ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ফেসবুকে লাইভ দেখেছেন কোটি কোটি দর্শক

সারাদেশে পুলিশের ধর্ষণ ও নির্যাতনবিরোধী সমাবেশ

প্রকাশিত: ২২:৫৯, ১৮ অক্টোবর ২০২০

সারাদেশে পুলিশের ধর্ষণ ও নির্যাতনবিরোধী সমাবেশ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ এই প্রথমবারের মতো সারাদেশে একযোগে ধর্ষণ ও নির্যাতনবিরোধী সমাবেশ করল পুলিশ। সমাবেশে উপস্থিতি ছিলেন নানা শ্রেণী-পেশার লাখ লাখ মানুষ। আর দর্শক ছিল কোটি কোটি। দেশবাসীর দৃষ্টিও ছিল সমাবেশের দিকে। ধর্ষণ, নারী ও শিশু নির্যাতনবিরোধী সমাবেশ করার কারণে মানুষের মধ্যে নতুন করে সাহস এসেছে। তারা পুলিশের সহযোগিতায় ধর্ষক, নারী ও শিশু নির্যাতনকারী থেকে শুরু করে সমাজের সকল স্তরের খারাপ ব্যক্তিদের রুখে দেয়ার শপথ নিয়েছেন। সারাদেশে প্রায় সাত হাজার বিটে এই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশ থেকে ধর্ষক, নারী ও নির্যাতনকারীদের আর ছাড় নয় বলে ঘোষণা দিয়েছে পুলিশ ও উপস্থিতরা। সমাবেশের প্রতিটি বিটের ফেসবুক থেকে লাইভ দেখানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। পুুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক মোঃ সোহেল রানা জানান, শনিবার সকাল দশটায় সারাদেশে একযোগে ধর্ষণ, নারী ও শিশু নির্যাতনের বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে এই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। পুলিশের সারাদেশের প্রায় সাত হাজার বিটে সমাবেশ করা হয়েছে। সমাবেশের অনুষ্ঠান প্রতিটি বিটের ফেসবুক থেকে লাইভ দেখানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সারাদেশে অনুষ্ঠিত সেই সমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন নানা শ্রেণী-পেশার লাখ লাখ মানুষ। আর দর্শক ছিল কোটি কোটি। সমাবেশে পুলিশ ছাড়াও সমাজের গণমান্য ব্যক্তি, জনপ্রতিনিধি, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, নারী ও শিশু অধিকার কর্মী, স্থানীয় নারী ও স্কুল-কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা উপস্থিত ছিলেন। আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার জানান, শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি সংলগ্ন স্বপার্র্জিত স্বাধীনতা চত্বরে এই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ‘নারী ধর্ষণ ও নির্যাতনবিরোধী বিট পুলিশিং সমাবেশ’ ব্যানারে আয়োজিত এই সমাবেশের সঞ্চালনার দায়িত্ব পালন করেন শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মামুন অর রশীদ। তাতে বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর আব্দুর রহিম, রমনা জোনের ডিসি মোঃ সাজ্জাদ হোসেন, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও উপ সাংস্কৃতিক সম্পাদক তিলোত্তমা শিকদার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক ড. আব্দুর রহিম বলেন, নারীর প্রতি যে নির্যাতন চলছে, তা সমাজের বিভিন্ন স্তরের নাগরিকদের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ চালালে রোধ করা সম্ভব হবে। আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী ধর্ষণের বিচার দাবিতে অনশনে রয়েছেন। এটা আসলে খুবই ন্যক্কারজনক। মুক্তিযুদ্ধের সময়ও আমাদের মা-বোনদের সঙ্গে এ ধরনের নিন্দনীয় কাজ হয়েছিল। সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে এ ধরনের কাজ থেকে সমাজকে বাঁচানো সম্ভব হবে বলে মনে করছি। ডিসি সাজ্জাদ হোসেন বলেন, বেশ কিছুদিন ধরে ধর্ষণ ইস্যু সামনে চলে এসেছে। ধর্ষণের বিষয়ে সারাদেশের প্রান্তিক স্তরের মানুষ যাতে সচেতন হতে পারে সে জন্য এ ধরনের সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। যাতে করে কোন পরিবারের কোন বাবা-মায়ের ছেলে ধর্ষণের আসামি না হয়। আর কোন পুরুষ যদি ধর্ষকের উপাধি পেয়ে যায়, তাহলে তার মৃত্যুদ- হবে, এটা যাতে তারা বুঝতে পারে। এখন ধর্ষণ বেড়ে গেছে। সেই সঙ্গে আসামিরাও ধরা পড়ছে। ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- করেছে সরকার। এর ফলে কিছুটা হলেও ধর্ষণের ভয়াবহতা কমবে। ছাত্রলীগ সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় বলেন, ধর্ষণের সঙ্গে যারা জড়িত তারা যে দলের হোক, তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। তাদের গ্রেফতার করে দেশকে ধর্ষণমুক্ত করতে হবে। আর মূল্যবোধের অবক্ষয়ের জন্যই এ ধরনের জঘন্য অপরাধ কর্মকা- সংঘটিত হচ্ছে। মূল্যবোধ তৈরির জায়গা হচ্ছে পরিবার। ধর্ষণের মতো নিন্দনীয় বিষয় প্রতিরোধ করার জন্য পরিবার এবং সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। ধর্ষকরা নিকৃষ্ট। সামাজিকভাবে এদের বয়কট করলে সমাজ থেকে এ ধরনের অপরাধ কমবে। পুলিশ মহাপরিদর্শক ড. বেনজীর আহমেদের ভাষ্য মতে, অতীতে নানা ইস্যুতে গুজব ছড়িয়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করার চেষ্টা হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় এবার