ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রণব মজুমদার

আলো ভূত অদ্ভুত

প্রকাশিত: ২৩:৪৭, ২ জানুয়ারি ২০২১

আলো ভূত অদ্ভুত

-আর করবি দুষ্টুমি? যাবি আর অই খানে? ক আর যাবি? -না মা না! আর যামু না! আর মাইরো না! বেতের আঘাতে ছেলের পিঠটা লাল হয়ে গেছে! তার রক্তাক্ত রূপ দেখে মায়ের নিজেরই কান্না পায়! শাড়ির আঁচল টেনে চোখের জল মুছেন মা! নারুর স্কুলে এখন গ্রীষ্মের ছুটি। মেধাবী ছেলে সে। গণি মডেল স্কুলের ক্লাস ফোরের ফার্স্টবয় হলেও ভারি দস্যি বালক সে! সারাদিন এ বাড়ি আর ও বাড়ি! গাছের ফল ফলাদি না বলে পেড়ে খাওয়া, পুকুরের মাছ তুলে আনা, কারও ঘরের চালে ঢিল মারা, শিশুদের জ্বালাতন করা, কারও মাটির কলসী ভেঙ্গে দেয়া, খাঁচায় রাখা পশু পাখিকে ছেড়ে দেয়া ইত্যাদি নানা দুষ্টুমিতে দিন কাটে তার। এসব মন্দ কাজে প্রায় সময়ই মায়ের কাছে নারুর নামে নানাজনের অভিযোগ! বিকেলে যখন সে ঘর ফিরে তখন ঘরে রাখা বেত দিয়ে শুরু হয় মায়ের কড়া শাসন! নারুর বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ! নালিশ করেছেন জেঠিমা! মানে রমেশ দত্তের স্ত্রী শান্তি রাণী। মাকে এসে শাসিয়ে গেছেন! ‘তোমার দুষ্টের শিরোমণি ছেলেডারে সামলাও নীলু! অয় আমার ছেলে বাপ্পীরে ধাক্কা দিয়া পুকুরে ফালাইয়া দিসে! গাজী বাড়ির রাজ্জাইক্কা অরে না উঠাইলে মইরাই যাইতো অয়!’ আজকের মায়ের কড়া উত্তম মধ্যমের বিষয়টি নারু ভূঁইয়া বাড়ির মিলন ও খাঁ বাড়ির কবীরকে জানায়! ওরা তিন বন্ধু মিলে ঠিক করলো জেঠিমাকে জব্দ করবে। দত্ত পুকুরে সকালে নারুর বড়শীতে ছোট একটি কচ্ছপও উঠে। ঘরের পিছনে এনে তা উপুড় করে ঢেকে রাখে সে। কবীরদের ঘরে বসে পরিকল্পনা করে ওরা! আজই হবে জেঠিমার ঘর এবং পিছনের অপারেশন! পাটোয়ারী বাড়ির হানিফ, জয়নাল ও কুদ্দুসের সঙ্গে তিন বন্ধুর মিশন! পরিকল্পনা অনুযায়ী হানিফ, কুদ্দুস আম ও চালতে পেরে নিয়ে আসবে! সহযোগিতা করবে জয়নাল ও মিলন! শর্ত হলো যা সংগ্রহ হবে তার সমান ভাগ সবার। নারু ও কবীর কৃপণ ও বদরাগী জেঠিমাকে ঘরের মধ্যে সামলাবে। দত্ত বাড়ির বিশাল বাগান ও পুকুরের কোন জিনিস কেউ সহজে নিতে পারে না! এর মূল কারণ এই শান্তি রাণী। প্রায় রাত জেগে থাকেন জেঠিমা। কোন শব্দ হলেই ঘর থেকে আওয়াজ তুলেন ‘কে রে, কে রে।’ মা সন্ধ্যাবাতি জ্বালিয়ে ধূপের প্রদীপ নিয়ে উঠান প্রদক্ষিণ করলেন! ঠাকুরমার দেয়া দুধ খেয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায় নারু। পকেটে নেয় লক্ষ্মী পূজার সময় কেনা দুটি মোমবাতি। ঘরের পিছনে রাখা ছোট কচ্ছপটি নিয়ে আসে। কচ্ছপটি একটা শক্ত ঠোঙায় ভরে নেয়। একটুও ভয় নেই তার। আকাশে বিদ্যুত চমকাচ্ছে! বাজ পড়ার শব্দ হচ্ছে! মাঠ পেরিয়ে কবীরদের ঘরের সামনে যেতে যেতে ভাবলো আজকের অভিযানটা ভালই হবে। জেঠিমা বাজের আওয়াজকে ভয় পান! চোখ বন্ধ করে কানে আঙুল রেখে তিনি বলতে থাকেন হরিবোল! হরি...