ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

সমাজে অস্থিরতা, আতঙ্কে এলাকাবাসী অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের হুমকি মাঠে নেমেছে পুলিশ ও র‌্যাব নিয়ন্ত্রণে গোয়েন্দা সংস্থার ১২ দফা সুপারিশ

ফের বেপরোয়া কিশোর গ্যাং ॥ চার মাসে চাঞ্চল্যকর ১৩ খুন

প্রকাশিত: ২৩:০৪, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২০

ফের বেপরোয়া কিশোর গ্যাং ॥ চার মাসে চাঞ্চল্যকর ১৩ খুন

গাফফার খান চৌধুরী ॥ আবারও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে কিশোর গ্যাং। গত কয়েক সপ্তাহে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ ঢাকার সাভারে স্কুলছাত্রী নীলা রায়কে অস্ত্রের মুখে অপহরণের পর ধর্ষণ শেষে হত্যার মধ্যদিয়ে আবারও বেপরোয়া হয়ে উঠার চরম অবস্থা জানান দিয়েছে কিশোর গ্যাং বাহিনী। নীলা রায় ছাড়াও গত সপ্তাহে মোহাম্মদপুরে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে মারাত্মকভাবে ছুরিকাঘাতে এক যুবক আহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। সিলেটের এমসি কলেজে স্বামীকে আটকে রেখে এক গৃহবধূকে ধর্ষণের ঘটনায় বিক্ষুব্ধ দেশবাসী। এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের অধিকাংশই সদ্যকিশোর থেকে যুবক হয়েছে। তাদের অনেকেই গ্যাং কালচারে জড়িত। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের অধিকাংশ কিশোর ও যুবক। গত পাঁচ বছর ধরেই আলোচনায় রয়েছে কিশোর গ্যাং। তবে গত দেড় বছর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানের মুখে গ্যাংগুলোর অপতৎপরতা স্তিমিত ছিল। হালে আবার কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত বেড়েছে। এ মাসের শুরুতেই রাজধানীর সবুজবাগ থানার রাজারবাগ বাগপাড়া দরবার গলিতে সিদ্দিকের প্রেসের সামনে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে খুন হন মোঃ জোব্বার আলী। এ ঘটনায় ৮ সেপ্টেম্বর নিহতের ভাই মোঃ সিদ্দিক বাদী হয়ে সবুজবাগ থানায় একটি মামলা করেন। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা এ খুনে জড়িত বলে পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে বেরিয়ে আসে। এরপর সিসিটিভি ফুটেজ দেখে খুনী চিহ্নিত করা হয়। পরে ১৭ সেপ্টেম্বর মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল থেকে ইমন ও তার ভাই ইয়াছিনকে গ্রেফতার করা হয়। ইমন সুইচ গিয়ার দিয়ে জোব্বারকে খুন করে আর ইয়াছিন তাকে সহযোগিতা করে। ১৮ সেপ্টেম্বর ইমন এবং ১৯ সেপ্টেম্বর ইয়াছিন খুনের দায় স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়। রাজধানীর উত্তরখান থানার রাজাবাড়ী খ্রীস্টানপাড়া রোডে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে খুন হয় উত্তরা পাবলিক স্কুল এ্যান্ড কলেজ শিক্ষার্থী সোহাগ। এ ঘটনায় ২৮ আগস্ট নিহতের বড়ভাই উত্তরখান থানায় একটি মামলা করেন। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা এ খুনে জড়িত বলে পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে বেরিয়ে আসে। পরে ২২ সেপ্টেম্বর দক্ষিণখানের মোল্লারটেক এলাকা থেকে সোহাগ হত্যায় প্রধান অভিযুক্ত ‘দ্য বস’ গ্যাংয়ের টিম লিডার হৃদয় ও মাহবুবুল ইসলাম রাসেল ওরফে কাটার রাসেলকে গ্রেফতার করে র‌্যাব-১ এর সদস্যরা। এ সময় তাদের কাছ থেকে দুটি বিদেশী পিস্তল, দুটি ম্যাগজিন ও ৮ রাউন্ড গুলি জব্দ করা হয়। র‌্যাব বলছে, গ্রেফতার হৃদয় ও রাসেল উত্তরখান এলাকার ‘রগকাটা’ গ্রুপেরও সদস্য। দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থী রাসেল হৃদয়ের নেতৃত্বাধীন কিশোর গ্যাং গ্রুপ দ্য বস বা হৃদয় গ্যাংয়ে কাজ করত। আর হৃদয় ষষ্ঠ শ্রেণীর পড়াশোনা বাদ দিয়ে উত্তরায় একটি ওয়ার্কশপে কাজ করত। তার সঙ্গে রাসেল, নাদিম, সানি, মেহেদী, সাদ, সাব্বিরসহ এলাকার উঠতি বয়সের কিশোরদের সুসম্পর্ক থাকায় সবাইকে নিয়ে কিশোর গ্যাং ‘দ্য বস’ প্রতিষ্ঠা করে এবং সে নেতৃত্ব দেয়। এই গ্রুপের সদস্য প্রায় ১০/১২ জন। টেলিভিশনের বিভিন্ন দেশী-বিদেশী সিরিয়াল দেখে এরা অপরাধ ও আত্মগোপনের বিভিন্ন কৌশল রপ্ত করে। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে কিশোর গ্যাং সদস্যদের অপরাধমূলক কর্মকা- আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। আর এতে হুমকির মুখে পড়েছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। শুধু রাজধানীর ১০ থানা এলাকাতেই ৩২টি কিশোর গ্যাংয়ের ৫০০ থেকে সাড়ে ৫০০ সদস্য অপরাধমূলক কর্মকা-ে লিপ্ত রয়েছে। এখনই তাদের নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হতে পারে। সম্প্রতি সরকারের একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরে কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণে ১২ দফা সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা নিয়ন্ত্রণে আনতে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা দেয়া, জুমার খুতবায় কিশোর অপরাধের ভয়াবহতা সম্পর্কে অভিভাবকদের সচেতন করা এবং কিশোরদের নিয়মিত কাউন্সেলিং করা। প্রতিবেদনটি এরই মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোতে পাঠানো হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ৪ মাসে কিশোর সন্ত্রাসীদের হাতে ১৩টি চাঞ্চল্যকর খুনের ঘটনা ঘটেছে। এতে সমাজে অস্থিরতাসহ এলাকাবাসীর মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। গ্রেফতার করেও গ্যাং সদস্যদের তৎপরতা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় এবং কর্মজীবী কিশোররা তাদের কর্মস্থান হারিয়ে অধিকতর বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। সারাদেশের বিভাগ ও জেলা ছাড়াও কোন কোন উপজেলায়ও একাধিক কিশোর গ্যাং থাকার তথ্য রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে। গত পাঁচ বছরে বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকার দায়ে গ্রেফতার হয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের তিন শতাধিক সদস্য। যাদের মধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত দেড় শতাধিক সদস্যকে সাজা দিয়েছে। সাজাপ্রাপ্তদের অধিকাংশই গাজীপুর ও টঙ্গীর কিশোর সংশোধনাগারে রয়েছে। পুলিশ সদর দফতরের তথ্য মোতাবেক, ২০১৫ সালে মতিঝিলের এজিবি কলোনিতে এক মহিলাকে মোটরসাইকেল দিয়ে পিষে হত্যা এবং ২০১৭ সালের ৬ জানুয়ারি ঢাকার উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের কাছে সন্ধ্যায় ট্রাস্ট স্কুল এ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণীর ছাত্র আদনান কবিরকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে। দুইটি ঘটনায় আটজন করে ১৬ জন গ্রেফতার হয়। গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে ঢাকার বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় কিশোর গ্যাং থাকার সুষ্পষ্ট তথ্য। পুলিশের নথিপত্র মোতাবেক, ঢাকার প্রায় প্রতিটি থানা এলাকায় কিশোর গ্যাং আছে। তবে সবচেয়ে বেশি কিশোর গ্যাং কালচার গড়ে ওঠেছে উত্তরায়। নাইন স্টার ও ডিসকো বয়েজ নামের দুইটি কিশোর গ্যাং খুবই সক্রিয় উত্তরায়। এ দুইটি গ্যাংয়ের সদস্যদের মধ্যে সংঘাতের ঘটনায় আদনান নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনটি মারামারী এবং একটি ছুরিকাঘাতের ঘটনা ঘটে। সর্বশেষ নাইন স্টার নামের কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের হাতে খুন হয় আদনান। সর্বশেষ সাভারে স্কুলছাত্রী নীলা রায়কে অস্ত্রের মুখে অপহরণের পর ধর্ষণ শেষে হত্যার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার প্রধান আসামি মিজানুর রহমান (২০) ও তার দুই সহযোগী সাথী (২১) ও জয়কে (২০) গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গ্রেফতারকালে তারা সাভারের ফুলবাড়িয়ায় কর্নেল ব্রিকস ফিল্ডের পাশে স্থানীয় পারভেজের বাড়িতে বসে মাদক সেবন করছিল। এছাড়া সিলেটের এমসি কলেজে স্বামীকে বেঁধে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণের ঘটনায় উত্তাল পুরো সিলেট। পুলিশ মহাপরিদর্শক ড. বেনজীর আহমেদ দায়িত্ব নেয়ার পর পরই সারাদেশে পুলিশের সব ইউনিটকে কিশোর গ্যাং সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে বিশেষ ফাইল তৈরির করার নির্দেশ দেন। সে মোতাবেক সারাদেশে কিশোর গ্যাং শনাক্তকরণ এবং গ্যাং সদস্যদের গ্রেফতার করতে ধারাবাহিক অভিযান অব্যাহত আছে। র‌্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাল জনকণ্ঠকে জানান, আদনান কবির হত্যার পর কিশোর গ্যাং সম্পর্কে বহু তথ্য বেরিয়ে আসে। এমনকি সারাদেশে কিশোর গ্যাং কালচার থাকার তথ্যও পাওয়া যায়। বিভাগ, জেলা ও কোন কোন উপজেলা শহরেও গ্যাং কালচার থাকার তথ্য মিলে। ইতোপূর্বে কিশোর গ্যাংয়ের অনেক সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। যাদের মধ্যে অনেককেই ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে সাজা দেয়া হয়েছে। র‌্যাবের ইন্টেলিজেন্স উইংয়ের পরিচালক লে. কর্নেল সারওয়ার-বিন-কাশেম জনকণ্ঠকে জানান, কিশোর গ্যাংয়ের সক্রিয় সদস্যদের প্রায় সবাই মাদকাসক্ত। তারা মাদকের টাকা যোগাড় করতে ছিনতাই করে। পথচারীদের ব্যাগ, মোবাইল, মহিলাদের ভ্যানিটি ব্যাগ চাকু বা ব্লেড দিয়ে কেঁটে ভেতরে থাকা গুরুত্বপূর্ণ মালামাল নিয়ে যায়। চলন্ত পথে ব্যাগ বা মোবাইল ফোন ছুঁ মেরে নিয়ে যাওয়ার সঙ্গেও কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা জড়িত। র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ সারোয়ার আলম জনকণ্ঠকে জানান, নানা অপরাধে জড়িত থাকার দায় স্বীকার