ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

জানাজায় কয়েক লাখ মুসল্লি, মাদ্রাসা অঙ্গনে দাফন

কওমি বড় হুজুর আল্লামা শফীকে চিরবিদায়

প্রকাশিত: ২২:৫১, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২০

কওমি বড় হুজুর আল্লামা শফীকে চিরবিদায়

চট্টগ্রাম অফিস/ হাটহাজারী সংবাদদাতা ॥ অসংখ্য ভক্তের শোক, কয়েক লাখ মুসল্লির অংশগ্রহণে সাম্প্রতিক সময়ের বৃহত্তম জানাজা শেষে কওমি অঙ্গনে ‘বড় হুজুর’ হিসাবে সমধিক পরিচিত হেফাজতে ইসলামী বাংলাদেশ-এর আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফীকে শনিবার বিকেলে সমাহিত করার মাধ্যমে চির বিদায় জানানো হয়েছে। দেশে কওমি মাদ্রাসাসমূহের মধ্যে সবচেয়ে পুরনো ও সর্ববৃহৎ আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মইনুল ইসলাম মাদ্রাসা প্রাঙ্গণের মসজিদ সংলগ্ন কবরস্থানে তার লাশ দাফন কাজ সম্পন্ন হয়েছে। জানাজায় ইমামতি করেন মরহুমের জ্যেষ্ঠপুত্র মাওলানা মোহাম্মদ ইউসুফ। এর আগে সকাল ৯টা নাগাদ দেশের এই প্রবীণতম আলেমের লাশবাহী গাড়ি ঢাকা থেকে হাটহাজারীর এ মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে এসে পৌঁছে। এ মাদ্রাসায় তিনি ৩০ বছরেরও অধিক সময় পরিচালক এবং শেষে মহাপরিচালক (মুহতামিম) হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। মৃত্যুর আগের দিন মাদ্রাসা পরিচালনা সংশ্লিষ্ট দু’গ্রুপের দ্বন্দ্বের জের হিসাবে তিনি এ পদ থেকে অব্যাহতি নেন। অব্যাহতি গ্রহণের পরপরই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং এর পরদিন অর্থাৎ ১৮ সেপ্টেম্বর দুপুরের দিকে ভর্তি করা হয় চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে থাকায় তাকে হেলিকপ্টারযোগে স্থানান্তরিত করা হয় ঢাকায়। সন্ধ্যায় তিনি ঢাকার আজগর আলী হাসপাতালে শেষ নিশ^াস ত্যাগ করেন। বার্ধক্যজনিত কারণ ছাড়াও তিনি জটিল হার্ট, কিডনি, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপসহ নানা রোগে ভুগছিলেন। ১০৪ বছর বয়সে তার জীবনপ্রদীপ নিভে যায়। শুক্রবার সন্ধ্যার পর আল্লামা শফীর মৃত্যুর খবর প্রচার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার অসংখ্য ভক্ত, ছাত্র, শুভান্যুধায়ী, সমর্থক এবং হেফাজতের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে বিষয়টি প্রচ-ভাবে নাড়া দেয়। মৃত্যুর খবর শুনে অনেকেই ঢাকার আজগর আলী হাসপাতালমুখী হন। আবার অনেকে জানাজার নামাজে অংশ নিতে দূর দূরান্ত থেকে চট্টগ্রামের হাটহাজারী মইনুল ইসলাম মাদ্রাসামুখী হন। জানাজার সময় মাদ্রাসার বিশাল প্রাঙ্গণসহ প্রতিটি ভবনে ছিল ভক্তদের ভিড়। আশপাশের প্রতিটি ভবনের ছাদ ছিল লোকে লোকারণ্য। প্রবীণ এই আলেমের জানাজাকে কেন্দ্র করে আশপাশসহ দেশের বিভিন্ন জেলা উপজেলা থেকে মানুষের ঢল নামতে পারে এ ধারণায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে আগেভাগেই অতিরিক্ত পুলিশ ছাড়াও চট্টগ্রামের চার উপজেলা পটিয়া, হাটহাজারী, ফটিকছড়ি ও রাঙ্গুনীয়ায় ১০ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়। নিরাপত্তা ব্যবস্থার সঙ্গে নিয়োগ করা হয় ১০ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। এছাড়া