ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মুজিববর্ষের উপহার দূর করেছে বিচ্ছিন্নতার কষ্ট

ঘর একটি হলেও অনেকের আশ্রয়, অযুত স্বপ্নবোনা

প্রকাশিত: ২৩:১১, ২৭ জানুয়ারি ২০২১

ঘর একটি হলেও অনেকের আশ্রয়, অযুত স্বপ্নবোনা

মোরসালিন মিজান ॥ মানুষ হয়েও জলেভাসা পদ্ম। শুকনো পাতার জীবন। সামান্য বাতাসে ওড়ে চলা। সঙ্গত কারণেই এ জীবনে বেদনার অন্ত ছিল না। এত এত বেদনা। তদুপরি ছিল বিচ্ছিন্নতার কষ্ট। নিজের জীবনের ঘানি একা নিজেকেই টানতে হয়েছে। আর কাউকে নিয়ে ভাববে যে, সুযোগ ছিল না। তবে মুজিববর্ষে ঘর পাওয়ার পর বদলে গেছে পুরনো হিসাব নিকাশ। একই মানুষের বুকে এখন অদ্ভুত বল। ভালবাসার বোধ আরও বেশি জাগ্রত হয়েছে। এর প্রভাবে একটিই ঘর হয়ে ওঠেছে অনেকের আশ্রয়। এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সন্তান ও বাবা মা চলে এসেছে এক চালের নিচে। একসঙ্গেই স্বপ্ন বুনছে তারা। পরস্পরের সুখে-দুঃখে পাশে থেকে বাকি জীবনটা কাটাতে চান। গত শনিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া উপহারে এভাবেই বদলে গেছে সবকিছু। ওইদিন সারাদেশে প্রায় ৭০ হাজার গৃহহীন ভূমিহীন পরিবারকে ঘর উপহার দেয়া হয়। দুই কামড়াবিশিষ্ট সেমিপাকা ঘর। সঙ্গে আছে রান্নাঘর। শৌচাগার। আর সামনে এক চিলতে উঠোন। কোন কোন ক্ষেত্রে স্বামী স্ত্রী দুজনকে জমিসহ একটি বাড়ি উপহার দেয়া হয়েছে। আবার বিধবা স্বামী পরিত্যাক্তা অসহায় নারী একাই জমিসহ ঘরের মালিকানা পেয়েছেন। তবে যার বা যাদের নামে ঘর, শুধু তারাই ঘরে থাকবেন এমনটি নয়। বরং কেউ একই রকম চালচুলোহীন বড় সন্তানকে ডেকে এনে নিজ গৃহে জায়গা করে দিচ্ছেন। ছেলে আর ছেলের বউয়ের জন্য ছেড়ে দিচ্ছেন একটি কামড়া। কেউ পাশে রাখছেন নাতি নাতনিকেও। এভাবে দারুণ এক পুনর্মিলনী। একসঙ্গে বাঁচা। গত কয়েকদিনে দেশের চারটি জেলার আশ্রয়ণ প্রকল্প ঘুরে উপকারভোগীদের সঙ্গে কথা বলে এমন ধারণা পাওয়া গেছে। নারায়ণগঞ্জ কিশোরগঞ্জ ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও হবিগঞ্জের প্রায় সবকটি গৃহে চলছিল রিইউনিয়নের প্রস্তুতি। নতুন ঘরে বা ঘরের রাড়ান্দায় দাঁড়িয়ে ভাগ্যবানের প্রায় প্রত্যেকই বলছিলেন, পরিবারের আরও যারা অসহায় তাদের এখানে নিয়ে আসবেন। এক চালের নিচেই সুখে দুঃখে থাকবেন তারা। হোক ছোট, সে তো অন্যের কাছে। তাদের কাছে ঘরগুলো ঘরের অধিক। অনেক বড়। হবিগঞ্জ জেলায় ঘর পেয়েছে ৭৮৭টি পরিবার। চুনারুঘাটের ইকরতলী আশ্রয়ণ প্রকল্পে জায়গা হয়েছে ৭৪টি পরিবারের। একেকটি ঘরের একেক রকম গল্প। তেমনি এক ঘরের মালিক রফিকুন্নেসা জয়তুন। তিনি বলছিলেন, আমার স্বামী বহু বছর আগে মারা গেছে। এরপর থেকে নিদারুণ কষ্টে কেটেছে জীবন। এ পর্যায়ে এসে একটি ঠিকানা হয়েছে তার। এখন তিনি তার মেয়েকে নিয়ে এই ঘরে থাকতে চান। কেন? জানতে চাইলে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন বৃদ্ধা। বলেন, আমার মতো আমার মেয়ের জীবনও তছনছ হয়ে গেছে। স্বামীর ঘরে সে ভাল নেই। আমি যৌতুক দিতে না পারায় সকাল বিকেল মেয়েটাকে নির্যাতন করছে। পিটিয়ে আমার মেয়ের হাত পা পচিয়ে ফেলেছে ওরা। যেহেতু একটা ঘর পেয়েছি, এখন ঠিক করেছি, মেয়েটাকে আমার কাছে নিয়ে আসবো। অর্থাৎ,এক গৃহ দুই নারীর জীবন বাঁচানোর উপলক্ষ্যে হয়েছে। এরচেয়ে ভাল আর কী হতে পারে? ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় নির্মিত আশ্রয়ণ প্রকল্পে বাসা পেয়েছেন আসহায় বৃদ্ধ নুরু মিয়া। এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে এই ঘরে বাস করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। তারও একটি মেয়ে কপাল পুড়েছে। স্বামীর ঘর করতে পারেনি। বের করে দেয়া হয়েছে। মেয়েটিকে নিজের ঘরে এনে রাখতে চান বলে জানান তিনি। বলেন, ‘মায়াডার আমি ছাড়া কেউ নাই। কই যাইবো? তাই নিয়া আসতাছি। এই ঘরডা আছে বইলাই ইজ্জত নিয়া থাকতে পারবো।’ বাবা মেয়ের নতুন সংসার সুখের হবে বলেই আশা তার। নারায়ণগঞ্জের মোড়াপাড়া আশ্রয়ণ প্রকল্পের ১০ নম্বর ঘরটি পেয়েছেন শফিকুল আলম। ৬০ বছর বয়সী শফিকুলের শরীরের বাম পাশ স্থবির হয়ে গেছে। একটি হাত ও একটি পা কাজ করে না। এ অবস্থায় স্ত্রীকে পাশে চান তিনি। কিন্তু তিনি থাাকেন ঢাকায়। গৃহপরিচারিকার কাজ করেন। ফলে আরও বেশি অসহায় বোধ করছিলেন তিনি। তাই ঘর পাওয়ার পর তাদের পরিকল্পনায় পরিবর্তন আসছে। শফিকুল বলছিলেন, ঘরের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। খাওয়ার জন্য আটকাবে না। স্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে। ঢাকার কাজ ছেড়ে এখানে এসে ওঠবে সে। এখানেই কিছু একটা কাজের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। স্ত্রী এরইমাঝে একবার বাসা ঘুরে দেখে গেছেন বলে জানান তিনি। কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে ঘর পেয়েছেন শাহজাহান খাতুন। বয়স অনেক হয়েছে। স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকে একাই জীবনযুদ্ধে লড়ছেন। ছেলে বড় হয়েছে। বিয়ে করেছে। নাতি নাতনিও হয়েছে। কিন্তু অভাবের কারণে একসঙ্গে থাকা হয় না তাদের। বাসা বুঝে পাওয়ার কথা নিশ্চিত করে তিনি বলছিলেন, ‘এক রুমে আমি নাতি নিয়া থাকমু। আরেক রুমে বউ নিয়া পুলায় থাকবো। জাগা তো কম না।’ ছেলে আপনাকে দেখার কথা। আপনি কেন তাদের দেখবেন? এমন প্রশ্নে তার জবাব: ‘আমার জীবন যেমন পথে ঘাটে কাটছে। হের জীবন যেন না কাটে। আমার তো বয়স হইছে। মরার সময় পোলা সামনে থাকলে অন্তত নিজের হাতে মাটি দিতে পারবো।’ শিশুরা অত কিছু বুঝে না। তবে নতুন ঘর যে হয়েছে, সেটা বুঝে। তাই আনন্দে মাতোয়ারা। মোড়াপাড়া আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর পাওয়া পরিবারের মেয়ে ইভা দুই কক্ষের একটি দেখিয়ে সে বলছিল, এখানে আমি ফুল দিয়ে সাজাবো। তারপর আমার বড় বোনকে আর ছোট বোনকে নিয়ে থাকব এই ঘরে। দরজা ঠেলে পছন্দের কক্ষটি দেখাতেও ভুল করে না সে। এভাবে ছোট্ট এক একটি ঘর অনেকের আশ্রয় হয়ে ওঠছে। আগামীর স্বপ্ন একসঙ্গে বুনার প্রস্তুতি নিচ্ছে অসহায় মানুষ।
×