ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সর্বাত্মক লকডাউন শুরু

প্রকাশিত: ২৩:৩২, ১৪ এপ্রিল ২০২১

সর্বাত্মক লকডাউন শুরু

রহিম শেখ ॥ করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে দেশে আজ থেকে শুরু আট দিনের ‘সর্বাত্মক লকডাউন’। তবে এই সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্য সঙ্কুচিত হলেও অর্থনীতি সচল রাখতে চায় সরকার। গত বছর করোনার প্রথম ধাক্কা সামাল দেয়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছিল রফতানি খাত ও রেমিটেন্স। এ লক্ষ্যে লকডাউনের মধ্যেই দেশের শিল্প-কারখানাগুলো স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণপূর্বক নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চালু রাখা হচ্ছে। সীমিত পরিসরে চলবে ব্যাংকিং সেবা। চলবে শেয়ারবাজারের লেনদেন। এছাড়া কৃষি উপকরণ (সার, বীজ, কীটনাশক, কৃষি যন্ত্রপাতি ইত্যাদি), খাদ্যশস্য ও খাদ্যদ্রব্য পরিবহন, বন্দরগুলোর (স্থল, নদী ও সমুদ্রবন্দর) কার্যক্রম, টেলিফোন ও ইন্টারনেট (সরকারী- বেসরকারী), জরুরী অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ও সেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অফিস, তাদের কর্মচারী ও যানবাহন লকডাউনে সরকারী নিষেধাজ্ঞার আওতাবহির্ভূত থাকবে। তবে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলায় সরকারের সর্বাত্মক লকডাউন দীর্ঘায়িত হলে অর্থনীতির ওপর আরও চাপ বাড়বে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা। দেশে করোনা সংক্রমণ মারাত্মকভাবে বেড়ে যাওয়ায় প্রথম দফায় মানুষের চলাচল ও কার্যক্রমে বিধি-নিষেধ আরোপের পর আজ থেকে আট দিনের কঠোর লকডাউন শুরু হচ্ছে। এর আগে গত সোমবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে। এতে বলা হয়, লকডাউনে বন্ধ থাকবে সরকারী - বেসরকারী সকল অফিস। বন্ধ থাকবে বাস- ট্রেনসহ সকল প্রকার গণপরিবহন (সড়ক, নৌ, রেল ও অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট)। শপিংমলসহ অন্য দোকানসমূহও বন্ধ থাকবে। তবে নির্ধারিত সময় কাঁচাবাজার, খাবার হোটেল খোলা থাকবে। আর অতি জরুরী প্রয়োজন ছাড়া মানুষের বাড়ি থেকে বের হতেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এই আদেশ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানানো হয় প্রজ্ঞাপনে। তবে এই সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্য সঙ্কুচিত হলেও অর্থনীতি সচল রাখতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। এরমধ্যে কৃষি উপকরণ (সার, বীজ, কীটনাশক, কৃষি যন্ত্রপাতি ইত্যাদি), খাদ্যশস্য ও খাদ্যদ্রব্য পরিবহন, বন্দরগুলোর (স্থল, নদী ও সমুদ্রবন্দর) কার্যক্রম, টেলিফোন ও ইন্টারনেট (সরকারী- বেসরকারী), জরুরী অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ও সেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অফিস, তাদের কর্মচারী ও যানবাহন লকডাউনে সরকারী নিষেধাজ্ঞার আওতাবহির্ভূত থাকবে। লকডাউনের মধ্যেই দেশের শিল্প-কারখানাগুলো স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণপূর্বক নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চালু রাখা হচ্ছে। সীমিত পরিসরে চলবে ব্যাংকিং সেবা। জরুরী প্রয়োজনে ব্যাংক খোলার অনুরোধ জানিয়ে মঙ্গলবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে চিঠি পাঠানো হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ও অর্থ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিবকে। চিঠিতে বলা হয়, ১৪ এপ্রিল থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত ব্যাংকিং সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা জারির জন্য আদেশক্রমে অনুরোধ জানানো হলো। এরপর কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে ব্যাংক বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় এ সংক্রান্ত নতুন সার্কুলার জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে বলা হয়, পরবর্তী নির্দেশনা না দেয়া পর্যন্ত সাপ্তাহিক ছুটির দিন ব্যতীত দৈনিক ব্যাংকিং লেনদেন কর্মসূচী সকাল ১০টা থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত নির্ধারণ করা হলো। তবে ব্যাংকের আনুষঙ্গিক কাজ চলবে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত। এদিকে ব্যাংকের নতুন সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে ব্যাংকের পাশাপাশি বৃহস্পতিবার থেকে আড়াই ঘণ্টা চলবে শেয়ারবাজারের লেনদেন। ব্যাংক খোলার সিদ্ধান্তের পর পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত উল ইসলাম বলেন, ব্যাংকের সঙ্গে সমন্বয় করে বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত শেয়ারবাজারে লেনদেন চলবে। এর আগে গত সোমবার সীমিতি পরিসরে ব্যাংক কার্যক্রম চালু রাখতে থেকে পৃথক তিনটি সার্কুলার জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। একটি সার্কুলারে বলা হয়, সরকার ঘোষিত বিধিনিষেধ চলাকালে সাধারণভাবে সব তফসিলী ব্যাংক বন্ধ থাকবে। এ সময়ে ব্যাংকের কর্মকর্তা