ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যালে আয়া-বুয়াদের কাছে জিম্মি রোগী

প্রকাশিত: ২১:১৫, ১২ জুন ২০২১

বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যালে আয়া-বুয়াদের কাছে জিম্মি রোগী

স্টাফ রিপোর্টার, বরিশাল ॥ নানা অনিয়ম আর দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে দক্ষিণাঞ্চলবাসীর চিকিৎসা সেবার একমাত্র নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ (শেবাচিম) হাসপাতাল। এখানে টাকা ছাড়া কোন নিয়মই মানা হয় না। সরকারী আওতাভুক্ত না হয়েও এ হাসপাতালে অবাধে কাজ করে যাচ্ছে একদল বহিরাগত কর্মীরা। তাদের একটাই উপার্জন রোগী এবং তাদের স্বজনদের হয়রানি করে টাকা আদায় করা। কেউ তাদের প্রতিবাদ করেও উল্টো লাঞ্ছিত হতে হয়। চাহিদা অনুযায়ী টাকা না পেলে ওইসব বহিরাগত কর্মীরা রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে এক প্রকার জোরপূর্বক টাকা আদায় করে নিচ্ছে। এছাড়া জমজমাটভাবে চলছে হাসপাতালের আয়া ও ট্রলিম্যানদের কমিশনপ্রাপ্ত ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দালালি। সূত্রমতে, চিকিৎসকরা রোগীদের রোগ নির্ধারণের জন্য বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেয়ার পর হাসপাতালের কর্মরত কতিপয় আয়া-বুয়া ও ট্রলিম্যানরা কৌশলে রোগীর স্বজনদের ভুল ভাল বুঝিয়ে নিয়ে যায় তাদের কমিশনপ্রাপ্ত ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একজন আয়া ও ট্রলিম্যান প্রতিদিন দালাল নিয়ন্ত্রিত হাসপাতালের পার্শ্ববর্তী কয়েকটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে সর্বনিম্ন দুই হাজার টাকা কমিশন পাচ্ছেন। আর প্রতারিত হচ্ছেন দূর-দূরান্ত থেকে চিকিৎসা নিতে আসা সাধারণ রোগী ও তাদের স্বজন। সরেজমিনে দেখা গেছে, রোগী যতই গুরুত্বর হোক না কেন, টিকেট না কাটলে তাকে কোন ডাক্তার দেখতে আসেন না। এখানেও পোহাতে হয় ভোগান্তি। গুরুত্বর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে আসা রোগীদের প্রথমেই অনিয়মের শিকার হতে হয় জরুরী বিভাগে। ২৬ টাকার পরির্বতে জরুরী বিভাগের ভর্তির টিকেট কাটার দায়িত্বে থাকা ব্রাদাররা ভাংতি না থাকার অজুহাতে প্রতি রোগীর কাছ থেকে ৩০ থেকে ৫০ টাকা করে হাতিয়ে নিচ্ছেন। এরপর থেকেই শুরু হয় আয়া ও বুয়া থেকে শুরু করে সব শ্রেণীর কর্মকর্তার দৌরাত্ম্য। হাসপাতালের চারিদিকের দেয়ালে ‘দালাল থেকে সাবধান’ লেখা থাকলেও এখানে সব ধরনের নিয়ম-কানুন যেন ঠিক এর উল্টো। দালাল ছাড়া এ হাসপাতালে কোন কাজ কল্পনাও করা যায় না। জরুরী বিভাগ থেকে নির্দিষ্ট ওয়ার্ডে ভর্তিকৃত রোগীকে নিয়ে গেলে বকশিশের নামে চাঁদাবাজি শুরু করেন ট্রলিম্যানরা। প্রতিবাদ করলে লাঞ্ছিত হতে হয় রোগীর স্বজনদের। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, হাসপাতালের নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মচারীরা নিয়মিত বেতন-ভাতা গ্রহণ করলেও তারা নিজেরা কাজ না করে বহিরাগতদের কাজ করার সুযোগ করে দিচ্ছেন। ফলে রোগীরাও বাধ্য হচ্ছেন বহিরাগতদের সেবা নিতে। এ সুযোগে রোগীদের জিম্মি করে চাহিদা মতো অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে ওইসব বহিরাগত কর্মীরা। আর এ টাকা থেকে হাসপাতালের ওয়ার্ড মাস্টার এবং নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মচারীরা কমিশন পাচ্ছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। সূত্রমতে, জরুরী বিভাগের কতিপয় কর্মচারীর সঙ্গে বহিরাগত কর্মীরা হাসপাতালের ট্রলি দখল করে রোগীর স্বজনদের জিম্মি করে অর্থের বিনিময়ে রোগীদের ওয়ার্ডে নেয়ার কাজ করছে। নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক এক বহিরাগত ট্রলিম্যান জানান, প্রতি শিফটে তিনি প্রায় সাত থেকে আট শ’ টাকা আয় করেন। একাধিক রোগীর স্বজনরা অভিযোগ করেন, হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডের সামনে বড় করে লেখা রয়েছে, ‘দালাল হতে সাবধান’। যেখানে হাসপাতালের কর্মচারীরাই দালালি কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন সেখানে সাবধান করবে কে। অপরদিকে হাসপাতালকে ঘিরে শতাধিক এ্যাম্বুলেন্স গাড়িকে কেন্দ্র করে শত শত দালাল নিযুক্ত রয়েছে। তারা প্রতিটি ওয়ার্ডে গিয়ে রোগী ও স্বজনদের প্রভাবিত করে বিভিন্ন বেসরকারী ক্লিনিক এবং হাসপাতালে ভাগিয়ে নিয়ে জিম্মি করে অর্থ আদায় করছেন। এদের কারণে হাসপাতালের এ্যাম্বুলেন্সে রোগী বহন হচ্ছে নামেমাত্র। এছাড়া বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির এজেন্ট ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দালালরা হাসপাতালে নিয়োজিত রয়েছেন। তারা কতিপয় চিকিৎসকদের উপঢৌকন দিয়ে তাদের পাশে বসে থেকে নামসর্বস্ব কোম্পানির ওষুধ রোগীদের জন্য লিখতে প্রভাবিত করছেন। ফলে রোগীরা একদিকে যেমন প্রতারিত, তেমনি আর্থিকভাবেও চরম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। প্রসূতি বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা এক নারী রোগীর স্বামী জানান, তার স্ত্রীকে জরুরী বিভাগ থেকে প্রথমে ট্রলিতে করে ওয়ার্ডে আনার পর ট্রলিম্যান তার কাছ থেকে জোরপূর্বক ১৫০ টাকা আদায় করে নিয়েছে। প্রসূতি বিভাগে তাদের সিটের ব্যবস্থা করে দেয়ার জন্য আয়ার দাবিকৃত দুই শ’ টাকা দেয়ার পর সে সব ব্যবস্থা করে দিয়েছে। পরবর্তীতে বাচ্চা প্রসবের পর গাইনি ওটির আয়াদের দাবিকৃত দুই হাজার টাকার পরির্বতে এক হাজার টাকা দেয়ায় তার সঙ্গে দুরব্যবহার করা হয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাসপাতালের অধিকাংশ ওয়ার্ডের বাথরুমের নাজুক অবস্থা। দুর্গন্ধে ভেতরে প্রবেশ করা যায় না। রোগীদের সঙ্গে গ্রাম থেকে এ হাসপাতালে আসা স্বজনদের জন্য গোসলের ব্যবস্থা না থাকায় তাদের বাধ্য হয়ে দিনের পর দিন থাকতে হচ্ছে। পরিস্থিতি এমন যেন রোগীকে সুস্থ করতে এসে স্বজনরাই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। সার্বিক বিষয়ে শেবাচিম হাসপাতালের পরিচালক ডাঃ সাইফুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমাদের সর্বাত্মক নজর করোনা ওয়ার্ডের প্রতি। এ সুযোগে অন্যান্য ওয়ার্ডে কেউ রোগীদের জিম্মি করা বা অন্য যেকোন বিষয়ে অনিয়ম করে থাকলে, আর তার লিখিত অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
×