ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

৫৫ হাজার রোহিঙ্গা ভোটার তোলপাড়

প্রকাশিত: ২২:৪২, ১৮ জুন ২০২১

৫৫ হাজার রোহিঙ্গা ভোটার তোলপাড়

মোয়াজ্জেমুল হক/হাসান নাসির, চট্টগ্রাম অফিস ॥ মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাসহ অর্ধলক্ষাধিক ভোটার হওয়ার ঘটনা নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। এ ঘটনা নিয়ে চারদিনে চট্টগ্রামে দুদকের ৬টি মামলায় উঠে এসেছে ইসি সদর কার্যালয়ের পরিচালকসহ কয়েকজনের নাম। রয়েছে পুলিশ কর্মকর্তা, সাবেক কয়েক ওয়ার্ড কাউন্সিলরের যোগসাজশ। অভিযুক্তের সংখ্যা এ পর্যন্ত ৫১। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনা উদ্ঘাটনের পর বদলি করে দেয়া হয়েছে মামলাসমূহের অন্যতম এক বাদী দুদকের চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপ সহকারী পরিচালককে। রোহিঙ্গাসহ যাদের জন্মনিবন্ধন ও স্মার্টকার্ড বিতরণ করা হয়েছে ছয় মামলায় এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৫ হাজার ৩১০। অনুসন্ধান করে এ মামলা করা হয়েছে। তদন্ত শুরু হলে অবৈধ ভোটারের এ সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে কোথায় গিয়ে ঠেকে তা নিয়ে নানা জল্পনা কল্পনা চলছে। এছাড়া ইসি কার্যালয় থেকে চুরি বা হারিয়ে যাওয়া একটিসহ কয়েকটি ল্যাপটপ দিয়ে পরস্পর যোগসাজশে এ ঘটনা হয়েছে বলে দুদক নিশ্চিত হয়েছে। দুদক সূত্রে বৃহস্পতিবার জানানো হয়েছে, নির্বাচন কমিশনের চট্টগ্রাম অফিস থেকে রহস্যজনকভাবে চুরি হয়ে যাওয়া একটি ও আরও কয়েকটি ল্যাপটপের মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে রোহিঙ্গাসহ ৫৫ হাজার ৩১০ জনকে অবৈধভাবে ভোটার করার চাঞ্চল্যকর ঘটনা উদ্ঘাটিত হয়েছে। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত গত চারদিনে এসব ঘটনা নিয়ে ইসি পরিচালক-কর্মকর্তা ও ৩ ওসি-এসআইসহ ৫১ জনের বিরুদ্ধে দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় ৬টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। অবৈধভাবে ভোটার হয়েছেন তাদের মধ্যে অধিকাংশ রোহিঙ্গা। প্রায় ছয় বছর আগে রহস্যজনকভাবে ইসির হারিয়ে যাওয়া বা চুরি হওয়া একটি ও আরও কয়েকটি ল্যাপটপ ব্যবহার করে ইসির কয়েক কর্মকর্তা কর্মচারীর যোগসাজশে এ ঘটনা ঘটেছে বলে দুদকের মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে। এসব মামলায় দুদকের পৃথক পৃথক কর্মকর্তা বাদী হয়েছেন। এর মধ্যে দুদকের চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়-২-এর উপসহকারী পরিচালক ঘটনার অনুসন্ধানকারী ও মামলার বাদী। মামলার পর এ উপসহকারী পরিচালককে আকস্মিকভাবে চট্টগ্রাম থেকে পটুয়াখালীতে বদলি করা হয়েছে। তাকে ১ জুলাই নতুন কর্মস্থলে যোগদানের আদেশ দেয়া হয়েছে। তার স্থলে সংযুক্ত করা হয়েছে দুদক চট্টগ্রাম জেলা সমন্বিত কার্যালয়-১ এর উপ-সহকারী পরিচালক মো. নুরুল ইসলামকে। অথচ, এ ঘটনা নিয়ে মামলার বাদী শরীফ উদ্দিনের নেতৃত্বে অধিকতর অনুসন্ধান, মামলা ও তদন্তের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। তাকে কেন হঠাৎ করে বদলি করে