ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

১১ বছরে ৩ হাজার কোটির হদিস নেই

ওয়াসায় বছরে মূল বেতন ৭০ কোটি টাকা, ওভারটাইম ৯৫ কোটি

প্রকাশিত: ২২:৫৮, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২০

ওয়াসায় বছরে মূল বেতন ৭০ কোটি টাকা, ওভারটাইম ৯৫ কোটি

ফিরোজ মান্না ॥ ঢাকা ওয়াসায় বছরে মূল বেতন ৭০ কোটি, আর ওভারটাইম ৯৫ কোটি টাকা। বিষয়টি অবিশ্বাস্য হলেও সত্য। বিশাল অংকের ওভার টাইমে চলছে হরিলুট। খাতা কলমে রাজস্ব আয় দেখানো হয়েছে প্রায় ১২শ’ কোটি টাকা। অন্যদিকে ২৫০ কোটি টাকার কেনাকাটার কোন হিসাব নেই। গত ১১ বছরে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার হদিসও পাওয়া যায়নি। ২০১৮ সালের অডিট রিপোর্টে এ নিয়ে আপত্তিও জানিয়েছে অডিটররা। অদৃশ্য কারণে দীর্ঘদিনেও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এমন হরিলুটের মধ্য দিয়ে ১১ বছর পার করে ওয়াসার এমডি আরও তিন বছরের জন্য নিয়োগের জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তার নিয়োগ প্রস্তাব ওয়াসা বোর্ড মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। তড়িঘড়ি করে এই প্রস্তাব পাঠানোর বিষয় নিয়ে ওয়াসায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। সোমবারও ওয়াসায় এমডি নিয়োগ প্রস্তাব নিয়ে ওয়াসায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। এমডির পক্ষে ও বিপক্ষের দুই গ্রুপই মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ জনকণ্ঠকে বলেন, তাকসিম এ খানকে আগামী তিন বছরের নামে নিয়োগ দেয়ার ওয়াসা বোর্ডের প্রস্তাব আমার হাতে এসে পৌঁছেছে। এখন আমরা আমাদের কাজ করে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মোঃ তাজুল ইসলামের কাছে জমা দেব। তিনি প্রস্তাবটি প্রধানমন্ত্রীর দফতরে পাঠাবেন। প্রধানমন্ত্রীই সিদ্ধান্তের মালিক। এখানে আমাদের কিছু করার নেই। সর্বময় ক্ষমতায় ওয়াসা বোর্ডের। বোর্ডের ওপর মন্ত্রণালয়ের কথা বলার কোন এখতিয়ার নেই। বোর্ড তাকসিম এ খানকে ওয়াসার জন্য সবচেয়ে দক্ষ যোগ্য ও সৎ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে মন্ত্রণালয়ের কি করার আছে বলেন ভাই। ওয়াসা হচ্ছে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। এখানে যা কিছু হয় বোর্ডের সিদ্ধান্তেই হয়। বোর্ডের একজন মেম্বার তো আপনাদের সাংবাদিকও ছিলেন। ২০১৮ সালে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার অডিট আপত্তির বিষয়টি ওয়াসা বোর্ডের দেখা উচিত ছিল। মূল বেতনের চেয়ে ওভারটাম বেশির বিষয়টিও দেখার দায়িত্ব বোর্ডের। তাহলে মন্ত্রণালয়ের কি কাজ এমন প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, এখানে মন্ত্রণালয়ের কোন কাজ নেই। আমরা ওয়াসাকে পরামর্শ দিতে পারি আর কিছু না। ওয়াসা নিয়ে যে কোন প্রশ্নই তিনি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। বোর্ডের সদস্যরা কেমন করে তাকে এত দক্ষ ও যোগ্য বলেছেন তা আমার জানা নেই। আপনার জানা থাকলে লিখে দিতে পারেন। দেশে তাকসিম এ খানের চেয়ে আর যোগ্য লোক পাওয়া যায়নি বলেই বোর্ড তার নাম প্রস্তাব করেছে। পদ্মা-যশোলদিয়া প্রকল্প নিয়ে কথা বলতে চাইলে সচিব কোন কথা বলেননি। পদ্মা-যশোলদিয় পানি শোধনাগার প্রকল্পের সাড়ে তিন শ’ কোটি লোপাটের সেই রফিকুল ইসলামকে ‘ঢাকা স্যানিটাইজেশন ইমপ্রুমেন্ট প্রকল্পের’ পিডি নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বিশ^ ব্যাংকের অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন কাল ধরা হয়েছে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। প্রকল্পে ব্যয় হবে ৩ হাজার ৭শ’ ৭১ কোটি টাকা। প্রকল্পে রফিকুল ইসলামকে নিয়োগ দেয়ার কারণে নানা মহলে প্রশ্ন উঠেছে। ওয়াসার কয়েক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হলে তারা বলেন, এ থেকে এমডি আবারও প্রমাণ করলেন ওয়াসায় দুর্নীতিবাজরাই তার ঘনিষ্ঠজন। এই প্রকল্পে দুর্নীতির আরও বড় সুযোগ রয়েছে। এ কারণেই এমডি রফিকুলকেই