বোল। ঘোর অন্ধকার। মিলনসহ পাটওয়ারী বাড়ির ওরা বাগানে অবস্থান নিয়েছে। জেঠিমাদের থাকার চারখানা ঘর! এই ঘরে দুটি খাট! ঘরে আজ শুধু জেঠিমা ও ভবানী দিদি। ঘর বন্ধ। ঝড় আসছে ভেবে দত্ত বাড়ির সবাই ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে দিল। জেঠিমা জপ করছেন। অন্ধকার ঘর। কবীর ঘরের অবস্থাটা পরখ করল। শক্ত কাঠের মজবুত ঘরে হালকা ছিদ্র দিয়ে দেখে নেয় নারুও। আঙুল লম্বা করে ঠোঁটের ওপর রেখে সাবধানী সংকেত দেয় কবীরকে! অস্পষ্ট ভাঙ্গা গলার স্বরে নারুর সংলাপ। - চুপ! জেঠিমাদের রান্নাঘরের সামনের সিঁড়িতে গিয়ে বসে নারু। নারুর কাছ থেকে ম্যাচবাতি নেয় কবীর! তারপর মোমে দিয়াশলাইয়ের কাঠিতে আগুন ধরিয়ে দেয় সে। ভয়ার্ত নারু ঠোঙা থেকে কচ্ছপটা বের করে। মোমের নিচে আগুন লাগিয়ে তা নরম করে নেয়। তারপর কচ্ছপের পিঠে মোমবাতিটি বসায় দুষ্টু নারু। ঘরের পিছনের বাগান থেকে নিচে কিছু পড়ার শব্দ হচ্ছে - ধুপ! ধুপ! জেঠিমা চেঁচিয়ে ওঠেন - কে রে গাছে, কে রে? নারু দেরী করে না। মোমবাতি প্রজ্বলিত কচ্ছপটি জেঠিমার ঘরের পাটাতনের নিচ দিয়ে ছেড়ে দেয়। দু’জনে মজা দেখছিল ঘরের গোপন ছিদ্রপথ দিয়ে। অনেক কষ্টে হাসি চেপে রাখল ওরা। ভবানী অন্য খাটে শুয়ে আছে। জেঠিমা ছটফট করছেন। আর গালমন্দ করছেন। বাজের গুড়ুম গুড়ুম শব্দে ভয়ার্ত জেঠিমা খাটে উঠে বসেছেন। কিছু পড়ার শব্দ হলো ঘরে! আস্তে আস্তে কালো কচ্ছপটি এগুচ্ছে। শুধু আলোটাই দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ জেঠিমা দেখলেন আলোটা তার দিকে আসছে। চিৎকার করে উঠলেন তিনি। -ভবানীলো ও ভবানী! রাম রাম রাম রাম! ঘরে ভূত আইছে। আলো ভূত! তুই কই? আলো মাইয়া উইঠ্ঠা দ্যাখ! যতই আলোটা জেঠিমার খাটের দিকে এগুচ্ছে ততই তিনি পিছনে সরছেন। আর বলছেন- রাম রাম রাম রাম! জেঠিমা গোঙাতে শুরু করলেন। এক সময় খাট থেকে নেমে পড়লেন তিনি। ভয়াতুর জেঠিমা বড় একটা চিৎকারে লুটে পড়লেন পাকা মেঝেতে। জ্যাঠামশাইয়ের খাট থেকে দৌড়ে এলো ভবানী! ‘কি অইছে মা কি অইছে তোমার।’ কপি জ্বালিয়ে ভবানী দেখলো জেঠিমার দাঁতে দাঁত লেগে আছে। শাড়ির নিচ অংশ ও মেঝটা বেশ ভেজা! বাজে গন্ধ বেরুচ্ছে। জেঠিমা ও ভবানীর অবস্থা দেখে নারু ও কবীর সটকে পড়ে! যেতে যেতে নারু ভাবল এতটা করা ঠিক হয়নি। যদি টের পেয়ে যায়! তাহলে মায়ের কাছে আর রক্ষা নেই! দত্ত পুকুরের পাকা ঘাটের দিকে এগোয় ওরা। উৎফুল্লকবীর নারুর বিমর্ষ মুখের দিকে তাকিয়ে বলে - কিপটা জেডির শিক্কাটা বড় অইয়া গ্যালো নারে? দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নারুর উত্তর - - হ! আলো ভূত! সত্যিই অদ্ভুত!
×