ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

সবজিতে সবুজ পদ্মার চরাঞ্চল ॥ চোখ জুড়াচ্ছে চাষীদের

প্রকাশিত: ১৯:৫৬, ২৮ নভেম্বর ২০২০

সবজিতে সবুজ পদ্মার চরাঞ্চল ॥ চোখ জুড়াচ্ছে চাষীদের

মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী ॥ রাজশাহীর পদ্মা নদীর বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে চর। সেই চরে এখন সবুজের সমারোহ। শীতকালীন নানা সবজিতে ভরে উঠেছে চরাঞ্চল। জেলার বাঘা, চারঘাট, গোদাগাড়ী ও পবার এই চার উপজেলায় চরের বেলে দোআঁশ মাটিতে চাষীরা ফলিয়েছেন সোনার ফসল। চরাঞ্চলে সবজির প্রাচুর্য দেখে যে কারও চোখ জুড়াবে। চোখ জুড়াচ্ছে চাষীদেরও। তবে দামে মন ভরছে না তাদের। শুধু যোগাযোগ ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে চাষীদের লাভ হচ্ছে কম। রাজশাহীর গোদাগাড়ী, পবা, চারঘাট ও বাঘা উপজেলায় পদ্মার চরে জেগে ওঠা জমির পরিমাণ ১৪ হাজার ৪৪ হেক্টর। এর মধ্যে আবাদি জমির পরিমাণ ৭ হাজার ৯৪৮ হেক্টর। এবার এসব চরের ৬৬৫ হেক্টর জমিতে সবজি চাষ হয়েছে। পবা উপজেলার চর মাজারদিয়ায় এখন টমেটো, বাঁধাকপি, বেগুন, শিম, লাউ, পেঁপেসহ নানা তরতাজা সবজিতে ভরে আছে মাঠ। এই চরে পেয়ারা এবং ড্রাগন ফলেরও বাগান হয়েছে। পেঁয়াজ, রসুন, মাসকলাইসহ আরও নানা ফসল চাষ করেছেন চাষীরা। কৃষকরা জানিয়েছেন, বেলে দোআঁশ মাটিতে সার দেয়ার প্রয়োজন হয় না। পোকামাকড়েরও আক্রমণ কম। তাই খুব একটা কীটনাশক প্রয়োগের প্রয়োজন পড়ে না। শুধু পানি পেলেই চরে সব ফসলের আবাদ ভাল হয়। কিন্তু শুধু যোগাযোগ ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে তারা সবজির দাম পান কম। এখন পাতকুয়ার কারণে সেচের যোগানও হচ্ছে। চর মাজারদিয়া গ্রামের চাষী ফারুক হোসেন বলেন, নদী বড় থাকলে নৌকায় তাদের যোগাযোগ সহজ হয়। কিন্তু তখন পানি ঢুকে তাদের চাষের জমি কমে যায়। আবার পানি নেমে গেলে যে পলি পড়ে তাতে সবজির চাষ হয় ভাল। কিন্তু তখন নৌপথ কমে গিয়ে বেড়ে যায় পায়ে হাঁটার পথ। এই দুর্গম চর থেকে তাদের সবজি ওপারের বাজারে নিতে নিতেই তাজা সবজি আর তাজা থাকে না। তখন পাইকারি ক্রেতারা দাম কম দেন। আবার অনেক ব্যবসায়ী চরে সবজি কিনতে আসেন। কিন্তু বিশাল চর আর নদী পাড়ি দিয়ে সবজি নিয়ে যেতে হবে বলে তাদের কম দাম দেয়া হয়। এতে তাদের ক্ষতি না হলেও লাভের পরিমাণ কমে যায়। একই এলাকার টমেটো চাষী সোহরাব আলী বলেন, নদীর ওপারে যদি টমেটোর কেজি ১০০ টাকা হয়, তাহলে এপারে ৫০ টাকা। একটা নদীর এপার-ওপারে দামের এমন পার্থক্য। সোহরাব বলেন, গ্রীষ্মকালে পানি কমে নদী ছোট হয়ে আসে। তখন সবজি গরু-মহিষের গাড়ি অথবা ট্রলিতে করে নিয়ে চর পাড়ি দিতে হয়। কিন্তু চরের মাঝে যদি আবার ছোট নদী থাকে