ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বাজারে আলুর কৃত্রিম সঙ্কট

প্রকাশিত: ২২:৪৪, ২০ অক্টোবর ২০২০

বাজারে আলুর কৃত্রিম সঙ্কট

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ বাজারে আলুর কৃত্তিম সঙ্কট চলছে। পাইকারি বাজারে আলু নেই। মজুদকৃত আলু ছাড়ছে না দেশের কোল্ড স্টোরেজ বা হিমাগার মালিকরা। খুচরা বাজারে ইচ্ছেমত দাম নিচ্ছে ব্যবসায়ীরা। আলুর বর্তমান মূল্য ৫০-৬০ টাকা থেকে আরও বাড়ার আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। দাম কমাতে খুচরা বাজারে অভিযান পরিচালনা করা হলেও কোল্ড স্টোরেজ মালিকরা রয়েছেন সম্পূর্ণ ধরাছোঁয়ার বাইরে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হিমাগারে অভিযান পরিচালনা করে দ্রুত মজুদকৃত আলু বাজারে নিয়ে আসতে হবে, অন্যথায় আলুর দাম কমবে না। গত দু’দিনে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের বাজারে অভিযান পরিচালনা করে অন্তত অর্ধশতাধিক ব্যবসায়ীকে জরিমানা করলেও বাজারে এর প্রভাব পড়েনি। কমেনি আলুর দাম। ভোক্তাদের সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে ২০-২৫ টাকা বেশি দিয়ে আলু কিনতে হচ্ছে। বাণিজ্য সচিব ড. জাফর উদ্দীন জনকণ্ঠকে বলেন, আলু নির্ধারিত দামেই বিক্রি করতে হবে। অন্যথায় খুচরা, পাইকার ও হিমাগার মালিক কাউকেই ছাড়া হবে না। তিনি বলেন, হিমাগার মালিকরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে বৈঠক করে কথা দিয়েছেন, তারা নির্ধারিত দামে আলু বিক্রি করবেন। এছাড়া টিসিবি ২৫ টাকা দরে আলু বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তিনি বলেন, অভিযান পরিচালনা অব্যাহত রাখা হবে। আশা করছি, সরকারী বিভিন্ন উদ্যোগের মুখে আলুর দাম কমে আসবে। ব্যবসায়ীরা মজুদকৃত আলু ছাড়তে বাধ্য হবেন। খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, মঙ্গলবার মধ্যে পাইকার বাজার থেকে আলু সংগ্রহ করতে না পারলে তাদের মজুদও শেষ হবে। এমন অবস্থায় আবারও দাম বাড়তে পারে এমন শঙ্কা রয়েছে ক্রেতা সাধারণের। তবে কয়েকদিনের মধ্যেই সব সমস্যার সমাধান আসতে পারে, এমন আশ্বাস দিয়েছেন জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতরের ডেপুটি পরিচালক মঞ্জুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার। তার মতে, কোল্ডস্টোর থেকে আলু না ছাড়লে নিলাম বা সিলগালা করার সুযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে যেসব কোল্ডস্টোরের বিরুদ্ধে আলু মজুদের প্রমাণ পাওয়া যাবে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সোমবার সরজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, ঢাকার ২২ আড়তের মধ্যে মাত্র তিনটিতে আলু রয়েছে তাও আবার পর্যাপ্ত পরিমাণে নয়। খুচরা বাজারে প্রতিকেজি আলু বিক্রি হচ্ছে স্থান ভেদে ৫০-৬০ টাকা কেজি। আলু ব্যবসায়ীরা (আড়তদার) বলছেন, সরকার পাইকারি বাজারে আলুর দাম ২৫ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে। অথচ কোল্ডস্টোরেজ থেকেই আলু কিনতে হয় ৩৫ টাকা দরে। সরকার নির্ধারিত মূল্যে আলু বিক্রি করলে বড় অঙ্কের লোকসানে পড়তে হবে। সরকারী দাম পুনর্বিবেচনা করে ৩৫ টাকা করারও প্রস্তাব রয়েছে অনেক ব্যবসায়ীর। তারা বলেন, সরকার দাম নির্ধারণ করার আগেই আলু কোল্ডস্টোরে বেশি দামে বিক্রি হয়েছে। আড়তদাররা বলছেন, মুন্সীগঞ্জ জেলায় কোল্ডস্টোর পর্যায়ে