সাইফুল ইসলামকে ৫০০ টাকা অর্থদণ্ড করেন। এতে আদালতের রায় না মেনে আরেক কাণ্ড ঘটান সাইফুল ইসলাম। তিনি র‌্যাবের কর্মকর্তাদের সাফ জানিয়ে দেন ৫০০ টাকা দিতে পারবেন না। তিনি বলেন, আমি ঢাকার লোক- ঢাকা শহরে বের হতে পারব না। সব মানুষ বের হয়েছে। মোবাইল আনাটা আমার জন্য জরুরী প্রয়োজন। তখন সাইফুল ইসলামকে র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জানিয়ে দেন, জরিমানা না দিতে চাইলে একদিনের জন্য তাকে জেলে যেতে হবে। জেলে যাওয়ার কথা শুনে দৌড়ে এসে র‌্যাবের কর্মকর্তাদের কাছে আদালতের রায় অনুযায়ী ওই টাকা জরিমানা দিয়ে বাসায় ফেরেন সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, মোবাইল আনতে যাওয়ার অপরাধে তাকে আর্থিক জরিমানা গুনতে হবে এটা তিনি ভাবতেই পারেননি। কাপ্তানবাজারের মাছ ধানমন্ডিতে ॥ মাছ মাংস কমবেশি রাজধানীর সব মহল্লাতেই মিলে। কিন্তু এই করোনা মহামারীতে যেখানে কঠোর লকডাউন চলছে সেখানে ধানমন্ডি থেকে কাপ্তানবাজারে কেন মাছ কিনতে যেতে হবে। এমন প্রশ্ন রাখেন র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। দুপুরে শাহবাগ এলাকায় রিক্সায় যাওয়া দুই যুবকের কাছে এমন প্রশ্ন করেন। এ সময় তারা জানান, তারা ধানমন্ডির একটি রেস্টুরেন্টে মাছ সরবরাহ করতে যাচ্ছেন। কিন্তু এ সংক্রান্ত কোন কাগজপত্র দেখাতে পারেননি। এতে ম্যাজিস্ট্রেট তাদের জরিমানা করার নির্দেশ দেন। দুপুর ১২টার পর এ দৃশ্য চোখে পড়ে। চলমান লকডাউনের তৃতীয় দিনে শাহবাগের চেকপোস্টে ম্যাজিস্ট্রেট, র‌্যাব এবং পুলিশের উপস্থিতিতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের কঠোর মনিটরিং চলছে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পলাশ কুমার বসু উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, লকডাউন চলাকালে জরুরী প্রয়োজন ছাড়া বের হওয়া যাবে না এমন নির্দেশনা থাকলেও অনেকে বের হচ্ছেন। কাপ্তানবাজার থেকে ধানমন্ডিতে মাছ নিয়ে যাচ্ছেন। কখন বাজার খোলা থাকবে, কতক্ষণের জন্য খোলা থাকবে তা নির্দেশনায় বলা রয়েছে। জরুরী এ মুহূর্তে কাপ্তানবাজার থেকে মাছ নিয়ে কেন ধানমন্ডিতে যেতে হবে। ফুড সেলার এখন রিক্সাচালক ॥ করোনার আগে জাকির হোসেন নিউমার্কেটের একটি ফাস্ট ফুডের দোকানে সেলারের কাজ করতেন। মহামারীর দরুন সেটা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জীবিকার তাগিদে এখন তাকে লাজ লজ্জা ভেঙ্গে রিক্সার হাতল ধরতে হয়েছে। তারপরও মিলছে না খাবারের টাকা। বিশ বছর বয়সী নতুন এই রিক্সাচালক জাকিরের প্রশ্ন- কিভাবে চলব। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও যাত্রী পাইনি। এভাবে চললে তো না খায়া মরতে অইবো। তিনি জানান, আগে নিউমার্কেটের একটি ফাস্টফুডের দোকানে চাকরি করতেন। পরিশ্রম তেমন ছিল না। বেতনের পাশাপাশি কাস্টমাররা খুশি হয়ে যা দিতেন তা দিয়ে ভালই আয় হত। কিন্তু লকডাউনের কারণে মার্কেট বন্ধ থাকায় চাকরিটি আপাতত নেই। চাকরি না থাকায় বিকল্প আয়ের উৎস হিসেবে কিছুদিন ধরে রিক্সা চালাতে শুরু করেছেন। চালক হিসেবে নতুন ও পরিশ্রম বেশি হওয়ায় এক বেলা রিক্সা চালাতে পারেন। তিনি বলেন, রিক্সা চালানোর চাইতে চাকরি অনেক ভাল ছিল। কিন্তু পেটের দায়ে তাকে রিক্সা নিয়ে পথে নামতে হয়েছে। এবারের লকডাউনে গতবারের চেয়ে কড়াকড়ি হওয়ায় রাস্তাঘাটে মানুষের উপস্থিতি কম, তাই রোজগারও কম। বিকেল চারটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত মাত্র ২০০ টাকা আয় করেছেন। দিনের চেয়ে সন্ধ্যার পর রাস্তায় আরও কমসংখ্যক যাত্রী থাকে।
×