ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বেড়েছে ইন্টারনেটভিত্তিক বা অনলাইন ব্যাংকিং ও মোবাইল ব্যাংকিং লেনদেন

মহামারীতে ভার্চুয়াল ব্যাংকিং

প্রকাশিত: ২১:১৯, ১ জানুয়ারি ২০২১

মহামারীতে ভার্চুয়াল ব্যাংকিং

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ করোনা সংক্রমণের শুরুতে সাধারণ ছুটিতে সব কিছু বন্ধ থাকলেও ব্যাংকগুলো সীমিত পরিসরে খোলা ছিল। কিন্তু খোলা থাকলেও স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেনি ব্যাংকগুলো। বিশেষ করে ঋণ বিতরণ সীমিত আকারে করেছে ব্যাংকগুলো। আর সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নেও শতভাগ সফলতা আসেনি ব্যাংকগুলোর। বড় খাতে ঋণ বিতরণ বাড়লেও ক্ষুদ্র, অতিক্ষুদ্র ও মাঝারি এবং কৃষি খাতে বিতরণ ছিল হতাশাজনক। তবে দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে ইন্টারনেট ভিত্তিক বা অনলাইন ব্যাংকিং। লেনদেন বেড়েছে মোবাইল ব্যাংকিংয়েরও। বিভিন্ন ব্যাংকের পর্ষদ সভা করতে হয়েছে ভার্চুয়াল মাধ্যমে। বছরজুড়ে মহামারী সঙ্কটের মধ্যেই রেমিটেন্সের সঙ্গে রেকর্ড গড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও। গত বছরের শেষ কর্মদিবস শেষে সেই রিজার্ভ ৪৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। করোনাতেও আশা দেখিয়েছে রেমিটেন্স ও রিজার্ভ : মহামারীর মধ্যেও উজ্জ্বল অর্থনীতি গুরুত্বপূর্ণ দুই সূচক। দুরন্ত গতিতে ছুটছে রেমিটেন্স আয়। আর শক্তিশালী রেমিটেন্স আয়ে নতুন উচ্চতায় এখন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। উন্নয়ন প্রকল্পে রিজার্ভের অর্থ ব্যবহার করারও উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। আজ থেকে ৪০ বছর আগে ১৯৮১-৮২ অর্থবছরে বাংলাদেশের বিদেশী মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ ছিল মাত্র ১২ কোটি ১০ লাখ ডলার। এখন সেই রিজার্ভ ৪ হাজার ৩০০ কোটি ডলার। বাংলাদেশের ইতিহাসে এত বেশি রিজার্ভ আগে কখনই ছিল না। রফতানি আয় এবং প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স বাড়ায় অর্থনীতির অন্যতম প্রধান সূচক রিজার্ভ বাড়তে বাড়তে এ মাইলফলক অতিক্রম করেছে। এদিকে ২০২০ সালে প্রবাসীরা ২০ বিলিয়ন ডলার বা ২ হাজার কোটি ডলারেরও বেশি রেমিটেন্স দেশে পাঠিয়েছেন, যা ২০১৯ সালের পুরো সময়ের চেয়ে বেশি। এর আগে এক বছরে বাংলাদেশে এত রেমিটেন্স আর কখনও আসেনি। করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও অনেক কোম্পানি শ্রমিকদের বাধ্যতামূলক ছুটি দিয়ে দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। এজন্য যাদের ছুটি দেয়া হচ্ছে তাদের ক্ষতিপূরণ বাবদ কিছু অতিরিক্ত অর্থও দিচ্ছে কোম্পানিগুলো। সেটা তারা দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। আবার অনেকে হয়তো দেশে ফিরবে সে জন্য ধীরে ধীরে জমানো টাকা দেশে আনার কাজ শুরু করেছেন বলেও রেমিটেন্স বেশি এসেছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। এর বাইরে সরকার যে দুই শতাংশ হারে প্রণোদনা ঘোষণা করেছিল, তারও ইতিবাচক প্রভাব রেমিটেন্সের ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। অনলাইন ব্যাংকিংয়ের প্রসার ॥ দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে ইন্টারনেট ভিত্তিক বা অনলাইন ব্যাংকিং। চলতি বছরের এপ্রিল থেকে অক্টোবর এই সাত মাসে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩ হাজার ৯৮৯ কোটি টাকা লেনদেন বেড়েছে। ২০২০ সালের এই সাত মাসে ইন্টারনেট ব্যাংকিং এ লেনদেন হয়েছে ৪৩ হাজার ৯৬৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা। ২০১৯ সালে একই সময়ে লেনদেনের পরিমাণ ছিলো ৩৯ হাজার ৯৭৬ কোটি ৭০ লাখ টাকা। করোনার প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ায় শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে ইন্টারনেটভিত্তিক ব্যাংকিংকে বেছে নিচ্ছেন গ্রাহকরা। বেড়েছে ইন্টারনেট ব্যাংকিং ॥ ইন্টারনেটের মাধ্যমে সম্পন্ন সাধারণ ব্যাংকিং কার্যক্রমকেই ইন্টারনেট ব্যাংকিং বা অনলাইন ব্যাংকিং বলে। এক্ষেত্রে ইন্টারনেটে যুক্ত হয়ে ব্যাংকের নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটের মাধ্যমে একজন গ্রাহক তার ব্যাংক এ্যাকাউন্টে প্রবেশ করেন। এ্যাকাউন্টে প্রবেশের জন্য ব্যাংক গ্রাহককে প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করে। ইন্টারনেট ব্যাংকিং ব্যবহার করে মোবাইল এ্যাপসের মাধ্যমেও গ্রাহকরা হিসাব খোলা, পরিবর্তন বা স্থানান্তর, বিল পরিশোধ, মোবাইল রিচার্জ, এটিএম ও শাখার লোকেশন, মিনি ও বিস্তারিত স্টেটমেন্ট, লেনদেনের সার্বিক বিবরণী, ঋণসংক্রান্ত তথ্য, ক্রেডিট কার্ডের বিল পরিশোধসহ অন্যান্য এ বছর বেশি হয়েছে। সিঙ্গেল ডিজিটে সুদ হার বাস্তবায়ন ॥ অনেক আলোচনার মধ্যে ব্যাংক ঋণে সুদ হার সিঙ্গেল ডিজিট এ বাস্তবায়ন হওয়ার খবরও গতবছরের আলোচিত খবর। করোনা সঙ্কট মোকাবেলায় সরকার যেসব পরিকল্পনা নিয়েছে এক অঙ্কে সুদ হার ছিল অন্যতম সহায়ক সংযোজন। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী ১ এপ্রিল থেকে ক্রেডিট কার্ড ছাড়া ব্যাংকঋণের সুদ হার ৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংক ব্যবসায় ভাটা ॥ করোনা সঙ্কটে ব্যাংক খাত ছিল মুনাফা বিমুখ। প্রতি বছর লাভের আশা করলেও সঙ্কটকালীন মুহূর্তে মুনাফাকে প্রাধান্য না দিয়ে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে গ্রাহকদের পাশে দাঁড়িয়ে টিকে থাকার লড়াই করেছেন ব্যাংকগুলো। গতবছরে অর্থনীতির ক্ষতি মোকাবেলায় ঋণ আদায়ে নিষেধাজ্ঞা, এক অঙ্কে সুদহার নির্দেশনাসহ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা নির্দেশনা জারিতে গতবছরটা ছিল ব্যাংক ব্যবসার ভাটার বছর। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে, এপ্রিল থেকে জুন প্রান্তিকে ব্যাংকগুলো খেলাপী ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলো আদায় করেছে ৯৯৬ কোটি টাকা যা, আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা কম। সে সময় আদায়ের পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ৯১২ কোটি টাকা। একই সময়ে নিয়মিত ঋণের বিপরীতে আদায় হয়েছে ১ লাখ ৮ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। আগের বছরের একই সময়ে আদায় থেকে কম হয়েছে ৫৩ হাজার ৫৮৮ কোটি টাকা। অপরদিকে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ৩০ ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত জানুয়ারি থেকে জুন সময়কালে আমানতকারীদের ঋণের বিপরীতে সুদ বাবদ আয় করেছে ৩১ হাজার ৪২৪ কোটি টাকা, যা গত বছরের একই সময়ে তুলনায় ৩৫১ কোটি টাকা বা ১.