ধর্ষণ ইস্যুতে সারাদেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। এজন্য ধর্ষণের বিরুদ্ধে সারাদেশে আরও বেশি সচেতনতা সৃষ্টির জন্যই এমন সমাবেশ করা হয়েছে। যাতে মানুষের মধ্যে বাড়তি সচেতনতা এবং সাহস আসে। মানুষ যেন এ ধরনের ঘৃন্য অপরাধের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনবিরোধী পোস্টার, লিফলেট, প্ল্যাকার্ড প্রদর্শনের মাধ্যম ছাড়াও বক্তব্য দিয়ে জনসাধারণকে সচেতন করেছেন। অপরাধীকে আইনের আওতায় আনতে পেশাদারিত্বের সঙ্গে পুলিশকে দায়িত্ব পালন করতে কড়া নির্দেশনাও দিয়েছেন পুলিশ প্রধান। সিআইডি প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক ব্যারিস্টার মাহবুবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, ধর্ষণ ইস্যুতে সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্র হচ্ছে। পরিকল্পিতভাবে ধর্ষণ ইস্যুতে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করছে কিছু রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠনের শীর্ষ কতিপয় নেতা। তারা দেশের প্রতিটি থানায় পরিকল্পিতভাবে বেশি বেশি মামলা দায়ের করে, দেশে ধর্ষণ বেড়ে গেছে বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করছে। আর সেটিকে ইস্যু বানিয়ে সরকারবিরোধী তৎপরতা চালানোর পথ খুঁজছে। এমন নির্দেশদাতার অনেককেই চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি ধর্ষণ, নারী, নির্যাতন বিরোধী এমন সমাবেশ খুবই উপযোগী সময়ে হয়েছে। এতে করে মানুষের মধ্যে যেমন সাহস বেড়েছে তেমনি পুলিশের আস্থাও বাড়বে। ডিএমপি কমিশনার মোহাঃ শফিকুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, ধর্ষণের সবোর্চ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- হয়েছে। যা এক সময় বলতে গেলে অনেকটা গণদাবিই ছিল। তারপরও কোন গোষ্ঠী বা সামাজিক সংগঠন এসব ইস্যুতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন/সংগ্রাম করলে তাতে বাধা নেই। তবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করলে পরিস্থিতি বুঝে অবশ্যই সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে। ধর্ষণবিরোধী সমাবেশ তারা সফলতার সঙ্গে করেছেন। এমন সমাবেশ করার কারণে মানুষের মধ্যে বাড়তি সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের মধ্যে সাহসও বেড়েছে। পুলিশও জনগণের আরও কাছাকাছি যেতে পেরেছে। র্যাব মহাপরিচালক পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক আব্দুল্লাহ আল মামুন র্যাবের সকল সদস্যকে ধর্ষণ ইস্যুতে গুজব সৃষ্টিকারীদের বিষয়ে সতর্ক থাকার নির্দেশনা দিয়েছেন। এমন সমাবেশ খুবই কাজে আসবে। কারণ মানুষের মধ্যে বাড়তি মনোবলের সঞ্চয় করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান খ্যাতিমান অপরাধ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, পুলিশের এমন উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়। কারণ পুলিশের নেটওয়ার্ক গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত। পুলিশ সারাদেশে ধর্ষণ, নারী ও শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে যে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে তা খুবই কাজে আসবে। কারণ এতে মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি হবে তেমনি মানুষের মধ্যে বাড়তি সাহস যোগাবে। কারণ ধর্ষণ, নারী ও শিশু নির্যাতন একটি মানসিক ব্যাধি। সচেতনতা বাড়ানো ছাড়া সমাজ থেকে এ ধরনের অপরাধ কমিয়ে আনা সম্ভব নয়। বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর উপপরিচালক এবং গণসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত মেহেনাজ তাবাস্সুম রেবিন জানান, বাহিনীটির তরফ থেকে দেশের প্রতিটি গ্রামের ৩২ পুরুষ ও ৩২ মহিলাকে বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য, মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে অবদান, সামাজিক দায়বদ্ধতা, প্রাথমিক আইনগত ধারণা প্রদান, নারী ও শিশু নির্যাতন রোধ, ধর্ষণ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি, পাচার রোধ, বাল্য বিয়ে নিরোধ, যৌতুক প্রদান বন্ধ করা, জন্ম নিয়ন্ত্রণ, ইভ টিজিং, এসিড নিক্ষেপ নিয়ন্ত্রণ, মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার রোধ, পরিবেশ দূষণ, দুর্নীতি প্রতিরোধ, শিষ্টাচার, নির্বাচন, দুর্গাপূজা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদিতে দায়িত্ব পালন, জঙ্গী দমন বিষয়ক আলোচনা, কৃষি, বৃক্ষ রোপণ ও আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার বিষয়ক আলোচনা, গবাদিপশু ও পাখি পালন এবং চিকিৎসা পদ্ধতি, মৎস্য চাষ ও চিকিৎসা পদ্ধতি, অগ্নি দুর্ঘটনা ও ভিডিপি সদস্যদের করণীয় প্রভৃতি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের অনেকেই মাঠ পর্যায়ে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য কাজ করে যাচ্ছেন।
×