কর্মচারীদের নিজ নিজ কর্মস্থলে অবস্থান করতে হবে। এতে আরও বলা হয়, সমুদ্র, স্থল, বিমান বন্দর এলাকায় অবস্থিত ব্যাংকের শাখা, উপশাখা ও বুথগুলো খোলা রাখার বিষয়ে বন্দর ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এসব খাতে ব্যাংকিং সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে স্ব স্ব ব্যাংক প্রয়োজনীয়তার নিরিখে বৈদেশিক বাণিজ্য শাখা সীমিত সংখ্যক জনবল নিয়ে খোলা রাখতে পারবে। একই সঙ্গে ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগ সীমিত সংখ্যক জনবল দ্বারা চালু রাখা যাবে। এতে আরও বলা হয়, এটিএম ও কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন চালু রাখার সুবিধার্থে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের সহায়তায় সর্বক্ষণিকভাবে খোলা থাকবে। এ জন্য এটিএম বুথগুলোতে পর্যাপ্ত নগদ অর্থের সরবরাহ রাখতে হবে। একই সঙ্গে ইন্টারনেট ব্যাংকিং সর্বক্ষণিকভাবে চালু রাখতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অপর এক সার্কুলারে বলা হয়, লকডাউনের মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ (চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ, মসুর ডাল, লবণ, চিনি, আদা, রসুন), পানি, শিশুখাদ্য ও অন্য খাদ্যসামগ্রী, মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, সব ধরনের চিকিৎসা সামগ্রী ও ইলেক্ট্রনিক সামগ্রী স্বাস্থ্যবধি মেনে উৎপাদন, আমদানি, পণ্য খালাস, পণ্য পরিবহন, কুরিয়ার ব্যবস্থা এবং ওয়্যারহাউস কার্যক্রম অব্যাহত রাখার বিষয়ে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে বাংলাদেশ ব্যাংককে অনুরোধ করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে আরও একটি সার্কুলার জারি করে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ও মোবাইল ব্যাংকিং পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান নির্বাহীদের কাছে পাঠানো হয়েছে। এই সার্কুলারে সরকার ঘোষিত বিধিনিষেধ চলাকালীন জনগণের অতি জরুরী প্রয়োজন ও অত্যবশ্যকীয় জরুরী পরিষেবা নিশ্চিত করতে দৈনন্দিন অর্থের সরবরাহ নিশ্চিত করতে এটিএম, ইন্টারনেট ব্যাংকিং ও মোবাইল ব্যাংকিং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বিধিনিষেধ চলাকালীন এটিএম বুথগুলোকে সচল ও তাতে পর্যাপ্ত নগদ অর্থ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে এটিএম বুথ থেকে দিনে সর্বোচ্চ একলাখ টাকা তোলা যাবে। আগে তোলা যেত ৫০ হাজার টাকা। এক্ষেত্রে টাকার পরিমাণ দ্বিগুণ বাড়ানো হয়েছে। বিভিন্ন এ্যাপসের মাধ্যমেও ওই পরিমাণ টাকা স্থানান্তর করা যাবে। এতে আরও বলা হয়, নিত্যপ্রয়োজনীয় অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ও সেবার সঙ্গে পরিচালিত মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রম সরকার নির্ধারিত সময়ের মধ্যে চালু রাখতে হবে। একই সঙ্গে এজেন্টদের কাছ থেকে গ্রাহকদের টাকা তোলার জন্য প্রয়োজনীয় নগদ অর্থের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। সরকার ঘোষিত সময়সীমা হচ্ছে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত। ফলে ওই সময়ে এজেন্টদের মাধ্যমে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালু থাকবে। তবে এ্যাপস বা মোবাইল ফোন সেটে এই সেবা সর্বক্ষণিকভাবে চালু থাকবে। এদিকে টানা আট দিন ব্যাংক বন্ধের খবরে মঙ্গলবার সকাল থেকে বিভিন্ন শাখার বাইরে গ্রাহকদের উপচেপড়া ভিড় দেখা গেছে। কার্যক্রম শুরুর আগেই বাইরে লাইনে দাঁড়ান অনেকে। নগদ টাকা তুলতে আসছেন গ্রাহকদের বড় অংশ। নির্দিষ্ট সংখ্যক গ্রাহককে ব্যাংকের ভেতরে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে। তাই অনেক শাখার বাইরে লাইন চলে এসেছে সড়ক পর্যন্ত। সেখানে শারীরিক দূরত্ব খুব একটা মানা হচ্ছে না। তবে ব্যাংকের ভেতরে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা হয়েছে। সঙ্কটে এবারও ভরসা রফতানি- রেমিটেন্স ॥ করোনা মহামারীর মধ্যে প্রবাসী আয়ে একের পর এক রেকর্ড হয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসেই সাড়ে ১৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিটেন্স এসেছে। এটি গত অর্থবছরের পুরো সময়ের চেয়ে ২ শতাংশ এবং একই সময়ের চেয়ে ৩৫ শতাংশ বেশি। অর্থাৎ গত অর্থবছরের পুরো সময়ের চেয়েও বেশি রেমিটেন্স এসেছে এই আট মাসে। এ ছাড়া চলতি অর্থবছরের মার্চ মাসে গত অর্থবছরের মার্চের তুলনায় ৫০ শতাংশের বেশি রেমিটেন্স বেড়েছে। রাজস্ব ও বিনিয়োগ বাড়ানোই বড় চ্যালেঞ্জ ॥ অর্থনীতিবিদরাও বলছেন, রফতানি ও রেমিটেন্সের পাশাপাশি এখন রাজস্ব ও বিনিয়োগ বাড়ানোই বড় চ্যালেঞ্জ। লকডাউনে স্বল্প আয়ের মানুষের জীবিকা হুমকিতে পড়বে। বেসরকারী গবেষণা সংস্থা উন্নয়ন অন্বেষণের চেয়ারপার্সন রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, ‘প্রথম ধাক্কা এখনও কাটেনি এবং সর্বজনীন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী ব্যবস্থাও গড়ে ওঠেনি। দ্বিতীয় ধাক্কায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকায় অভিঘাত আরও বেশি পড়বে।
×