ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

বিদেশী ঋণে জর্জরিত ঢাকা ওয়াসা

প্রকাশিত: ২২:৫৯, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০

বিদেশী ঋণে জর্জরিত ঢাকা ওয়াসা

ফিরোজ মান্না/রহিম শেখ ॥ বিদেশী ঋণে জর্জরিত ঢাকা ওয়াসা। গত ১১ বছরেই ১৮ হাজার ২৫১ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। সময়মতো ঋণ পরিশোধ না করায় চক্রবৃদ্ধি সুদসহ বর্তমানে ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকা। এই টাকা ওয়াসার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির চেয়েও অনেক বেশি। ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছে ১৫ থেকে ২০ বছর। এর মধ্যে চায়না এক্সিম ব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। বাকি ঋণের জোগান দিয়েছে বিশ্বব্যাংক, দক্ষিণ কোরিয়ার ইডিসিএফ, এএফডি, ডানিডা, ইআইবিসহ আরও কয়েকটি সংস্থা। সময়মতো আবার এই ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে ঋণের পরিমাণও দ্বিগুণ হয়ে যাবে। সরকারকে ঋণের ঘানি টানতে হবে ২০৩৫ থেকে ২০৪০ সাল পর্যন্ত। বিভিন্ন সংস্থা থেকে উচ্চ হার সুদে ঋণ নেয়ার নথি এখন জনকণ্ঠের হাতে রয়েছে। ঢাকা ওয়াসা সূত্র জানিয়েছে, ওয়াসার ৬টি মেগা প্রকল্পে বিদেশ থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা নেয়া হয়েছে। প্রতিটি প্রকল্পে কত টাকা ঋণ নেয়া হয়েছে তা তুলে ধরা হলো। ৬টি প্রকল্পের বাইরেও বাংলাদেশ সরকার ও ওয়াসার নিজস্ব তহবিল থেকে আরও প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। গত ১১ বছরে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার হদিসও পাওয়া যায়নি। ২০১৮ সালের অডিট রিপোর্টে এ আপত্তিও জানিয়েছেন অডিটররা। সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা লোপাটের বিষয়ে অদৃশ্য কারণে দীর্ঘদিনেও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এমন হরিলুটের মধ্য দিয়ে বছরের পর বছর পার করে দিয়েছেন ওয়াসার এমডি। ওয়াসায় অনিয়ম দুর্নীতি হলেও আরও তিন বছরের জন্য নিয়োগের জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। তার নিয়োগ প্রস্তাব ওয়াসা বোর্ড মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। মন্ত্রণালয় সম্প্রতি তাকসিম এ খানের নিয়োগ প্রস্তাবটি প্রধানমন্ত্রীর দফতরে পাঠিয়েছে বলে খবর মিলেছে। তড়িঘড়ি করে এই প্রস্তাব পাঠানোর বিষয়ে ওয়াসায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। নগরপরিকল্পনাবিদসহ বিভিন্ন মহল থেকেও নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া এসেছে। পরিকল্পনাবিদরা বলেছেন, একজন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার কিভাবে দীর্ঘ ১১ বছর ওয়াসার এমডি থাকেন। তার তো পানি সম্পর্কে কোন ধারণা থাকার কথা না। তিনি যন্ত্রপাতির লোক। তার খুঁটির জোর নিয়েও তারা প্রশ্ন তুলেছেন। রাজধানীতে অতিরিক্ত ১০৫ কোটি লিটার পরিশোধিত পানির চাহিদা পূরণ, সুপেয় পানি সরবরাহ এবং নদীর পানি দূষণ কমানোসহ ৬টি প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করছে ঢাকা ওয়াসা। এর মধ্যে দুটি প্রকল্প শতভাগ বাস্তবায়ন হয়েছে। ২০১২ সাল থেকে এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে বিভিন্ন সময়ে বিপুল অঙ্কের ঋণ নেয় ঢাকা ওয়াসা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে ঋণ নেয়া হয়েছে ‘ঢাকা এনভায়রনমেন্টালি সাসটেইনবল ওয়াটার