দেয়া হলো এবং এর নেপথ্যে ইসির সদর দফতর থেকে কেউ কলকাঠি নেড়েছেন কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। যদিও দুদক সূত্রে বদলির বিষয়টি রুটিনমাফিক বলে দাবি করা হয়েছে। কিন্তু চাঞ্চল্যকর এমন ঘটনা নিয়ে মামলার বাদীকে আকস্মিক বদলির আদেশ তদন্ত কার্যক্রকে ব্যাহতও করতে পারে। এসব মামলার আরেকজন বাদী হলেন একই দফতরের উপপরিচালক সুভাষ চন্দ্র দত্ত। বদলির ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে উপসহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দিন কোন মন্তব্য করেননি। উল্লেখ্য, গত ১৪, ১৫, ১৬ এবং সর্বশেষ বৃহস্পতিবার ১৭ জুন এই দুই উপপরিচালক পৃথক পৃথকভাবে ৬টি মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় উল্লেখযোগ্য আসামিদের মধ্যে রয়েছেন ইসি সদর দফতরের পরিচালক খোরশেদ আলম, বর্তমানে কুমিল্লায় কর্মরত ইসির অতিরিক্ত আঞ্চলিক কর্মকর্তা মোজাম্মেল হোসেন, তিন পুলিশ পরিদর্শক ও উপ পরিদর্শক যথাক্রমে এসএম মিজানুর রহমান, মো. রুহুল আমিন ও প্রভাত চন্দ্র ধর, চসিকের সাবেক কাউন্সিলর ইসমাইল হোসেন বালি, সরফরাজ কাদের রাসেল। এছাড়া ওয়ার্ড নিবন্ধন সহকারী মো. ফরহাদ হোসেন, চট্টগ্রাম ডবলমুরিং থানার ইসি কার্যালয়ের ডাটা এন্ট্রি অপারেটর মো. শাহ জামাল, পাঁচলাইশ থানা নির্বাচন অফিসের অস্থায়ী সাবেক প্রæফ রিডার উৎপল বড়ুয়া, রতœা বড়ুয়া এবং পাঁচলাইশ থানা নির্বাচন অফিসের সাবেক কর্মকর্তা আবদুল লতিফ শেখ, চট্টগ্রাম ইসি কার্যালয়ের সাবেক কর্মকর্তা ও বর্তমানে ইসি সচিবালয়ের পরিচালক খোরশেদ আলম, রামু উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মাহফুজুল ইসলাম, অফিস সহায়ক রাসেল বুড়য়া ও টেকনিক্যাল এক্সপার্ট মোস্তফা ফারুক। এজাহারে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৫ সালে ভোটার তালিকা হালনাগাদ কাজে মীরসরাই উপজেলা নির্বাচন কার্যালয়ে একটি ল্যাপটপ ও অন্যান্য মালামাল দেয়ার পর তা গ্রহণ করেন মোস্তফা ফারুক। তিনি ওই ল্যাপটপ মীরসরাই উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ে নিয়ে যান। পরবর্তীতে সে ল্যাপটপ পুনরায় চট্টগ্রামের আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ে পাঠানো হয়। তৎকালীন অফিস সহায়ক ও বর্তমানে রামু উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান সেই ল্যাপটপ গ্রহণ করে অন্য উপজেলায় পাঠানোর কথা উল্লেখ থাকলেও পরবর্তীতে এর আর কোন হদিস মিলেনি। অনুসন্ধানে উদ্ঘাটিত হয়েছে, সেই ল্যাপটপের হদিস না মেলার বিষয়টি মাহফুজুর রহমান ও রাশেল বড়ুয়া উর্ধতনদের অবহিত না করে এড়িয়ে যান। তৎকালীন জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা খোরশেদ আলম সেটি অবহিত হলেও উদ্ধারে কোন উদ্যোগ নেননি। এমনকি গুরুত্বপূর্ণ এ ল্যাপটপের বিষয়ে থানায় জিডি বা মামলাও করেননি। অথচ এর আগে ২০১২ সালে নির্বাচন কমিশনের আরও সাত ল্যাপটপ হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা নিয়ে রাঙ্গামটি কাপ্তাই ও চন্দনাইশে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়। এদিকে, ২০১৯ সালে রোহিঙ্গাদের ভোটার করা নিয়ে