ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নির্মূল কমিটির ওয়েবিনার

জামায়াত-হেফাজতের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ দাবি

প্রকাশিত: ২৩:২৬, ৪ মে ২০২১

জামায়াত-হেফাজতের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ দাবি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ শহীদজননী জাহানারা ইমামের ৯২তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে সোমবার একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এক আন্তর্জাতিক ওয়েবিনারের আয়োজন করেছে। ‘সকল কওমি মাদ্রাসা সরকারের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে’ শীর্ষক এ ওয়েবিনারে বক্তারা জামায়াত-হেফাজতের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধকরণের দাবি জানায়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি। সভাপতিত্ব করেন নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির। সূচনা বক্তব্যে শহীদজননী জাহানারা ইমামের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে শাহরিয়ার কবির বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব বানচালের উদ্দেশ্যে হেফাজত-জামায়াতের দেশব্যাপী মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস ও ধ্বংসযজ্ঞের ঘটনায় আবারও প্রমাণিত হয়েছে যে জাহানারা ইমামের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ গড়ার নাগরিক আন্দোলন এখনও কতটা জরুরী। বিলম্বে হলেও সরকার বর্তমানে হেফাজতের জঙ্গী নেতাদের গ্রেফতারের মাধ্যমে মৌলবাদী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে যা অভিনন্দনযোগ্য। তবে জঙ্গী মৌলবাদী সন্ত্রাসের বিষবৃক্ষ জামায়াত-হেফাজতের রাজনীতি নিষিদ্ধ না হলে বাংলাদেশ থেকে মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস নির্মূল করা যাবে না। জামায়াত-হেফাজতীরা বাংলাদেশকে আফগানিস্তান বা পাকিস্তানের মতো জঙ্গী মৌলবাদী সন্ত্রাসী রাষ্ট্র বানাবার জন্য কওমি মাদ্রাসার নিরীহ ছাত্রদের ব্যবহার করছে। পঁচিশ হাজারের বেশি কওমি মাদ্রাসার তিরিশ লক্ষাধিক ছাত্র-শিক্ষককে আমরা জামায়াত-হেফাজতের সন্ত্রাসী রাজনৈতিক অভিলাষ পূরণের জন্য তাদের কাছে জিম্মি রাখতে পারি না। হেফাজতের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের পাশাপাশি কওমি মাদ্রাসায় সরকারের পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দেশে পৃথক পৃথক আলিয়া-কওমি-নূরানি মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার কোন প্রয়োজন নেই। সব মাদ্রাসায় একই পাঠ্যসূচী প্রচলন করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-চেতনা, জাতির পিতার জীবনী, বাংলাদেশের সংবিধান, বাঙালীর ইতিহাস-ঐতিহ্য পাঠ, জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া এবং জাতীয় পতাকা উত্তোলন সকল মাদ্রাসায় বাধ্যতামূলক করতে হবে। প্রধান অতিথির বক্তব্যে দীপু মনি বলেন, আমরা যখন ২০১০ সালের শিক্ষানীতি অনুসরণ করার চেষ্টা করছি তখন কওমি মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষার্থীদের জাতিবিরোধী, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী নারীবিদ্বেষী গুজবের কারখানা হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের চূড়ান্ত অপব্যবহার করছে স্বাধীনতাবিরোধী মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তি। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমরা একমুখী, বিজ্ঞানভিত্তিক, অসাম্প্রদায়িক শিক্ষা ব্যবস্থার চিন্তা দেখতে পাই। কিন্তু সেই শিক্ষাভাবনা নিয়ে আমরা আর গোতে পারিনি ’৭৫-এর বঙ্গবন্ধু হত্যার পর স্বাধীনতাবিরোধী, একাত্তরের পরাজিত মৌলবাদী গোষ্ঠীর রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণের মাধ্যমে দেশব্যাপী সাম্প্রদায়িক শিক্ষার বিস্তারে। সামাজিক আন্দোলনের মানুষ হিসেবে সত্য মিথ্যার হিসেব করা সহজ। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে অনেক সময় তা সহজ নয়। নতুন যে কারিকুলাম হচ্ছে তার ভিত্তি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু। এই মুহূর্তে একবারে একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা সম্ভব নয়। কিন্তু সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাধ্যতামূলক কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করছি, একটি দেশের মধ্যে যেন দুটো জাতি গড়ে না ওঠে। যে মূল্যবোধের কারণে বাঙালী হিসেবে আমরা গর্ব করি- অসাম্প্রদায়িক মানবিকতা, পরমতসহিষ্ণুতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে আমরা শিক্ষা আইন ও শিক্ষানীতি প্রণয়ন করছি। লাখ লাখ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষার্থীকে মূলধারায় নিয়ে আসার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্স সমমান স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। মানুষ শুধু দরিদ্রতার কারণে নয়, ধর্মের কারণেও সন্তানকে কওমি মাদ্রাসায় ভর্তি করেন। এই বাস্তবতাও আমাদের বুঝতে হবে। আমাদের সবার দায়িত্ব সমাজে সচেতনতার ক্ষেত্র তৈরি করা। মাদ্রাসাগুলোতে ধর্মীয় শিক্ষা না জিহাদের শিক্ষা দেয়া হচ্ছে তা সম্বন্ধে বাবা-মাকে জানাতে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা অবশ্যই যথাসময়ে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করে বাংলাদেশকে তার লক্ষ্যে পৌঁছে দেবেন। সামাজিক আন্দোলন গড়ে উঠলে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন সহজ হবে। নির্মূল কমিটির সহ-সভাপতি শিক্ষাবিদ শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী বলেন, জামায়াত-হেফাজতের একমাত্র উদ্দেশ্য ক্ষমতায় যাওয়া ও বাংলাদেশের ক্ষমতা দখল করে স্বাধীনতাকে ভুলুণ্ঠিত করা। হাটহাজারী মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন কওমি মাদ্রাসায় বিপুলসংখ্যক জঙ্গীরা এ জন্য প্রস্তুত আছে বলে আমরা জানি। কিন্তু তারা ৩০ লক্ষ শহীদ ও প্রায় সোয়া ৪ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশে আমরা তা মেনে নেব না। মাদ্রাসার ছাত্ররা পাকিস্তানী ভাবধারায় গড়ে উঠছে। শিক্ষার মূলধারায় তাদের আনতে হবে। আমার প্রস্তাব বর্তমানে অন্তর্ভুক্ত ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ বিষয়টির নাম রাখা হোক ‘বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ’। উচ্চপর্যায় পর্যন্ত এ বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তাহলে মুক্তিযুদ্ধবিরোধিতার সুযোগ থাকবে না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে বহু বছর আন্দোলন করেছি। এখন আন্দোলনে নামতে চাই- দেশবিরোধী ও স্বাধীনতাবিরোধীদের বিচার করতে হবে।’ নির্মূল কমিটির উপদেষ্টা ও ডাকসুর প্রাক্তন ভিপি অধ্যাপিকা মাহফুজা খানম বলেন, বঙ্গবন্ধু কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন-এর একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের কাজ ’৭৫-এর পরে পরিবর্তন হয়ে যায়। মাদ্রাসার শিক্ষা সরকারের সুবিধাপুষ্ট, কিন্তু তারা সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন নয়। তারা কি পড়াচ্ছে, কি শেখাচ্ছে তা আমরা জানি না। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারের জন্য যা কাম্য নয়। এসব মাদ্রাসায় আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষার ছিটেফোঁটাও নেই। আমরা মৌলবাদের একেবারে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছি। এখনই ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে পরে আর ফিরে তাকানোর সময় পাব না। নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য কথাশিল্পী অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, শহীদজননী জাহানারা ইমামের উৎসাহে আমি লেখালেখিতে যুক্ত হয়েছিলাম। প্রকৃতপক্ষে হেফাজত রাজনৈতিক দল। সুযোগ পেলেই তারা রাজনৈতিক কর্মকা-ে ঝাঁপিয়ে পড়বে। তাদের বিশাল কর্মীবাহিনী আছে। এই কর্মীবাহিনীরা হচ্ছে মাদ্রাসার ছাত্র- যাদের লেখাপড়া করার কথা। কিন্তু লেখাপড়ার বাইরে গিয়ে কওমি মাদ্রাসায় তারা ধর্মান্ধ, মৌলবাদী হিসেবে গড়ে ওঠে। এ জন্য আমরা দায়ী। বাবা-মা দরিদ্রতার কারণে তাদের মাদ্রাসায় ভর্তি করে দিচ্ছে। তাদের সাধারণ শিক্ষার ব্যবস্থা আমরা করে দিতে পারছি না। এছাড়াও আলোচনায় অংশ নেন নির্মূল কমিটির সহসভাপতি শিক্ষাবিদ কলাম লেখক মমতাজ লতিফ, বাংলাদেশ সম্মিলিত ইসলামী জোটের সভাপতি হাফেজ মওলানা জিয়াউল হাসান, জঙ্গীবাদ প্রতিরোধ আন্দোলন বাংলাদেশ-এর মহাসচিব মাওলানা হাসান রফিক, নির্মূল কমিটির সাধারণ সম্পাদক কাজী মুকুল প্রমুখ।
×