সাপ্লাই প্রজেক্ট’। প্রকল্পটির প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ হাজার ২৪৮ কোটি টাকা। প্রকল্পটিতে ৫ শতাংশ সুদে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ঋণ জোগান দিয়েছে ৩ হাজার ৪৯৯ কোটি ২৯ লাখ টাকা। ২০২২ সালের জুন মাসে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হলে ভূ-উপরিস্থ ৫শ’ এমএলডি পানি পরিশোধন ও সরবরাহের মাধ্যমে ঢাকা মহানগরীর পানি সরবরাহ ব্যবস্থা নির্বিঘœ ও নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। প্রকল্পটির পরিচালক মোঃ মাহমুদুল ইসলাম। অর্থায়নের দিক থেকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রকল্পটি হচ্ছে ‘সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার প্রকল্প (ফেজ-৩)’। প্রকল্পটির প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ হাজার ৫৯৭ কোটি ৬ লাখ টাকা। প্রকল্পটিতে এএফডি, ডানিডা, ইআইবি ২ শতাংশ হারে ঋণ জোগান দিয়েছে ৩ হাজার ৫৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হলে নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁও উপজেলার হাড়িয়ায় একটি পাম্পিং স্টেশন স্থাপন করার মাধ্যমে মেঘনা নদী থেকে দৈনিক প্রায় ৯৫ কোটি লিটার অপরিশোধিত পানি শোধনাগারে ৪৫ কোটি লিটার পানি দৈনিক সরবরাহ করা সম্ভব হবে। প্রকল্পটির পরিচালক কামরুন নাহার লাইলী। ‘দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার প্রকল্পে’র প্রাক্কলিত ব্যয় ৩ হাজার ৭১৫ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। এ প্রকল্পে চায়না এক্সিম ব্যাংক একাই ২ হাজার ৩৬৬ কোটি টাকা অর্থায়ন করছে। ২০২২ সালের মধ্যে প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হলে রাজধানীর গুলশান, বনানী, বারিধারা, বসুন্ধরা, মহাখালী, ডিওএইচএস, তেজগাঁও, মগবাজার, ইস্কাটন, নিকেতন, কলাবাগান (আংশিক) এবং হাতিরঝিল এলাকায় সৃষ্ট পয়ঃবর্জ্য পরিশোধন করে বালু নদীতে নিষ্কাশন করার মাধ্যমে নগরীর পানি ও পরিবেশ দূষণ রোধ করা সম্ভব হবে। এছাড়া সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার ফেজ-১ ও ফেজ-২ এর ইনটেক পয়েন্টে শীতলক্ষ্যা নদীর পানির দূষণ কমানোও যাবে। প্রকল্পটির পরিচালক মোঃ মোহসেন আলী মিয়া। ‘ঢাকা ওয়াটার সাপ্লাই ইমপ্রুভমেন্ট প্রকল্পে’র প্রাক্কলিত ব্যয় ৩ হাজার ১৮২ কোটি ৩০ লাখ টাকা। প্রকল্পে এডিবি অর্থায়ন করেছে ২ হাজার ১৫৪ কোটি টাকা অর্থায়ন করছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হলে ঢাকা ওয়াসার ৭টি জোনে পাইপলাইন স্থাপন করার মাধ্যমে স্বল্প আয়ের জনগোষ্ঠী, বস্তিবাসীসহ সকল নগরবাসীকে সুপেয় পানি সরবরাহ করা সম্ভব হবে। প্রকল্পটির পরিচালক মোঃ আক্তার হোসেন। ‘পদ্মা (যশলদিয়া) পানি শোধনাগার নির্মাণ (ফেজ-১) প্রকল্পে’র প্রাক্কলিত ব্যয় ৩ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা। প্রকল্পে চীনের এক্সিম অর্থায়ন করেছে ২ হাজার ৫ কোটি টাকা অর্থায়ন করছে। ২০১৯ সালের জুনে প্রকল্পটির কাজ শেষ হয়েছে। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং উপজেলাধীন (মাওয়া থেকে ৩ কিমি পশ্চিমে) যশলদিয়ায় একটি পানি শোধনাগার নির্মাণ করা হয়েছে। এতে অতিরিক্ত ৪৫০ মিলিয়ন লিটার পরিশোধিত পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। প্রকল্পটির পরিচালক হিসেবে ছিলেন মোঃ রফিকুল ইসলাম। ‘সাভার উপজেলার তেঁতুলঝরা-ভাকুর্তা এলাকায় ওয়েল ফিল্ড নির্মাণ (১ম পর্ব) প্রকল্প (দ্বিতীয় পর্ব) প্রকল্পে’র প্রাক্কলিত ব্যয় ৫৭৩ কোটি টাকা। প্রকল্পে এডিবি দক্ষিণ কোরিয়ার ইডিএসএফ অর্থায়ন করেছে ৩৬৯ কোটি টাকা। প্রকল্পটির কাজ শেষ হয় ২০১৯ সালের জুনে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে অতিরিক্ত ১৫ কোটি লিটার পরিশোধিত পানি সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে। গত ১১ বছরে মাত্র দুটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে ঢাকা ওয়াসা। এসব প্রকল্পে বিপুল অঙ্কের বিদেশী ঋণ নেয়া হলেও পানির দাম বাড়ানো হয়েছে ১২ বার। প্রতি হাজার লিটার পানির দাম পৌনে ৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে এখন ১৪ টাকা ৪৬ পয়সা করা হয়েছে। আর বড় বড় প্রকল্পের নামে লুটপাট হয়েছে সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকা। ১১ বছরে ওয়াসা ৪০টির বেশি প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা বললেও বাস্তবে তার কোন প্রমাণ নেই। এসব প্রকল্প জনগণের কল্যাণে খুব একটা কাজে আসেনি। বরং প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার আগেই টাকা তুলে নিয়ে গেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো। ধীরগতিতে বাস্তবায়ন করে সময় ও টাকার অঙ্ক বাড়ানো হয়েছে। প্রায় প্রতি প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর কারণে এখনও অনেক কাজ চলমান রয়েছে। নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, ব্যাপক দুর্নীতি আর অনিয়মের কারণে ওয়াসার আজ এমন পরিণতি। বিভিন্ন সময় ওয়াসার এই অবস্থার কথা তুলে ধরা হলেও কোন ফল হয়নি। উল্টো অনেকেই এমডির রোষানালে পড়ে চাকরি হারিয়েছেন। সম্প্রতি প্রকল্পগুলোর বিষয়ে ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খানের কাছে জানতে চাইলে টেলিফোনে তিনি কোন কথা বলতে রাজি হননি। তিনি বলেছেন, তাকে লিখিত প্রশ্ন পাঠাতে হবে। এই প্রতিবেদক ওয়াসার এমডিকে লিখিত প্রশ্ন পাঠালে তিনি তার জবাব দেন। লিখিত জবাবে তিনি বলেছেন, গত ১১ বছরে ওয়াসার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ওয়াসা এখন রোল মডেলে হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে। তার বেশির ভাগ জবাবই ছিল দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পক্ষে। জনকল্যাণের বিষয়ে বলেছেন, মানুষ এখন বাসায় বসে ওয়াসার বিল দিতে পারে। অনলাইনে অভিযোগ জানাতে পারে। এটা একটা বড় অর্জন। এর আগের রিপোর্টে ওয়াসার এমডির সব জবাব তুলে ধরা হয়েছে। তিনি এখ ৬ষ্ঠ বারের মতো নিয়োগ পেতে নানা মহলে জোর তদবির চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি ওয়াসার একজন মহিলা কর্মকর্তাকে দিয়ে ক্ষমতাসীন দলের উচ্চ পর্যায়ের নেতার কাছে তদবির করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ওই কর্মকর্তার সঙ্গে আওয়ামী লীগের ওই নেতার সুসম্পর্ক রয়েছে বলে জানা গেছে। ওয়াসায় প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কর্মকর্তাদের অনেককেই চাকরি থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। আরও কাউকে বছরের বছর ওএসডি করে রাখা হয়েছে। এখন যারা ওয়াসায় বড় আওয়ামী লীগ হিসাবে পরিচিত তাদের প্রায় সবাই বিএনপির সময় সুবিধা ভোগী। তারা তখন বিএনপির কর্মী হিসাবে কাজ করেছেন। তাদেরই ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খান গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে রেখেছেন। তারা এখন ওয়াসার এমডির কাছের মানুষ।
×