আলুর দাম চাওয়া হচ্ছে ৩৫ টাকা, যেটা আড়তে আসতে আরও দুই টাকা খরচ বেশি পড়বে। আবার বেশি দামে বিক্রি করলে জরিমানা গুনতে হবে। আবার দাম কম বললে কোল্ডস্টোর থেকে আলু দেয় না। মুন্সীগঞ্জ, রংপুর, রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কোল্ডস্টোর থেকে আলু ছাড়া হচ্ছে না। কারওয়ানবাজার আড়তদার জসীম উদ্দিন বলেন, আলুর দাম পুনর্নির্ধারণ করা হলে কোল্ডস্টোর থেকে আলু পাওয়া যাবে। এখন বাজারে আলু নাই, হয়ত যাদের আছে তারা আবারও দাম বাড়িয়ে দিতে পারেন। ওই বাজারের আরেক ব্যবসায়ী খলিল বলেন, আলুর দাম পুনর্নির্ধারণ করলে সমাধান হবে। এ বার ত্রাণে আলুর ব্যবহার ছিল, বন্যায় ফসলের ক্ষতি হয়েছে সব মিলে সঙ্কট আছে। রাজধানীর পাইকারি বাজারের মতো অধিকাংশ খুচরা বাজারে আলু সঙ্কট রয়েছে। মালিবাগ বাজারের বিক্রেতা মালেক বলেন, আমাদের দোকানে আলু নেই বললেই চলে, কারওয়ানবাজারেও আলু আজও আসেনি। আগামীকালের মধ্যে আলু বাজারে না এলে আবারও অনেক দাম বেড়ে যাবে। জানা গেছে, আলুর দাম বাড়ায় সাধারণ ভোক্তাদের অস্বস্তি বাড়ছে। তাদের মতে, আলু নৈরাজ্যের সমাধান না হলে নিম্ন-মধ্যবিত্তদের অবস্থা আরও খারাপ হবে। গোড়ান বাজারের ক্রেতা আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, আলুর দাম আবারও বেড়ে যাওয়া মানে অন্য পণ্যের দামও বাড়বে। এতে আবার নিম্ন-মধ্যবিত্তরা আরও চাপের মুখে পড়বেন। এ অবস্থার অবসান চাই। তবে সমস্যার সমাধানে ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতরের ডেপুটি পরিচালক মঞ্জুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার আরও বলেন, শহর থেকে তৃণমূল পর্যায়ে মনিটরিং করছি। কোন কোল্ডস্টোরেজ যদি আলু না ছাড়ে তাহলে সেটি সিলগালা করা হবে অথবা নিলামে তোলা হবে, আইনে এটা আছে। তবে আশা করি, সে পর্যন্ত সমস্যা যাবে না, সমাধান হবে। তবে ব্যবসায়ীদের বিক্রি ও কেনার রিশিট রাখতে হবে। এর আগে গত বুধবার প্রতিকেজি আলুর দাম হিমাগারে ২৩ টাকা, পাইকারিতে ২৫ টাকা এবং খুচরা বাজারে ৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি নিশ্চিত করতে সারাদেশের জেলা প্রশাসকদের চিঠি দিয়েছে কৃষি বিপণন অধিদফতর। একইসঙ্গে উল্লিখিত দামে কোল্ডস্টোরেজ, পাইকারি বিক্রেতা ও ভোক্তা পর্যায়ে খুচরা বিক্রেতাসহ তিন পক্ষই যাতে আলু বিক্রি করেন, সেজন্য কঠোর মরিটরিং ও নজরদারির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানিয়ে ডিসিদের কাছে পাঠানো হয়েছে চিঠি। ওই চিঠিতে কৃষি বিপণন অধিদফতর জানিয়েছে, বাংলাদেশে গত আলুর মৌসুমে প্রায় ১ দশমিক ৯ কোটি টন আলু উৎপাদিত হয়েছে। দেশে মোট আলুর চাহিদা প্রায় ৭৭ দশমিক ৯ লাখ টন। এতে দেখা যায় যে, গত বছর উৎপাদিত মোট আলু থেকে প্রায় ৩১ দশমিক ৯১ লাখ টন আলু উদ্বৃত্ত থাকে। কিছু পরিমাণ আলু রফতানি হলেও ঘাটতির আশঙ্কা নেই। যদিও করোনা মহামারীর কারণে এবার আলু রফতানি হয়নি। এ অবস্থায় আগামী দু’মাসের মধ্যে আবার নতুন আলু উঠা শুরু হবে। ওই সময়ের মধ্যে মজুদকৃত আলু বাজারে ছাড়া না হলে কৃষক, হিমাগার মালিক ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়বেন। আলুর বাজার নিয়ন্ত্রণে টিসিবি খোলা ট্রাকে ২৫ টাকা দরে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, টিসিবির পাশাপাশি নিত্যপণ্যের বাজারেও আলুর দাম কমানো হবে। সরকার নির্ধারিত মূল্যের বাইরে আল বিক্রির কোন সুযোগ নেই।
×