ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

নতুন কৌশলে তদন্তে পুলিশ

পরীমনির অভিযোগকে প্রাধান্য দেয়ার আর সুযোগ নেই

প্রকাশিত: ২২:৪৫, ১৮ জুন ২০২১

পরীমনির অভিযোগকে প্রাধান্য দেয়ার আর সুযোগ নেই

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ঢাকা বোট ক্লাবে পরীমনিকে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার ঘটনা একযোগে তদন্তে নেমেছে পুলিশের ৫টি ইউনিট। সাভার, উত্তরা, দক্ষিণখান, গুলশান থানা ও ডিবি সমন্বিতভাবে এ ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ে মাঠে নেমেছে। বুধবার রাতে হঠাৎ গুলশানের অল কমিউনিটি ক্লাব সংবাদ সম্মেলনে পরীমনির বিরুদ্ধে মদ খেয়ে ভাংচুর করার অভিযোগের পর পুলিশকে নতুন কৌশলে তদন্ত করতে হচ্ছে। এখন আর একতরফা পরীমনির অভিযোগকে প্রাধান্য দেয়ার কোন সুযোগ নেই। ফলে বাধ্য হয়ে ডিবি পুলিশকে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিতে হয়েছে তদন্তের বিষয়ে। ডিবি বলছে- এ ঘটনায় পরীমনির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। বৃহস্পতিবার ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে এ কথা জানান ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার। এদিকে দক্ষিণখান থানার পুলিশ বুধবার রাতেও আশকোনা অমিদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সিঙ্গাপুর ট্রেনিং সেন্টারে অভিযান চালিয়েছে। ওই প্রতিষ্ঠানের ক্যাশিয়ার সাইফুলকে গ্রেফতার করার জন্য এ অভিযান চালানো হয় বলে জানিয়েছে পুলিশ। তবে অমি গ্রেফতার হবার পর থেকেই তিনি পলাতক রয়েছেন বলে জানিয়েছে সেখানকার দারোয়ান। পুলিশ জানায়- বোট ক্লাবের ঘটনার পর থেকে নাসির ও অমির বিরুদ্ধে তিনটা মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ গুলো হচ্ছে বোট ক্লাবের পরীমনিকে হত্যা ও ধর্ষণ চেষ্টা মামলা, অমির বাসা থেকে মদ ও ইয়াবা উদ্ধারের ঘটনায় উত্তরা থানায় মাদক মামলা, আশকোনার ট্রেনিং সেন্টার থেকে পাসপোর্ট জব্দের ঘটনায় মানবপাচারের মামলা। অন্যদিকে অলকমিউনিটি ক্লাবে ভাংচুরের ঘটনায় পরীমনির বিরুদ্ধে গুলশান থানায় জিডি। এসব মামলা ও জিডি তদন্তে পুলিশের ৫টি ইউনিট মাঠে সক্রিয় । এসব মামলার বিষয়ে ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন-একটি সাভার থানায় কমিউনিটি ক্লাবের ঘটনাটি আমাদের গুলশান টিমের এলাকায়। আমরা বিষয়টি নিয়ে অবশ্যই আলোচনা করব। এ বিষয়ে যেকোনো ধরনের অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে। আমরা জেনেছি ৮ জুন গভীর রাতে পরীমনি ওই ক্লাবে গিয়েছেন। ৯৯৯-এর একটি ফোনে ওখানকার ঘটনাটি জানতে পারে পুলিশ। তবে পরবর্তীতে এটা নিয়ে কোন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া যায়নি। অভিযোগ পেলে আমরা এটা নিয়ে কাজ করব। এ সময় বোট ক্লাবের ঘটনায় পরীমনিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন- একটি মামলা হয়েছে ঢাকা জেলাতে। যেহেতু মামলাগুলো চলমান, পরীমনি অবশ্যই প্রয়োজনে সব বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের আওতায় আসবে। জিজ্ঞাসাবাদ করে তদন্ত শেষে বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলা যাবে। এদিকে গুলশান-১ এর অল কমিউনিটি ক্লাবে নায়িকা পরীমনির সঙ্গে ক্লাব কর্তৃপক্ষের