ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০১ জুলাই ২০২৫, ১৬ আষাঢ় ১৪৩২

‘পৃথিবীতে আজ কোনো সুখবর নেই’

প্রকাশিত: ২২:০৬, ২৫ নভেম্বর ২০২০

‘পৃথিবীতে আজ কোনো সুখবর নেই’

করোনা নিয়ে মঙ্গলবার যখন লিখতে বসেছি, তখন খবর পেলাম দৈনিক সংবাদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মুনীরুজ্জামান করোনা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। সম্ভবত ঢাকার কনিষ্ঠতম সম্পাদক ছিলেন মুনীরুজ্জামান। যদিও সম্পাদনা করতেন দেশের একটি প্রাচীনতম দৈনিক। বজলুর রহমান যখন দৈনিক সংবাদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ছিলেন, তখন মুনীরুজ্জামান পত্রিকাটির সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করতেন। এসেছিলেন লন্ডনে বেড়াতে। তখন তার সঙ্গে আমার পরিচয়। কয়েকটা দিন তার সঙ্গে ঘুরেছি। তিনি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন কিনা আমার জানা নেই। কিন্তু ছিলেন বামপন্থী। তাকে অকালে হারিয়ে বাংলাদেশের সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকতা ক্ষতিগ্রস্ত হলো। আর আমি হারালাম আমার ছোট ভাইয়ের মতো এক বন্ধুকে। করোনা আমাকে আরও কত বন্ধুহীন করবে তা জানি না। ব্রিটিশ স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ আশ্বাস দিয়েছেন আগামী ইস্টারের সময় পৃথিবী করোনামুক্ত হয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাবে। ইস্টারের সময় মানে আগামী বছরের এপ্রিল মাস। অর্থাৎ, আরও ছ’মাস আমাদের ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে, কবে করোনামুক্ত সেই সুদিনটি আসবে। তার আগে বিশ্বময় আরও কত লাখ লোক এই করোনা রাক্ষুসীর কবলে পড়ে প্রাণ হারাবে তা কে জানে! আমিও যে বেঁচে থাকব তার নিশ্চয়তা কোথায়? ‘জনকণ্ঠের’ উপদেষ্টা সম্পাদক তোয়াব খানও আমেরিকা ঘুরে এসে করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে আছেন। তার জন্য আমার মনে শঙ্কা হয়। তিনি আমার মতো আশি-উর্ধ বয়সী। তাছাড়া হার্টের রোগসহ নানা রোগব্যাধি আছে। একদিন খবর পাই তার অবস্থা ভাল নয়, আরেকদিন খবর পাই তিনি ভাল হয়ে উঠছেন। তিনি সম্পূর্ণ ভাল হয়ে উঠুন এটাই আমার প্রার্থনা। তিনি বাংলাদেশে প্রকৃত সাংবাদিক প্রজাতির যে দু’একজন মাত্র আছেন তাদের মধ্যে সবচাইতে প্রবীণ একজন। মালিক সম্পাদকদের এই আবির্ভাব ও আধিপত্যের যুগে তিনি একজন শেষ শিবরাত্রির সলিতা। আমার আকুল প্রার্থনা তিনি আরও দীর্ঘজীবী হোন। এখন প্রশ্ন, এই যে করোনা রাক্ষুসীর বিশ্বগ্রাসী তাণ্ডব, রূপকথার রাক্ষুসীর একটি রাজ্য ‘বিরান’ করে ফেলার মতো সারা পৃথিবী ‘বিরান’ করে ফেলা, তার কবল থেকে আমরা সহসা মুক্তি পাব কি? আমেরিকার ফাইজার কোম্পানি অথবা আরও যে একটি কোম্পানি করোনা প্রতিষেধক ইনজেকশন আবিষ্কার করার দাবি করেছে, তার কার্যকারিতা শতকরা ৯৪ ভাগ বলে তারাই স্বীকার