১১ শতাংশ কম। এবিবি’র সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, মহামারির কারণে দেশের ব্যবসা পরিস্থিতি ভালো নেই। ফলে অনেকেই ঠিকমতো ঋণ পরিশোধ করতে পারবেনা। তারওপর এক অংকের সুদের হার বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আগামীতে ব্যাংকগুলোর নিট মুনাফায় ধাক্কা লেগেছে। ইতোমধ্যেই অনেক ব্যাংকেরই ঋণ দেয়া ও টাকা ফেরত আসার পরিমাণ কমে গেছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ব্যাংকের মুনাফায় ধস নেমেছে। বিশেষ ছাড়ে আলোচনায় খেলাপী ঋণ ॥ দেশের ব্যাংক খাতের খেলাপী ঋণ এখন বিষফোঁড়া। করোনা সঙ্কটে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের দিক বিবেচানায় নানা সুবিধা প্রদান করায় ব্যাংকিং খাতে খেলাপী ঋণের উল্টোচিত্র দেখালো ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপী ঋণের পরিমাণ (জুলাই-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) ৯৪ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা যা মোট বিতরণের ৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ। জুন প্রান্তিকে ব্যাংক খাতে খেলাপী ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৬ হাজার কোটি টাকা, যা মোট বিতরণের ৯ শতাংশ। অপরদিকে মার্চ শেষে খেলাপী ঋণের পরিমাণ ছিল ৯২ হাজার ৫১০ কোটি টাকা। প্রকৃতভাবে দেশের খেলাপী ঋণের পরিমাণ অনেক বেশি। করোনায় অর্থনীতির ক্ষতি বিবেচনায় তিন দফায় জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত কাউকে খেলাপী না করার নির্দেশ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নির্দেশনা প্রত্যাহার করলে খেলাপী ঋণের পরিমাণ আবার বাড়বে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। কর্মীছাঁটাই আতঙ্ক ॥ করোনায় আর্থিক দুর্যোগে ব্যাংক খাতে কর্মী ছাঁটাই আতঙ্কও ছিল বিদায়ী বছরের সবচাইতে অমানবিক খবর। করোনা দুর্যোগে পুরোনো ধ্যান ধারণা নিয়ে বহুকর্মীকে ছাঁটাই করেছে বেসরকারী ৪ ব্যাংক। যদিও পরবর্তীতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সরনাপন্ন হয়ে কেউ কেউ চাকরি ফিরে পেয়েছেন। ছাঁটাইয়ের পাশাপাশি বেতন-ভাতাদিসহ নানা সুযোগ-সুবিধা কমানোর ঘোষণাও দিয়েছে অনেক ব্যাংক। আরও একটি ব্যাংকের অনুমোদন ॥ করোনাকালে সিটিজেন ব্যাংক লিমিটেড নামে আরও একটি বেসরকারী ব্যাংকের অনুমোদন দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক পাঁচশত কোটি টাকার পরিশোধিত মূলধনসহ প্রয়োজনীয় সব শর্ত পূরণসাপেক্ষে ব্যাংকটির কার্যক্রম পরিচালনা করার চূড়ান্ত অনুমতি দিয়েছে। নতুন এ ব্যাংক নিয়ে দেশে মোট ব্যাংকের সংখ্যা দাঁড়ালো ৬১টি।
×