ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী গরুরগাড়ি

ওকি গাড়িয়াল ভাই ... পথেঘাটে শোনা যায় না আর এমন গান

প্রকাশিত: ২৩:১১, ১৮ জানুয়ারি ২০২১

ওকি গাড়িয়াল ভাই ... পথেঘাটে শোনা যায় না আর এমন গান

বিশ্বজিৎ মনি ॥ ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই... কত রব আমি পন্থের দিকে চাইয়ারে’—-মাঠে ঘাটে পথে প্রান্তরে এমন গান আর শোনা যায় না। গরু বা মহিষের গাড়ি নিয়ে উচ্চৈস্বরে এমন গানের হাঁক আর শোনা যায় না। সভ্যতার প্রায় উন্মেষকাল থেকেই বাংলাদেশের সর্বত্রই যাতায়াত ও পরিবহনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ছিল ‘গরুরগাড়ি’। কিন্তু আধুনিক সভ্যতার বিবর্তনে যন্ত্রচালিত লাঙল বা পাওয়ার টিলার এবং নানা যন্ত্রযানের উদ্ভবের ফলে বিলুপ্তির পথে আজ ‘গরুরগাড়ি’। মৎস্য ও শষ্যভাণ্ডারখ্যাত উত্তরের নওগাঁ জেলার সর্বত্রই এক সময়ের যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম গ্রামবাংলার জনপ্রিয় ঐতিহ্যবাহী গরুরগাড়ি আজ বিলুপ্তির পথে। নতুন নতুন প্রযুক্তির ফলে মানুষের জীবনযাত্রার উন্নয়ন ঘটেছে। পক্ষান্তরে হারিয়ে যাচ্ছে অতীতের এই ঐতিহ্য। গরুরগাড়ির ইতিহাস সুপ্রাচীন। খ্রিস্টজন্মের ১৫০০-১৬০০ বছর আগেই সিন্ধু অববাহিকা ও ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে গরুরগাড়ির প্রচলন ছিল। সেখান থেকে ক্রমে ক্রমে দক্ষিণেও ছড়িয়ে পড়ে। গ্রাম বাংলার এ ঐতিহ্য আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। একসময় উত্তরাঞ্চলের পল্লী এলাকার জনপ্রিয় বাহন ছিল গরুরগাড়ি। বিশেষ করে এই জনপদে কৃষি ফসল ও মানুষ বহনের জনপ্রিয় বাহন ছিল এটি। যুগের পরিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে এই বাহন। মাঝেমধ্যে প্রত্যন্ত এলাকায় দু’/একটি গরুরগাড়ি চোখে পড়লেও শহরাঞ্চলে একেবারেই দেখা যায় না। সে কারণে শহরের ছেলেমেয়েরা দূরের কথা, বর্তমানে গ্রামের ছেলেমেয়েরাও গরুরগাড়ি শব্দটির সঙ্গে তেমন পরিচিত নয়। এমনকি অনেক শহুরে শিশু গরুরগাড়ি দেখলে বাবা-মাকে জিজ্ঞেস করে গরুরগাড়ি সম্পর্কে। গরুরগাড়ি দুই চাকাবিশিষ্টÑ গরুতে টানা এক প্রকার বিশেষ যান। এ যানে সাধারণত একটি মাত্র অক্ষের সঙ্গে চাকা দুটি যুক্ত থাকে। গাড়ির সামনের দিকে একটি জোয়ালের সঙ্গে দুটি গরু জুটি মিলে গাড়ি টেনে নিয়ে চলে। সাধারণত চালক বসেন গাড়ির সামনের দিকে। আর পেছনে বসেন যাত্রী বা মালপত্র। বিভিন্ন মালপত্র বহন করা হয় গাড়ির পেছনদিকে। কৃষিজাত দ্রব্য ও ফসল বহনের কাজে গরুর গাড়ির প্রচলন ছিল ব্যাপক। দুই যুগ আগেও গরুরগাড়িতে চড়ে বিয়ের বর-বধূ যেত। গরুরগাড়ি ছাড়া বিয়ে কল্পনাও করা যেত না। বিয়েবাড়ি বা মাল পরিবহনে গরুরগাড়ি ছিল একমাত্র পরিবহন ব্যবস্থা। গরুরগাড়ির চালককে বলা হয় গাড়িয়াল। আর তাই চালককে উদ্দেশ করে রচিত হয়েছে ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই’ কিংবা ‘আস্তে বোলাও গাড়ি, আরেক নজর দেখিয়া ন্যাং মুই দয়ার বাপের বাড়িরে গাড়িয়াল’ এ রকম যুগান্তকারী সব ভাওয়াইয়া গান। বর্তমানে নানা ধরনের মোটরযানের কারণে অপেক্ষাকৃত ধীরগতির এই যানটির ব্যবহার অনেক কমে এসেছে। তাই এখন আর তেমন চোখে পড়ে না। বর্তমান যুগ হচ্ছে যান্ত্রিক যুগ। এখনকার মানুষ বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজনীয় মালামাল বহনের জন্য বাহন হিসেবে ব্যবহার করছে ট্রাক, পাওয়ার টিলার, লরি, নসিমন-করিমনসহ বিভিন্ন মালবাহী গাড়ি। মানুষের যাতায়াতের জন্য রয়েছে মোটরগাড়ি, রেলগাড়ি, বেবিট্যাক্সি, অটোরিক্সা ইত্যাদি। ফলে গ্রামাঞ্চলেও আর চোখে পড়ে না গরুরগাড়ি।
×