ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অদম্য বাংলাদেশের বিরুদ্ধে হেফাজতী ষড়যন্ত্র

প্রকাশিত: ২০:৫৪, ৫ মে ২০২১

অদম্য বাংলাদেশের বিরুদ্ধে হেফাজতী ষড়যন্ত্র

কখনও কখনও আমাদের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করে থাকে। এটি কেউ কেউ লুফে নেয়। হেফাজতে ইসলামের ঘটনার পর এটা আরও বেড়ে গেছে এবার। অনেকে কয়েক ডিগ্রী জোরে উচ্চারণের মাধ্যমে বলতে শুরু করেছেন, সবকিছুই শেষ হয়ে গেল। এই গোষ্ঠী সব সময়ই একটা অস্থিরতা তৈরি করে থাকে। তারা সুযোগে দুই নৌকায় পা দিয়ে ‘ফায়দা লুটতেও’ বিলম্ব করে না। ধৈর্য আমাদের এতটাই ক্ষয়ে গেছে যে, ন্যূনতম সবুর করতে চাই না। হেফাজতকা-ে আমাদের ধৈর্য ধরতেই হবে এ কথাটি যেন আমরা ভুলে গেছি। যেমন, গত বছর করোনার আক্রমণ শুরুর পর স্কুল-কলেজসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের ওপর চোটপাট শুরু করলাম। ‘কেন বন্ধ করে দিচ্ছে না স্কুল-কলেজ। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া বড় নাকি জীবন বড়?’ শুরু হলো বিতর্ক। কোন কোন টিভির টকশোতেও একথা। পুনরায় কিছুদিন পরে দেখা গেল উল্টোচিত্র। স্কুল-কলেজ-শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার জন্য আবার চোটপাট। গত নবেম্বরে ঘ্যানঘ্যান, ‘সরকার স্কুল-কলেজ খুলে দিচ্ছে না কেন? লেখাপড়ার তো সর্বনাশ হয়ে গেল। বাচ্চারা শেষ হয়ে গেল।’ এ কথাও বললাম আমরা কেউ কেউ। আবার দেশব্যাপী ঘুরবার প্রতিযোগিতায় নামলাম। খালুবাড়ি, নানাবাড়ি, দাদাবাড়ি, শ^শুরবাড়ি, শালিকার বাড়ি ছুটেছি কেউ কেউ। এরপর দলবেঁধে কক্সবাজার, পটুয়াখালী, কুয়াকাটা, সিলেট, জাফলং, সুনামগঞ্জ ঘুরতে যাবার হিড়িক পড়ে গেল। করোনার কথা যেন বেমালুম ভুলে গেলাম। এর মধ্যে এলো ভ্যাকসিন। যদিও ভ্যাকসিন নিয়ে বহু অপপ্রচার হয়েছে। কারা অপপ্রচার চালিয়েছে আমরা জানি। দেখলাম, আত্মীয়দের বাড়ি বেড়াতে যাওয়া বেড়ে গেল কয়েকগুণ। বিয়ে খাওয়া, আমোদ-ফুর্তি করার প্রতিযোগিতা কয়েকগুণ বাড়ল। করোনা যেন চলে গেছে। হেফাজতে ইসলামীরা এটাই কিন্তু চেয়েছিল। এর মধ্যেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ঠেকানোর তা-ব দেখলাম। ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লাসহ বিভিন্ন জেলায় তা-ব দেখলাম, হেফাজতী তা-ব। নারায়ণগঞ্জ রিসোর্টেও তা-ব দেখলাম। এরপর মার্চের শেষ দিক থেকে শুরু হওয়া কোভিড-১৯ আমাদের আতঙ্কিত করে দ্বিতীয়বার। এখন কয়েকদিন ধরে শতাধিক মৃত্যু। শুরু হয়েছে কঠোর লকডাউন। সুতরাং আমাদের ধৈর্য ক্ষয়ে যাওয়ার অসংখ্য উদাহরণ দেয়া যাবে। ঠা-ামাথায় কাজ করার জন্য পরিবেশ দরকার। কিন্তু সেই পরিবেশের কথা আমরা বেমালুম ভুলে যাই। উদাহরণ টেনে কেউ কেউ বলতে শুরু করলেন, কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযম, সাকা চৌঃ, নিজামী, মুজাহিদ, সাঈদী, মীর কাশেমের মতো শক্তিধরেরা শাস্তি পেল। ভয়ঙ্কর যুদ্ধাপরাধী রাজাকারদের সর্বোচ্চ শাস্তি হয়েছে। ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় না থাকলে যা ছিল কল্পনারও বাইরে। জাতি দেখেছে পৃথিবীর কোন শক্তি যুদ্ধাপরাধীর বিচার বন্ধ করতে পারেনি, কার্যক্রম থামাতে পারেনি। আর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকার পরও বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেলার হুমকি দিচ্ছে হেফাজত। এটা কিভাবে হয়? কি রকম দুঃসাহস। বাংলাদেশবিরোধী দুঃসাহস। যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি তারাও অসহায়। ইতিহাস থেকে আমরা শিক্ষা নেই না। আমরা ধৈর্য ধরতে জানি না। এটাই অমাদের বড় ব্যর্থতা। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সাহস, সততা, মেধা ও দূরর্শিতার কথা আমরা অনেকেই ভুলে যাই। তাঁর শরীরে তো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর রক্ত বইছে। হেফাজতের সেই তা-বের জবাব কিভাবে দিতে হবে তিনি তা জানেন, তাঁর সরকার জানে। তিনি জানেন আইন নিজের গতিতে চলবে, শেখ হাসিনার গতিতে নয়। দেশে আইনের শাসন কিভাবে অব্যাহত রাখা যায় তাও জানে প্রশাসন। এজন্যই বিলম্বে হলেও আইনের গতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশাসন পদক্ষেপ নিয়েছে। আমরা সবাই জানি এবং প্রমাণও হয়েছে যে, বিএনপি, জামায়াত ও হেফাজত একই সূত্রে গাঁথা। সুতরাং আমাদের এগোতে হবে হিসেব করেই। আমাদের মাথায় থাকতে হবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার পর থেকেই সাম্প্রদায়িক শক্তি পুনরায় দানব হয়ে ওঠার সুযোগ পায়। কিন্তু ঠিকই একুশ বছর পর শেখ হাসিনাকে জনগণ প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসায়। দেশবাসী জানে যাঁর আঙ্গুলের নির্দেশে বিশে^র মানচিত্রে আমরা খুঁজে পাই একটি নতুন দেশ, যাঁর ডাকে লাখ লাখ মুক্তিযোদ্ধা জীবন দিয়েছে, স্বাধীনতার জন্য লাখ লাখ মা-বোন ইজ্জত হারিয়েছেন, ত্রিশ লাখ শহীদ হয়েছেন তাঁরই সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা দেশটিকে রক্ষা করতে পারেন। এরপর আবার ষড়যন্ত্র। ২০০১ থেকে ২০০৮ ক্ষমতার বাইরে ছিলেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। দলীয় নেতাকর্মীর পাশাপাশি সংখ্যালঘুরা নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হন। সেই নিষ্ঠুর দিনগুলোর পর এখন নতুন ষড়যন্ত্রের মুখে। হেফাজতী ষড়যন্ত্র। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির বিরুদ্ধে নানাভাবে ষড়যন্ত্র চলছে স্বীকার করতেই হবে। চক্রান্তকারীরা নানারকম চক্রান্ত করছে। সুতরাং জনগণ মনে করে, ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তকারীদের দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতে হবে। এটা প্রায়ই দেখা যাচ্ছে নানা ইস্যুতে হিন্দু সম্প্রদায় তথা সংখ্যালঘুদের বাড়িতে, পূজাম-পে ও মন্দিরে হামলা চালানো হয়ে থাকে। দেখা যায় দোষ যদি একজনও করে তাহলে পুরো সংখ্যালঘুর গ্রামের ওপর ভয়ঙ্কর তা-ব চলে। তখন হামলা চলে একমুখী। সুনামগঞ্জের শাল্লার হিন্দু গ্রামে হেফাজতের মামুনুলের অনুসারী হিসেবে শত শত মানুষ সশস্ত্র অবস্থায় হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা চালায়। এ সময় স্বর্ণালঙ্কার, টাকা-পয়সা লুটপাট করে, ভাংচুর করে। দেশ যখন এগিয়ে যাচ্ছে, বিদেশীরা যখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ, বিদেশী রাষ্ট্রপ্রধানরা যখন বাংলাদেশে আসছেন, অনেক রাষ্ট্রপ্রধান ভিডিও বার্তার মাধ্যমে মুজিব শতবর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার প্রশংসা করছেন, তখন নতুনভাবে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। রাজনৈতিকভাবে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়ে তারা আজকে ষড়যন্ত্রের পথ বেছে নিয়েছে। এই অপশক্তিগুলো দেশবিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত। অবিলম্বে তাদের আইনের আওতায় এনে চক্রান্তের মূলোৎপাটন করা অত্যন্ত জরুরী। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে যে সমৃৃদ্ধি ও স্বাতন্ত্র্য নিয়ে যেভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছে তাকে অর্থবহ ও টেকসই করতেও এসব অপশক্তির বিষদাঁত উপড়ে ফেলা জরুরী। এই অপশক্তিগুলো কেবল মুক্তিযুদ্ধের মহান চেতনাকেই নস্যাৎ করতে উদ্যত নয়, তারা বাংলাদেশেকে বন্ধুহীন বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্রে পরিণত করতেও অতিমাত্রায় সক্রিয়। সুতরাং সাধু সাবধান। মনে রাখতে হবে, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার চেতনা থেকেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে স্বাধীন হয়েছিল বাংলাদেশ। সাম্প্রদায়িকতাকে ‘কবর’ দিয়েছি ১৯৭১-এ। আমরা অতি সহজে ইতিহাস ভুলে যাই। ২০১৩-এর মে মাসের সেদিন মতিঝিল-দিলকুশা থেকে হেফাজতকে তুলে দেয়া হলেও পরবর্তীতে নানা ক্ষেত্রে তারা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অপপ্রচার চালায়। সম্প্রতি এক আলোচনা সভায় জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেছেন, ‘দুধ দিয়ে সাপ পুষলে তার ফল কখনও শুভ হয় না। সাম্প্রদায়িক অপশক্তি দমনে কোন আপোস নয়।’ এটা তো এখন দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, বিএনপি ও হেফাজত গণহারে আলেম-ওলেমাদের গ্রেফতারের যে বক্তব্য দিচ্ছে তা আরেকটি মিথ্যাচার। এদেশের মানুষ জানে সহিংসতা-নাশকতা-জ্বালাও-পোড়াও-ধ্বংসাত্মক তা-বের সুনির্দিষ্ট ফৌজদারি অভিযোগেই হেফাজতী নেতাদের গ্রেফতার ও জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। ২০১১ সালে নারী-পুরুষের সমানাধিকার নিশ্চিত করতে ‘নারী উন্নয়ন নীতিমালা’ ঘোষিত হওয়ার পরপরই সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠে সংগঠনটি। হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ কওমী মাদ্রাসাভিত্তিক একটি ‘অরাজনৈতিক’ সংগঠন। ২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি চট্টগ্রাম থেকে এর যাত্রা শুরু। হাটহাজারী মাদ্রাসার পরিচালক শাহ আহমদ শফী ছিলেন সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা। ২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী রাজীব হায়দার খুন হওয়ার পর আবারও আলোচনায় আসে সংগঠনটি। দেশে তথাকথিত ইসলামী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দাবিতে তারা ১৩ দফা উত্থাপন করে। দাবিগুলোর বেশ কয়েকটি ধারা বাংলাদেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ১৩ দফা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে প্রথমে সংগঠনটি ২০১৩ সালের ৫ এপ্রিল ঢাকা অবরোধ ও ৫ মে শাপলা চত্বরে সমাবেশ ডাকে। ওই সমাবেশকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট ও এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি সমর্থন দেয়। এক পর্যায়ে সমাবেশ থেকে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়, ডাক দেয়া হয় সরকার পতনের। ওই রাতে পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবি যৌথ অভিযান চালায়। হেফাজতের নেতা-কর্মীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। অভিযানে হতাহতের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়। সুতরাং হেফাজতে ইসলাম কী জিনিস নতুন করে বলার ও জানার কিছু আছে কি? লেখক : সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক
×