ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

চাইল্ড পর্নোগ্রাফির রমরমা বাণিজ্য

প্রকাশিত: ২৩:০৯, ২১ অক্টোবর ২০২০

চাইল্ড পর্নোগ্রাফির রমরমা বাণিজ্য

নিয়াজ আহমেদ লাবু ॥ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৬ বছরের এক কিশোরীর সঙ্গে ইনস্টাগ্রামের মাধ্যমে পরিচয় হয় ঢাকার বোরহান উদ্দিন নামে এক তরুণের। কয়েক বছরের পরিচয় ও বন্ধুত্বের পর মার্কিন ওই তরুণীর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। এক পর্যায়ে কৌশলে মার্কিন ওই তরুণীর কিছু নগ্ন ছবি নেয় ঢাকার বোরহান উদ্দিন। এরপরই ওই কিশোরী বুঝতে পারে সে চাইল্ড পর্নোগ্রাফি চক্রের পাল্লায় পড়েছে। পরে ওই কিশোরী ফেসবুকে ঘটনাটি ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগের কাছে অভিযোগ করে। এরই সূত্র ধরে দীর্ঘ ৮ মাস অনুসন্ধান চালিয়ে ভয়ঙ্কর এক চাইল্ড পর্নোগ্রাফি চক্রের সন্ধান পায়। পরে বৃহস্পতিবার রাতভর অভিযান চালিয়ে রাজধানীর শাহজাহানপুর, পল্লবী ও রামপুরা থানা এলাকা এই পর্নোগ্রাফির চক্রের হোতা ঢাকার তিন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী বোরহান উদ্দিন (২৬), মোঃ আব্দুল্লাহ আল-মাহমুদ (২৫) ও মোঃ অভি হোসেনকে (২৫) গ্রেফতার করে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট (সিটিটিসি)। এ সময় ভয়ঙ্কর চাইল্ড পর্নোগ্রাফি চক্রের হোতা বোরহানের ব্যবহৃত কম্পিউটার থেকে একটি ফোল্ডার জব্দ করা হয়। যেখানে ৪৫ দেশী-বিদেশী কিশোরীর নগ্ন ছবি পাওয়া যায়। যার মধ্যে তিন হাজার ৩১৬টি ফাইল ছিল। এর মধ্যে মার্কিন ওই কিশোরীর নামেও একটি ফোল্ডার ছিল। এছাড়া বোরহানের কম্পিউটার ঘেঁটে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন চাইল্ড পর্নোগ্রাফি ওয়েবসাইট লগইন অবস্থায় পাওয়া যায়। গ্রেফতাদের জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে এসেছে ভয়ঙ্কর শিশু পর্নোগ্রাফির নানা কাহিনী। রবিবার গ্রেফতারকৃতরা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। সিটিটিসির সূত্র জানায়, গ্রেফতারকৃতরা আন্তর্জাতিক চক্রের সঙ্গে মিশে শিশু পর্নোগ্রাফি তৈরি করে ছড়িয়ে দিয়ে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিত। সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগের ডিজিটাল ফরেনসিক বিভাগের সহকারী পুলিশ কমিশনার ইশতিয়াক আহমেদ জানান, গ্রেফতার তিন যুবক ঢাকার প্রথম সারির তিনটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তিনজনই শিশু পর্নোগ্রাফি তৈরির কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দী দিয়েছেন। এখন তারা কারাগারে আছেন। তাদের কাছ থেকে মোবাইল ও কম্পিউটার ছাড়াও ৩০ জিবি ভলিউমের ৩ হাজার ৩১৬টি ফাইল জব্দ করা হয়। এগুলোর মধ্যে ৪৫ জন ‘ভিকটিমের’ নগ্ন ছবি রয়েছে। এরা সাধারণত ৯ থেকে ১৫ বছরের ছেলেমেয়েদের ‘টার্গেট’ করতেন। পরে তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ্যাকাউন্ট খুলে তারা দেশের বাইরের শিশু পর্নোগ্রাফি তৈরি গ্রুপের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তাদের দেয়া নির্দেশনা অনুযায়ী বাংলাদেশে কাজ করে। তারা নামকরা স্কুলের শিশু-কিশোর-কিশোরীর এ্যাকাউন্ট অনুসরণ করত এবং নানাভাবে অসামাজিক কাজে উৎসাহিত করার মাধ্যমে নুড কনটেন্ট তৈরি করে ছড়িয়ে দিত। নিবন্ধিত সদস্য হিসেবে তারা অশ্লীল ডার্ক ওয়েবসাইটে ঢুকত। এই চক্র কখনও কখনও অবস্থা সম্পন্ন শিশুর অভিভাবকের কাছে কনটেন্ট পাঠিয়ে অর্থ হাতিয়ে নিতেন। সহকারী কমিশনার ইশতিয়াক বলেন, এছাড়া তারা কখনও কখনও সমকামী হিসেবেও অনলাইনে নিজেদের পরিচয় দিতেন। গ্রেফতারের পর একদিন রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদের পরদিন রবিবার আদালতে পাঠালে তারা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেন। যেভাবে পর্নোগ্রাফি হোতাদের সন্ধান ॥ ঢাকার সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগ সূত্র জানায়, চলতি বছরের ২ ফেব্রুয়ারি মার্কিন এক কিশোরী ফেসবুকের মাধ্যমে তাদের কাছে একটি অভিযোগ করে। এতে ওই কিশোরী জানায়, তার নগ্ন ছবি নিয়ে ব্ল্যাকমেল করছে ঢাকার এক যুবক। পরে মার্কিন ওই কিশোরী একটি আইপি নম্বর দেয় সাইবার ক্রাইম বিভাগকে। পরে ওই আইপি নম্বরের সূত্র ধরে অনুসন্ধান শুরু করে তারা। সাইবার ক্রাইম বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, অনুসন্ধানে ওই আইপি নম্বরটির ব্যবহারকারীকে শনাক্ত করে তারা। এরই সূত্র ধরে বৃহস্পতিবার রাতে উত্তর শাজাহানপুরের একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে আইপি নম্বর ব্যবহারকারী বোরহান নামে এক তরুণকে গ্রেফতার করে। পরে তার দেয়া তথ্য অনুযায়ী রামপুরা থানাধীন রিয়াজবাগ থেকে আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ ও পল্লবী এলাকা থেকে অভিকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে বোরহান একটি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি থেকে ইলেক্ট্রনিক্স এ্যান্ড ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগ থেকে ¯œাতক সম্পন্ন করেছে। বাকি দুজন অপর দুটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএর শিক্ষার্থী। যেভাবে ওরা তৈরি করত চাইল্ড পর্নো ॥ সাইবার ক্রাইম বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, গ্রেফতারের পর বোরহান শিশু পর্ন তৈরির কথা অস্বীকার করে। পরে জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে সে সবকিছু স্বীকার করে। পরে বোরহানের ব্যবহৃত কম্পিউটার থেকে একটি ফোল্ডারে ৪৫ দেশী-বিদেশী কিশোরীর নগ্ন ছবি পাওয়া যায়। যার মধ্যে তিন হাজার ৩১৬টি ফাইল ছিল। এর মধ্যে মার্কিন ওই কিশোরীর নামেও একটি ফোল্ডার ছিল। জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃত বোরহান সিটিটিসিকে জানায়, সে মূলত ইনস্টাগ্রামভিত্তিক বিভিন্ন চাইল্ড পর্নোগ্রাফির গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত ছিল। চাইল্ড পর্ন গ্রুপগুলো ‘শাটআউট’ নামে পরিচিত। এসব গ্রুপ থেকেই কিশোরীদের কিভাবে মোটিভেটেড করে নগ্ন ছবি সংগ্রহ করা যায়, সেসব কৌশল শিখেছে। পরে এই কৌশল প্রয়োগ করে কিশোরীদের নগ্ন ছবি সংগ্রহ করে চাইল্ড পর্নোগ্রাফি গ্রুপগুলোতে আপলোড করত। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, গ্রেফতারকৃত বোরহানের ছয়টি ফেক ইনস্টাগ্রাম আইডি উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া একাধিক ফেক মেইল আইডিও উদ্ধার করা হয়েছে। তারা জানান, গ্রেফতারকৃত বোরহান ইনস্টাগ্রামের ফেক আইডি বানিয়ে নিজেকে লেসবিয়ান নারী হিসেবে তুলে ধরে দেশ-বিদেশের কিশোরীদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলত। এক পর্যায়ে কিশোরীদের কাছ থেকে নগ্ন ভিডিও এবং ছবি সংগ্রহ করত সে। সেসব ভিডিও এবং ছবি আপলোড করা হতো পর্ন ওয়েবসাইট ও গ্রুপে। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, গ্রেফতারের পর বোরহানের কাছ থেকে তারা এমন কিছু নথিপত্র উদ্ধার করেছেন, যেখানে কিভাবে অনলাইনে একজন কিশোরীকে নগ্ন ছবি সরবরাহ করতে প্রলুব্ধ করা হবে তার ১৩টি কৌশল উল্লেখ রয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে বোরহান এই কৌশলপত্র তাকে ইনস্টাগ্রামের একটি চাইল্ড পর্ন গ্রুপের এডমিন তাকে দিয়েছে বলে জানিয়েছে। কড়া নজরদারির মধ্যেও চাইল্ড পর্নোগ্রাফির রমরমা বাণিজ্য ॥ কড়া নজরদারির মধ্যেও বিশ্বজুড়ে চাইল্ড পর্নোগ্রাফির রমরমা বাণিজ্য চলে আসছে। মূলত ডার্ক ওয়েবের মাধ্যমেই শিশু পর্নোগ্রাফির বাণিজ্য চলে। শিশু বা কিশোরীদের নগ্ন ভিডিও বা ছবি আপলোড করা হয় বিভিন্ন ওয়েবসাইটে। চলে লাইভ স্ট্রিমিংও। পয়সা খরচ করে দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ এসব ওয়েবসাইটে ঢুকে চাইল্ড পর্নোগ্রাফি দেখে। এসব ক্ষেত্রে মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হয় সাধারণত ক্রিপ্টোকারেন্সি বিট কয়েন। অনলাইনে ডলার পেমেন্ট করেও এসব ওয়েবসাইটে ঢোকা যায়। দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলও শিশু পর্নোগ্রাফি চক্রের সদস্যদের শনাক্ত ও গ্রেফতারে কাজ করে আসছে। এখন পর্যন্ত তারা বিভিন্ন দেশ থেকে দশ হাজারেরও বেশি অপরাধীকে শনাক্ত ও গ্রেফতার করেছে। ইন্টারপোলের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতেই ২০১৪ সালের জুন মাসে ঢাকায় টিপু কিবরিয়াসহ চাইল্ড পর্নোগ্রাফি চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। ওই চক্রটি সে সময় অন্তত পাঁচ শতাধিক শিশুর পর্ন ভিডিও তৈরি করে অর্থের বিনিময়ে আন্তর্জাতিক চাইল্ড পর্ন চক্রের হাতে তুলে দিয়েছিল। সাইবার নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা জানান, চাইল্ড পর্ন ট্রেডটা হয় মূলত ডার্ক বা ডিপ ওয়েবে, পাসওয়ার্ড প্রটেক্টেড সার্ভিসের মাধ্যমে। দুনিয়ায় সাইবার পেট্রোলিং বাড়ানোর কারণে পর্ন সাইটগুলো ডিপ ওয়েবে চলে যাচ্ছে। আমাদের এখানেও অনেক লোকজন ডার্ক নেটে চাইল্ড পর্নোর মতো নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এজন্য আমাদের ডার্ক নেট মনিটরিং করা প্রয়োজন। গ্রেফতারকৃত তিন চাইল্ড পর্নের জন্য কাদের কাছে ছবি ও ভিডিও সরবরাহ করত তাদের শনাক্ত করার জন্য অধিকতর তদন্ত করা দরকার। এর পেছনে আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক কারা। প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা- ইন্টারপোলের সহযোগিতা নিয়ে চক্রের সকল সদস্যদের খুঁজে বের করা উচিত।
×