তর্কাতর্কি ও বাগবিতÐার ঘটনায় থানায় সাধারণ ডায়েরির বিষয়ে গুলশান বিভাগের উপকমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী বলেন- পরীমনি ওই ক্লাবের সদস্য নন। ৮ জুন রাতে তিনি ক্লাবে অনুপ্রবেশ করেন। তারপর ক্লাবের সদস্যদের সঙ্গে তার বাগবিতণ্ডা ও তর্কবিতর্ক হয়। ঘটনাস্থল থেকে এক ব্যক্তি সেবা ৯৯৯ এ ফোন দেন। ফোন পেয়ে ঘটনাস্থলে যায় পুলিশ। ৯৯৯ থেকে গুলশান থানায় ফোন করলে সেখানে পুলিশ পাঠানো হয়। পুলিশ গিয়ে তাদের মধ্যে বাগবিতণ্ডা দেখতে পায়। এরপর পুলিশ থানায় ফিরে এসে সাধারণ ডায়েরি আকারে গোটা বিষয়টি থানায় অবগত করে। গুলশান থানা জানায়, সাধারণত ৯৯৯ থেকে কোন ডাক পেলে সেই ঘটনাস্থলে গিয়ে পুলিশ কী পেল না পেল ইত্যাদি অবগত করাতে হয়। তার অংশ হিসেবে সেদিনের ক্লাবের ঘটনাটি পুলিশ জিডি আকারে লিখে রাখে। এদিকে পুলিশ সূত্র জানিয়েছে-সাভার থানায় যে মামলা হয়েছে, সেই মামলার এজাহারের বর্ণনার সঙ্গে পরীমনির বক্তব্যের মিল পাচ্ছেন না তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এ কারণে পরীমনির অভিযোগ নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তদন্তকারীরা এরইমধ্যে ওই রাতের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণের পাশাপাশি ঢাকা বোট ক্লাবের দায়িত্বরত নিরাপত্তাকর্মীদের সঙ্গেও কথা বলেছেন। ঘটনার বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে জানতে চাইবেন পরীমনির কাছেও। তবে প্রাথমিক তদন্তে বোট ক্লাবের ঘটনার সঙ্গে পরীমনির অভিযোগের অনেক কিছু মিলছে না বলে জানিয়েছে পুলিশ। চাঞ্চল্যকর এ মামলার তদন্ত সম্পর্কে ঢাকা জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহিল কাফি বলেন-আমরা প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটনের জন্য যা যা করণীয় সবই করছি। সেই রাতে ক্লাবে কী ঘটেছিল, নিবিড়ভাবে তদন্ত করে আমরা সেই সত্য তুলে আনতে চাই। তদন্তে প্রাপ্ত তথ্য আমরা আদালতে জমা দেব। এবিষয়ে একাধিক তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান-সাভার থানায় দায়ের করা মামলায় বলেছেন, সেই রাতে পূর্ব পরিচিত অমিসহ কয়েকজন পরিকল্পিতভাবে দুই মিনিটের কাজ আছে বলে পরীমনিকে ঢাকা বোট ক্লাবের সামনে নিয়ে যান। সেখানে তারা গাড়িতে অপেক্ষা করেন। ছোট বোন বনি প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়ায় তারা বারের পাশের একটি টয়লেট ব্যবহার করতে ভেতরে প্রবেশ করেন। কিন্তু ঢাকা বোট ক্লাবের প্রবেশ পথ ও অভ্যর্থনা কক্ষে থাকা সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, বোট ক্লাবের সামনে গাড়ি এসে থামার সঙ্গে সঙ্গেই স্বাভাবিকভাবেই পরীমনি ও তার সঙ্গীরা ক্লাবের ভেতরে প্রবেশ করেন। পরীমনি ক্লাবে প্রবেশ করেন ১২টা ২২ মিনিটে, আর ক্লাব থেকে তাকে ধরাধরি করে বের করা হয় ১টা ৫৯ মিনিটে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে - এই এক ঘণ্টা ৩৭ মিনিট ঢাকা বোট ক্লাবের ভেতরে কী করেছেন পরীমনি। তিনি কি স্বেচ্ছায় মদ খেয়েছেন নাকি জোরপুর্বক খাওয়ানো হয়েছে তদন্তকারীরা সেটাই বের করার বিষয়ে প্রাধান্য দিচ্ছে। এ ঘটনায় বর্তমানে ৭ দিনের রিমান্ডে থাকা অমি ইঙ্গিত দিয়েছেন সেই রাতে পরীমনিসহ অন্যরা ক্লাবের ভেতরে গিয়ে নাসির ইউ মাহমুদসহ একসঙ্গে মদ পান করেন। শেষে একটি বোতল নেয়া নিয়ে প্রথমে একজন কর্মচারীর সঙ্গে পরীমনি বিতণ্ডা করেন। সেই বিতণ্ডায় যোগ দেন নাসির ইউ মাহমুদসহ আরও কয়েকজন। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়- পরীমনিকে চ্যাংদোলা করে অচেতন অবস্থায় বের করে তার গাড়িতে তোলা হচ্ছে। ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে নাসির ও অমি জোরপুর্বক মদ খাওয়ানোর বিষয়টি অস্বীকার করে তারা শুধু তাকে ঠেলাধাক্কা ও চড়-থাপ্প্ড় মারার কথা স্বীকার করছেন। এমনকি অমি ডিবিকে উল্টো অভিযোগ করেন-বোট ক্লাবে যাওয়ার আগে পরীমনির বনানীর বাসায় বসেই এক বোতল মদ পান করেন তারা সবাই। এসময় বাসাতে নাট্যপরিচালক চয়নিকা চৌধুরীও ছিল। অমি আরও জানিয়েছে- বছর দুয়েক আগের পরিচয় সূত্র ধরে অমির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয়েছে পরীমনির। তার দক্ষিণখানের বাগানবাড়িতেও পরীমনির যাতায়াত ছিল বলে অমি দাবি করার বিষয়টিও তদন্ত করা হচ্ছে। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে দুটো ঘটনারই সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানিয়েছেন পরীমনি। তিনি সাংবাদিকদেরকে গতকালও বলেছেন- অল কমিউনিটির অভিযোগ এতদিন পর কেন বলা হচ্ছে। ঢাকা বোট ক্লাবের ঘটনা না ঘটলে কি এটা বলা হতো না। আমি যদি কোন অপরাধ করে থাকি, তাহলে তারা কেন এতদিন চুপ করে ছিলেন। আমি যখন অভিযোগ করলাম, তখন অল কমিউনিটি ক্লাব কথা বলছে। বোঝাই যাচ্ছে, আসল ঘটনার ফোকাস ঘোরানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। বোট ক্লাবের আগের দিন রাতে অল কমিউনিটি ্ক্লাবের সভাপতি আলমগীর ইকবাল অভিযোগ করেন- এর আগে পরীমনি সেখানে গিয়ে মদ খেয়ে গেলাস ও টেবিল ভাংচুর করেন। সেই রাতে তার সঙ্গে সাবেক প্রেমিক তামিম হাসানও ছিলেন উল্লেখ্য, রবিবার রাত সোয়া ৮টার দিকে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেশের অন্যতম জনপ্রিয় নায়িকা পরীমনি নিজেকে ধর্ষণ চেষ্টা, হত্যা চেষ্টা ও শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ করেন। এর বিচার চেয়ে আবেদন করেন প্রধানমন্ত্রী বরাবর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ করে বলেন, আমি পরীমনি। এই দেশের একজন বাধ্যগত নাগরিক। আমার পেশা চলচ্চিত্র। আমি শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছি। আমাকে রেপ এবং হত্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে। আমি এর বিচার চাই। পরদিন সোমবার সাভার থানায় নির্যাতন ও ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগে ঢাকা বোট ক্লাবের এন্টারটেনমেন্ট এ্যান্ড কালচারাল এ্যাফেয়ার্স সেক্রেটারি নাসির উদ্দিন মাহমুদ ও অমিসহ অজ্ঞাত চার জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন পরীমনি। এ ঘটনায় নাসির উদ্দিন মাহমুদ ও অমিসহ পাঁচজনকে উত্তরা থেকে আটক করে পুলিশের গোয়েন্দা শাখা। পরে মঙ্গলবার উত্তরা থানায় মাদকের আরেকটি মামলায় তাদের আদালতে তোলা হয়। এসময় নাসির উদ্দিন মাহমুদ ও তুহিন সিদ্দিকী অমির সাত দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করে আদালত। এ ছাড়া আসামি লিপি আক্তার, সুমি আক্তার ও নাজমা আমিন স্নিগ্ধাকে তিন দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়। তাদের মধ্যে একজন অমির স্ত্রী বলে জানিয়েছে পুলিশ।
×