করার পর কিশোর গ্যাংয়ের অনেক সদস্যকে সাজা দেয়ার পর তাদের কিশোর সংশোধনাগারে পাঠানো হয়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের তথ্য মোতাবেক, এক সময় পাওয়ার বয়েজ, ডিসকো বয়েজ, বিগ বস, নাইন স্টার ও নাইন এমএম বয়েজ, এনএনএস, এফএইচবি, জিইউ, ক্যাকরা, ডিএইচবি, ব্যাক রোজ, রনো, কেনাইন, ফিফটিন গ্যাং, পোটলা বাবু, সুজন ফাইটার, আলতাফ জিরো, ক্যাসল বয়েজ, ভাইপার, তুফান, থ্রি গোল গ্যাং, লাগবি নাকি, মাঈনুদ্দিন গ্রুপ, বিহারি রাসেল গ্যাং, বিচ্চু বাহিনী, পিচ্চি বাবু, সাইফুলের গ্যাং, সাব্বির গ্যাং, বাবু রাজন গ্যাং, রিপন গ্যাং, মোবারক গ্যাং, নয়ন গ্যাং, তালাচাবি গ্যাং, নাইন এম এম, একে ৪৭ ও ফাইভ স্টার গ্রুপ, স্টার বন্ড গ্রুপ, মোল্লা রাব্বির গ্রুপ, গ্রুপ টোয়েন্টিফাইভ, লাড়া দে, লেভেল হাই, দেখে ল-চিনে ল, কোপায়ইয়া দে, শাহীন-রিপন গ্যাং, নাজিম উদ্দিন গ্যাং, শান্ত গ্যাং, মেহেদী গ্যাং, সোলেমান গ্যাং, রাসেল ও উজ্জ্বল গ্যাং, বাংলা ও লাভলেট গ্যাং, জুম্মন গ্যাং, চান-জাদু, ডেভিল কিং ফুল পার্টি, ভলিয়ম টু, ভাণ্ডারি গ্যাং, টিকটক গ্যাং, পোঁটলা সিফাত গ্যাং যথেষ্ট সক্রিয় ছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে এসব গ্রুপের এখন তেমন কোন তৎপরতা নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, নানা কারণে কিশোর গ্যাং গড়ে ওঠে। যার মধ্যে পারিবারিক ও সামাজিক এবং শিক্ষাগত কারণ অন্যতম। পরিবর্তিত সমাজ ব্যবস্থায় নিম্ন আয়ের পরিবারের কিশোররা নানা কারণে শিক্ষা থেকে অনেক সময় বঞ্চিত হয়। আবার স্কুল থেকেই ঝরে পড়ে। অনেকের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। এতে করে এসব কিশোরদের মধ্যে এক ধরনের হতাশার সৃষ্টি হয়। প্রথম প্রথম এসব কিশোররা হতাশা ভুলে থাকতে মাদকের দিকে ঝুঁকে পড়ে। মাদক সেবনের কারণে তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যাহত হয়। পরিবারের সদস্যরা তাদের প্রায়ই গালমন্দ করেন। একদিকে লেখাপড়া বা স্কুলে যাওয়ার কোন তাড়া থাকে না। তারপর পরিবারের সদস্যদের কাছে গালমন্দ খেতে খেতে তাদের মধ্যে হতাশা পুরোপুরি ভর করে। তারা মাদকের নেশায় বুঁদ হয়ে সবকিছু ভুলে থাকার চেষ্টা করতে থাকে। পরিবারের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক আস্তে আস্তে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। আর মাদক সেবনকালে স্বাভাবিক কারণেই সমবয়সী কিশোরদের সঙ্গে এদের সম্পর্ক হয়। এরপর তারা নিজেরাই সংঘবদ্ধ হয়ে গড়ে তুলছে গ্যাং। এরা মাদকের টাকা যোগাড় করতে ছিনতাই, মাদক বিক্রিসহ নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। তাদের মধ্যে এক ধরনের হিরোইজম কাজ করে। তারা পাড়া-মহল্লার বিভিন্ন জায়গায় বসে ইভটিজিং করে। পাড়া মহল্লায় নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে একসঙ্গে অনেক কিশোর বিকট শব্দে মোটরসাইকেলের হর্ন বাজিয়ে এলাকা দাপিয়ে বেড়ায়। নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত অনেক পরিবারই তাদের আশপাশে থাকা বা উচ্চবিত্ত আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টিকে থাকতে চায়। এসব পরিবারগুলো তাদের সন্তানদের উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের মতো নামী-দামী স্কুলে পড়াতে চায়। গাড়ি হাঁকিয়ে স্কুলে পাঠাতে চায়। কিছু দিন সেই ধারা ধরে রাখতে পারলেও শেষ পর্যন্ত তারা টিকতে পারে না। এ সময় তারা ছিটকে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে তাদের সন্তানদের লেখাপড়াও অধিকাংশ সময় থমকে যায়। পড়াশুনায় ছন্দপতন ঘটায় ওইসব কিশোররাও আস্তে আস্তে পাড়ার বখাটে কিশোরদের সঙ্গে মিশতে থাকে। তারাও আস্তে আস্তে মাদকের দিকে ঝুঁকে পড়ে। পরবর্তী সময়ে আস্তে আস্তে জড়িয়ে পড়ে কিশোর গ্যাংয়ে। আর উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের ক্ষেত্রে বিষয়টি একেবারেই ভিন্ন। পরিবারের অঢেল টাকা থাকায় এবং বড় ব্যবসা-বাণিজ্য থাকায় আগাগোড়াই তাদের পড়াশুনায় মনযোগ কম থাকে। যদিও ব্যক্তিক্রমও আছে। এসব পরিবারের কিশোররা সাধারণত ইংরেজী মাধ্যমে পড়াশুনা করে। ইংরেজী মাধ্যমে নিয়মিত ক্লাস করার রীতি না থাকায় তারা বাড়তি সময় পায়। সেই সময় তারা বন্ধু বা বান্ধবী বা সমবয়সীদের সঙ্গে আড্ডা দেয়। তারা পার্টি করে বেড়ায়। পার্টির আড়ালে চলে মাদকের আসর। এক সময় তারা মাদকের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এসব পরিবারের অনেক সন্তানদের মধ্যেই ব্যবসা করতে উচ্চ শিক্ষিত হওয়ার প্রয়োজন নেই বলে, এক ধরনের ধারণা কাজ করে। এই ধারণাই তাদের পড়াশুনার ক্ষেত্রে বড় ধরনের বাধা হিসেবে কাজ করে। আজকের পরিবর্তিত সমাজ ব্যবস্থায় সবাই অর্থবিত্তের মালিক হতে চায়। ফলে নিম্নবিত্ত থেকে শুরু করে উচ্চবিত্ত পরিবারের অধিকাংশ পিতামাতারা টাকা রোজগারের দিকে বেশি মনযোগী হয়। তারা সন্তানদের তেমন সময় দিতে পারে না। এমন সুযোগে আস্তে আস্তে সন্তানরা সঠিক পথ থেকে ছিটকে পড়তে থাকে। সন্তানদের দিকে সবার আগে পরিবারকে খেয়াল করতে হবে। অন্যথায় কিশোর গ্যাং কালচার গড়ে ওঠার প্রবণতা কমবে না। কিশোর গ্যাংয়ের বিষয়ে বিশিষ্ট নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আব্দুর রশীদ জনকণ্ঠকে বলেন, কিশোর গ্যাং পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য রীতিমতো হুমকি সরূপ। কারণ এক সময় কোন কিশোর অপরাধীই বড় ধরনের অপরাধী হয়ে গড়ে ওঠতে পারে। কোন কোন কিশোরের দুর্ধর্ষ জঙ্গী হয়ে ওঠাও বিচিত্র নয়। যাদের পক্ষে বড় ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকা- চালানো কোন ব্যাপার নাও হতে পারে। সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষ কিশোর গ্যাংয়ের নেতিবাচক প্রভাবের শিকার হন। একজন সাধারণ মানুষও অনেক সময় তাদের হাত থেকে রেহাই পান না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের গ্রেফতারে খুবই সক্রিয়। এছাড়া সামাজিকভাবে কোথাও কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা দেখা গেলে, সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলা উচিত। এতে করে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের তৎপরতা কমে যাবে। যদিও অনেক সময় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা নানা অপরাধমূলক কর্মকা-, এমনকি খুনের ঘটনা পর্যন্ত ঘটিয়ে থাকে। সে বিষয়েও সতর্ক থাকতে হবে।
×