বেছে নিয়েছেন। এ বিষয় নিয়ে রফিকুল ইসলামের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, আমি এ বিষয়ে কোন কথা বলব না। কারণ আমাদের কথা বলা মানা আছে। আমি তো পিডি নিজে নিজে হইনি। আমাকে এমডির দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। বিষয়টি আমি কোন কথা বলতে চাই না-আগেই তো বলেছি। ওয়াসা সূত্র জানিয়েছে, রাজধানীবাসীর পানির সঙ্কট মেটাতে ৭ বছর আগে হাতে নেয়া পদ্মা-যশোলদিয়া পানি শোধনাগার। এই প্রকল্পের লক্ষ্য প্রতিদিন ৪৫ কোটি লিটার সুপেয় পানি সরবরাহ। প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে ৭ বছর সময় লেগে যায়। পরে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে পুরো বিল দিয়ে দেয়া হয়। ঢাকাবাসীর জন্য নেয়া এ প্রকল্পের পানি অধিকাংশ বাড়িতেই পৌঁছায়নি। এখন পর্যন্ত তৈরিই হয়নি সরবরাহ লাইন। থেকেই যাচ্ছে পানির সঙ্কট। পুরনো লাইনেই চলছে পানি সরবরাহ। দৈনিক ৪৫ কোটি লিটার করে যেখানে মাসে ১ হাজার ৩৫০ কোটি লিটার পানি সরবরাহের কথা সেখানে ঢাকাবাসী পানি পাচ্ছে মাসে ৪৬০ কোটি লিটারের মতো। এতে বছরে প্রকল্পে সরকারের ক্ষতি হচ্ছে ২শ’ কোটি টাকার বেশি। নিম্নমানের কাজ এবং পুরো কাজ শেষ না করেই পদ্মার মাওয়া পয়েন্ট থেকে রাজধানীতে পানি সরবরাহের পদ্মা-যশোলদিয়া প্রকল্পের কাজ শেষ করেছে ঢাকা ওয়াসা। চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স চায়না সিএএমসি ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড কাজ শেষ না করেই পুরো কাজের বিল তুলে নিয়েছে। প্রকল্পের শুরুতে ব্যয় ধরা হয়েছিল তিন হাজার ৫০৮ কোটি ৭৯ লাখ ১৫ হাজার টাকা। পরে তা বাড়িয়ে তিন হাজার সাড়ে ৮শ’ কোটি টাকা করা হয়। এখান থেকে সাড়ে তিন শ’ কোটি লোপাটের প্রমাণ পেয়েছে দুদক। প্রকল্পের পিডির বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে। এরপরও তাকেই আবার ‘ঢাকা স্যানিটাইজেশন ইমপ্রুমেন্ট প্রকল্পের’ পিডি করা হয়েছে। এ নিয়ে ঢাকা ওয়াসায় চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে। রফিকুলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ থাকার পরেও কেন তাকে আবারও বড় প্রকল্পের পিডি করা হলো কেন এমন প্রশ্নের উত্তর জানতে ওয়াসার এমডিকেও কয়েক দফা ফোন করেও তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। ওয়াসার কয়েক প্রকৌশলী জানিয়েছেন, ঢাকা শহরের স্যুয়ারেজ লাইন স্থাপনের এই প্রকল্পে বিশ্ব ব্যাংক অর্থায়ন করেছে। ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে এই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। তাদের আশঙ্কা পদ্মা-যশোলদিয়া প্রকল্পে সাড়ে তিন শ’ কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে। এই প্রকল্প থেকে আরও লুটপাট হবে। সূত্র জানিয়েছে, পদ্ম-যশোলদিয়ায় পরিকল্পনা অনুযায়ী মাওয়া থেকে ঢাকায় পানি সরবরাহের জন্য খাল-নদীর তলদেশ দিয়ে পাইপলাইন স্থাপনের কথা থাকলেও তা কোনমতে জোড়াতালি দিয়ে করা হয়েছে। এতে নদীর তলদেশের পাইপের নিরাপত্তার জন্য সেটির ওপর কোন নিরাপত্তা খাঁচা (প্রটেকশন কেজ) দেয়া হয়নি। কয়েক মাস আগে ধলেশ্বরী নদীতে চলাচলকারী একটি নৌযানের তলা ওই পাইপের গায়ে লেগে যায়। ১ নম্বর ধলেশ্বরী সেতু কুচিয়া মোড়া অংশের ওয়াসার ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্রজেক্টের পাইপ জাহাজের ধাকায় ভেসে উঠে। পরে ওয়াসা সেখানে নতুন পাইপ স্থাপন করেছে। এছাড়া নির্ধারিত পাইপের বদলে কম পুরুত্বের পাইপ বসানো হয়েছে প্রকল্পে। ২২ মিলিমিটার পুরুত্বের (কে-১০) পরিবর্তে দেয়া হয়েছে ১৯ মিলিমিটার (কে-৯)। প্রকল্পে তিন নদীর দুই ধলেশ^রী এক বুড়িগঙ্গা নদীর তলদেশ দিয়ে পাইপ বসানোর জন্য এক শ’ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। কেসিং না দেয়ায় পুরো এক শ’ কোটি টাকাই মেরে দিয়েছে প্রকল্পের পিডি। এখানে সরকারী অর্থের ব্যাপক নয়-ছয় করা হয়েছে। ফলে প্রকল্পের ৩৩ কিলোমিটার পাইপলাইনই নির্মিত হয়েছে নিম্নমানের পাইপ ব্যবহার করে।
×