করছে। জানুয়ারি মাস থেকে ব্রিটেনে এই ইনজেকশন দেয়া হবে বলে জানা গেছে। তখনই জানা যাবে এই ইনজেকশনের কার্যকারিতা কতটুকু! রোগ যতই ভয়াবহ হোক চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা সর্বযুগেই তার প্রতিষেধক আবিষ্কার করেছেন এবং তার কার্যকারিতা প্রমাণিত হয়েছে। প্লেগ, যক্ষ্মা, কলেরা, হাম, বসন্তের মতো রোগেরও প্রতিষেধক বের হয়েছে। মানুষ রোগমুক্ত হয়েছে, কিন্তু রোগ একেবরে নির্মূল হয়নি। এখনও কলেরা, টাইফয়েড, বসন্ত প্রভৃতি রোগের জন্য বছর বছর টিকা ও ইনজেকশন নিতে হয়। করোনার কার্যকর ভ্যাকসিন মানবদেহে প্রয়োগ করার পর মানুষ রোগমুক্ত হবে, কিন্তু করোনা যাবে না। যক্ষ্মা, ক্যান্সারের মতো সিজন অনুযায়ী আসবে। তবে চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে মহামারী সৃষ্টি করতে পারবে না। এ জন্যই আশা করা যায়, যে দু’তিনটি কোম্পানি করোনার প্রতিষেধক তৈরি করেছে তার ব্যবহার শুরু হলে এই মহামারী দূর হবে, কিন্তু করোনা দূর হবে না। বছর বছর একটা সময় বুঝে আসবে। মানুষকে ভ্যাকসিন নিয়ে এই রোগের সঙ্গে যুদ্ধ করে বাঁচতে হবে। করোনা বা কোভিড-১৯ এখন বিশ্ব মহামারী। এই মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউয়ে সারা বিশ্বই প্লাবিত। প্রথম ঢেউয়ের সময় বেশি আক্রান্ত হয়েছিল ইতালি। এবার হয়েছে অস্ট্রিয়া। অবশ্য ব্রিটেন ও আমেরিকাসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশেও দ্বিতীয় দফার করোনা-গ্রাস কম নয়। মানুষ আশায় বুক বেঁধে আছে কবে এই ভ্যাকসিন দেয়া শুরু হয়। ভ্যাকসিন দেয়া শুরু হলে বিশ্বময় এই রোগ যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে তা কমবে। গত ১০ মাসে করোনা সারাবিশ্বে যে ভয়াবহ বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে তাতে মানুষের মনে এতটাই ভয় ঢুকেছে যে, একটি করোনামুক্ত বিশ্বের কথা মানুষ এখন ভাবতেই পারছে না। দিনের পর দিন লকডাউনে বাস করে মানুষ তার আগের সামাজিক জীবন ভুলতে বসেছে। লন্ডনের এক বিশিষ্ট ব্যক্তির কাছে লেখা তার স্ত্রীর একটি চিঠি খবরের কাগজে ফাঁস হয়ে গেছে। তাতে তিনি লিখেছেন, ‘ডারলিং, আমাদের বিবাহিত জীবন ত্রিশ বছরের। আমাদের দুজন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী সন্তান আছে। কিন্তু তার পরেও এই সোস্যাল ডিসটেন্স মেনে দীর্ঘকাল লকডাউনে বাস করতে গিয়ে মনে হচ্ছে আমরা বিবাহিত নই। কোনকালে ছিলাম না। বিশ্বাস করতে পারছি না তুমি আমাকে আগে রোজ চুমু খেতে এবং আমরা রোজ আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে বিছানায় যেতাম। আমাদের জীবনে এদিন আবার ফিরে আসবে বিশ্বাস করতে পারছি না।’ লকডাউন এবং সোস্যাল ডিসটেন্স মানুষের জীবনে যে পরিবর্তন এনেছে, করোনা চলে যাওয়ার পরেও দীর্ঘকাল তার প্রভাব মানুষের সমাজ জীবনে থাকবে। দীর্ঘকাল মানুষ শিশুকেও চুমু দিয়ে আদর করতে, বন্ধুকে আলিঙ্গন করতে বিরত থাকবে। তার মনে আগের শঙ্কাবোধ কাজ করবে। করোনা মহামারী চলে যাওয়ার পরও প্রতি সিজনে ফ্লু ও বসন্তের মতো করোনার সীমিত আগমন ঘটবে তখন ভ্যাকসিন আবিষ্কার হওয়া সত্ত্বেও কেউ- এমনকি নিকট আত্মীয়রাও রোগাক্রান্ত ব্যক্তির কাছে যেতে চাইবে না। সমাজতাত্ত্বিকেরাও বলছেন, করোনা মহামারী চলে যাবে। কিন্তু করোনা ও তার প্রভাব যাবে না। একটা বড় ধরনের সামাজিক পরিবর্তন আসবে বিশ্বে। এর অর্থনৈতিক প্রতিক্রিয়া তো দেখা দিতে শুরুই করেছে। ব্রিটেনে আগামী বছর ট্যাক্স বৃদ্ধির সম্ভাবনার কথা আগেই ঘোষণা করা হয়েছে। সারাবিশ্বেই হুহু করে বেকার সংখ্যা বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ত্রিশের মন্দার চাইতেও ভয়াবহ মন্দা বিশ্বে শুরু হয়ে গেছে। এই মন্দার ফলে পৃথিবীতে অনেক ওলটপালট ঘটবে। অনেক রাষ্ট্রে বিপ্লব হবে। দাঙ্গা-হাঙ্গামায় বহু লোকের মৃত্যু হবে। বড় বড় যুদ্ধও বাধতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যে এবং নিকটপ্রাচ্যে ফ্যাসিবাদী ধর্মান্ধতা এবং সাম্প্রদায়িকতা আরও ভয়াবহ রূপে দেখা দিতে পারে। আমেরিকার সুপারপাওয়ার স্ট্যাটাস নাও থাকতে পারে। ওষুধ শিল্পে মনোপলি সৃষ্টি করে ক্যাপিটালিজম টিকে থাকার চেষ্টা করতে পারে। অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের চাইতেও ভূ-প্রাকৃতিক পরিবর্তন ঘটবে আরও ভয়াবহভাবে। কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণ হওয়ার পর কোভিডের চাইতে ভয়াবহ রোগ বিশ্বে মহামারী হিসেবে দেখা দিতে পারে। যুগের পর যুগ ধরে পৃথিবীর ক্রমশ উষ্ণ হয়ে ওঠা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং আবহাওয়ার দ্রুত পরিবর্তন সম্পর্কে মানুষ অসচেতন থাকায় এ সম্পর্কে কোন কিছু করার ব্যাপারে উন্নত রাষ্ট্রগুলো অবহেলা দেখানোর ফলে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে আকস্মিক ভূমিকম্প, অতিবৃষ্টি অথবা খরা, বন্যা, প্লাবন ইত্যাদি ঘন ঘন ঘটবে। সব চাইতে বড় কথা, প্রশান্ত ও আটলান্টিক মহাসাগরে পারমাণবিক অস্ত্রের অনবরত পরীক্ষা চালানো এবং তার বর্জ্য বিভিন্ন দেশে ফেলার ফলে যে ভয়ঙ্কর দূষণ ঘটছে, তার প্রতিক্রিয়ায় মানুষকে নিত্য নতুন রোগ ব্যাধিতে ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে ভুগতে হবে। বহুকাল আগে জীবনানন্দ দাশ তার কবিতায় লিখেছিলেন, ‘পৃথিবীতে আজ কোনো সুখবর নেই।’ বর্তমান বিশ্বে কবির এই উক্তিই সত্য হতে চলেছে মনে হয়। করোনামুক্ত পৃথিবী আবার কোনদিন আসবে কিনা আর এলেও মানুষের সামাজিক, আর্থিক, রাজনৈতিক জীবন কেমন হবে তা নিয়ে নানা মুনি নানা কথা বলছেন। কিন্তু কি হবে সে বিষয়ে সঠিক কথা কেউ বলছেন না। তবে একটা কথা সত্য, মানুষ এবং মানবতা অতীতে অনেক দুর্যোগ পেরিয়েছে। এবার এ দুর্যোগও কাটিয়ে উঠবে, এই আশা করা অসঙ্গত নয়। লণ্ডন, ২৪ নবেম্বর, মঙ্গলবার, ২০২০
×