জালিয়াতির বিষয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ হলে পুলিশ ও নির্বাচন কমিশনের তৎপরতায় একটি ল্যাপটপ উদ্ধার হয় চট্টগ্রাম ডবলমুরিং থানা নির্বাচন অফিসের কর্মচারী জয়নাল আবেদিনের কাছ থেকে। নির্বাচন কমিশনের হারিয়ে যাওয়া ল্যাপটপটিই এই ল্যাপটপ কিনা তা এখনও নিশ্চিত করতে পারেনি দুদক। মামলায় হারিয়ে যাওয়া ল্যাপটপটি রোহিঙ্গাসহ ৫৫ হাজার ৩১০ জনকে অবৈধভাবে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এজাহারে আরও উল্লেখ রয়েছে, ২০১৯ সালে কক্সবাজারের টেকনাফে বন্দুকযুদ্ধে নিহত রোহিঙ্গা ডাকাত নুর আলমের কাছ থেকে এনআইডি পাওয়ার পর ইসি সচিবালয় থেকে খোরশেদ আলমকে প্রধান করে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্তকালে খোরশেদ আলম যে ল্যাপটপটি হারিয়ে যায় সে বিষয়টি এড়িয়ে যান। তিনি বিষয়টি ধর্তব্যেই আনেননি। দুদক মনে করে চাঞ্চল্যকর ও বেআইনী এ ঘটনায় অভিযুক্ত কর্মকর্তা কর্মচারীদের বাঁচাতেই খোরশেদ আলম দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। যোগসাজশের মাধ্যমে পক্ষাবলম্বন করেছেন। মামলার বাদী শরীফ উদ্দিন বৃহস্পতিবার জানিয়েছেন, ইসি কার্যালয় থেকে কয়েকটি ল্যাপটপ পাওয়া গেছে। যেগুলোর আইডি নম্বর কয়েকদফায় পরিবর্তন করা হয়েছে। ফলে কোন ল্যাপটপটি খোয়া গেছে সেটি বের করার জন্য অধিকতর তদন্তের প্রয়োজন। তিনি জানান, খোয়া যাওয়া ওই ল্যাপটপসহ আরও কয়েকটি ব্যবহারের মাধ্যমে ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৫৫ হাজার ৩১০ জনকে অবৈধভাবে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এদের মধ্যে হাতেগোনা কয়েকজন বাংলাদেশীসহ মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা। তিনি আরও জানান, রোহিঙ্গা দম্পতি ফয়েজ উল্লাহ ও তার স্ত্রী মাহমুদা খাতুন, আসামি জয়নাল আবেদিন চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানা নির্বাচন কার্যালয় থেকে ডাটা তৈরি করেন। আর নঈম উদ্দিন কক্সবাজার থেকে সেগুলো অবৈধভাবে সার্ভারে আপলোড দেন। নির্বাচন কমিশনের বরাদ্দকৃত অসংখ্য পরিমাণ ফরম আসামি জয়নাল নিজ বাসায় মজুদ রাখেন। জয়নালের ভগ্নিপতি নুর আহমদ ও তার স্ত্রী মিলে ফরম পূরণ করেন। অপরদিকে, আসামি ওবায়দুল্লাহ ও শামসুর রহমান এ রোহিঙ্গা দম্পতিকে কক্সবাজারের ক্যাম্প থেকে জয়নালের কাছে নিয়ে এসেছিলেন। মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে, বিপুল অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিয়ে রোহিঙ্গাসহ উল্লেখিতদের ওয়ার্ড অফিস থেকে জন্মনিবন্ধন সনদ এবং ইসি কার্যালয় থেকে স্মার্টকার্ডও প্রদান করা হয়েছে। মামলায় আরও উল্লেখ করা হয়েছে, অভিযুক্তরা আর্থিকসহ বিভিন্নভাবে লাভবান হওয়ার উদ্দেশ্যে পরস্পর যোগসাজশে ভুয়া পরিচয়ে নাম ঠিকানা ব্যবহার করে জন্মনিবন্ধন সনদ ও স্মার্ট কার্ড হাতিয়ে নিয়েছে। দণ্ডবিধির ৪০৯, ৪২০, ৪৬৭, ৬৬৮, ৪৭১ ও ১০৯ ধারা এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫/২ ধারায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। অভিযুক্তদের অধিকাংশ এখন গা-ঢাকা দিয়েছে।
×