তাহলে ভোগান্তি আরও বেড়ে যায়। এসব ভোগান্তির কারণেই তারা ভাল সবজি উৎপাদন করলেও ভাল দাম পান না। পবার হরিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বজলে রেজবী আল হাসান মুঞ্জিল বলেন, চরের সবজি খুব সুস্বাদু। নদীর ওপারের সবজি আর এপারের সবজির স্বাদের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাত। চরাঞ্চলের সবজির স্বাদ ভাল হওয়ার কারণ এখানে জমিতে সার-কীটনাশকের প্রয়োজন হয় না। শুধু পানি পেলেই চরে খুব ভাল সবজি উৎপাদন হয়। কিন্তু এত ভাল সবজি উৎপাদন করেও চাষীরা ভাল মূল্য পান না। তিনি বলেন, নদীপাড় থেকে চরের গ্রাম পর্যন্ত যদি পাকা রাস্তা নির্মাণ করা যায় তাহলে চাষীদের কষ্ট অনেক কমে যাবে। চাষীরা অন্তত সহজে নদীপাড় পর্যন্ত তাদের ফসল নির্বিঘ্নে নিয়ে যেতে পারবেন। চর মাজারদিয়া এলাকায় আমরা এ রকম একটা রাস্তা নির্মাণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এদিকে বাঘায় নদীতে চর জেগে ওঠা এসব জমিতে এখন সারা বছর ধরে উৎপাদন করা হচ্ছে নানা সবজি। যা স্থানীয় চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বাজারজাত হচ্ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। এ অঞ্চলের লোকজন জানান, এক সময় চরাঞ্চলের জমিতে শুধু ধান, গম আর আখ চাষ হতো। কিন্তু এখন সেই জমিতে গড়ে তোলা হচ্ছে, আম বাগান, পেয়ারা বাগান, বরই বাগান, কলা বাগানসহ হরেক রকম সবজি চাষ। বিশেষ করে শীত মৌসুমে এখন ভরেছে আগাম সবজিতে। কৃষকরা বাণিজ্যিক ভাবে নানা প্রকার সবজি চাষাবাদ করে স্থানীয় চাহিদা পূরণ করছেন। চরাঞ্চল ঘুরে দেখা যায়, উপজেলার নদী তীরবর্তী চকরাজাপুর ইউনিয়নের পলাশি ফতেপুর, দাদপুর, কালিদাসখালী, কলিগ্রাম, টিকটিকিপাড়া, করারি নওসারা, সরের হাট, চাঁদপুর এসব চরে এবার চাষ হয়েছে আলু, বেগুন, টমেটো, লাউ, মিষ্টি কুমড়া, শিম, করলা, পুঁই ও লালশাকসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি। চাষ হচ্ছে পেঁয়াজ ও রসুনও। কৃষকরা বলছেন, খুব শীঘ্রই নতুন পেঁয়াজ এবং রসুন উঠবে। পাশাপাশি চাষ হতে চলেছে গম, ছোলা, ভুট্টা, মসুর, আখ, সরিষা ও বাদামের। পলাশি ফতেপুরের কৃষক আনোয়ার শিকদার জানান, তিনি ২০ বিঘা জমিতে শীতকালীন শাকসবজি হিসাবে কপি ও বেগুন চাষ করছেন। সেচের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে শ্যালো মেশিন। রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক সামশুল হক বলেন, চরের মাটিতে যে কোন ফসলের আবাদ অত্যন্ত ভাল হয়ে থাকে। প্রতিবছর বন্যায় জমি তলিয়ে যাওয়ার পর নতুন করে পলি জমার কারণে চাষাবাদ ভাল হয়। কিন্তু নৌকা ছাড়া ফসল আনার উপায় না থাকার কারণে চাষীরা দাম কিছুটা কম পান। তবে এ বছর দাম কিছুটা ভাল পাওয়া যাচ্ছে।
×