মাদ্রাসার উভয় দিকে তিন কিলোমিটারব্যাপী সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। জানাজায় অংশ নিতে এবং শেষবারের মতো মরহুমকে একনজর দেখার জন্য যারা এসেছিলেন তাদের সকলকে হেঁটেই মাদ্রাসা অভ্যন্তর প্রাঙ্গণে পৌঁছতে হয়। জানাজা উপলক্ষে এতবেশি মানুষ ভিড় জমিয়েছিল মাদ্রাসা প্রাঙ্গণ ছাড়াও প্রধান সড়কজুড়ে অংশগ্রহণকারী মুসল্লিদের তিল ধারনে ঠাঁই ছিল না। বাদ জোহর মরহুমের এ বিশাল নামাজে জানাজা শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়। এ সময় হাটহাজারীতে ৪ প্লাটুন, পটিয়ায় ২ প্লার্টুন, রাঙ্গুনীয়ায় ২ এবং ফটিকছড়িতে ২ প্লার্টুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের নেতৃত্বে বিজিবি সদস্যরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহায়তা করলেও পরিস্থিতি সামলে রাখতে তাদের প্রচ- বেগ পেতে হয়। আল্লামা শফীর মৃত্যু ও জানাজাকে কেন্দ্র করে পুরা হাটহাজারী এলাকা লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। ভোর রাত থেকে জানাজা শেষঅবধি এ পরিস্থিতি অব্যাহত ছিল। দীর্ঘদিনের কর্মস্থল দারুল উলুম মইনুল ইসলাম মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতার কবরের পাশে মরহুমকে সমাহিত করার সিদ্ধান্ত প্রদান করা হয় মরহুমের পরিবারের পক্ষ থেকে। যদিও মরহুমের গ্রামের বাড়ি রাঙ্গুনীয়ার পাখিরারটিলা গ্রামে। মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষীয় সূত্রে জানানো হয়, মরহুমের পিতা প্রয়াত বরকত আলী ও মাতা প্রয়াত মেহেরুন্নেসা। তিনি এ মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন। ছাত্রত্ব জীবন শেষ করে এ মাদ্রাসাতেই কর্মজীবন শুরু করেন এবং একপর্যায়ে মাদ্রাসা পরিচালনা বোর্ডের সদস্য আরও পরে মহাপরিচালক (মুহতামিম) পদে মৃত্যুর একদিন পূর্ব পর্যন্ত আসীন ছিলেন। ১৯৮৬ সাল থেকে টানা ৩৪ বছর ধরে তিনি এ মাদ্রাসার দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের (বেফাক) সভাপতির দায়িত্বেও ছিলেন তিনি। বাংলা ও উর্দু ভাষায় তার লেখা ২২টি গ্রন্থ রয়েছে। ২০১০ সালে আল্লামার শফীর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠা হয় হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ সংগঠনের আমিরের পদে দায়িত্ব পালন করে গেছেন। তাঁর ২ পুত্র ও ৩ কন্যা রয়েছে। ২ পুত্রের মধ্যে আনাস মাদানী হেফাজতে ইসলামের প্রচার সম্পাদক। জ্যেষ্ঠ সন্তান মাওলানা মোহাম্মদ ইউসুফ রাঙ্গুনীয়ার পাখিরারটিলা কওমি মাদ্রাসার পরিচালক। এদিকে জানাজার আগে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন সাবেক মন্ত্রী ও হাটহাজারীর সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, মাদ্রাসার সিনিয়র মুহাদ্দিস ও হেফাজত ইসলামের মহাসচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী, সহকারী পরিচালক মাওলানা শেখ আহমদ, মুফতি জসিম উদ্দিন প্রমুখ। হেফাজত আমির আল্লামা শফীর মৃত্যুতে বিভিন্ন মহলের শোক প্রকাশ অব্যাহত রয়েছে। তার মৃত্যুতে শনিবার শোক জানিয়েছেন চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মাহবুবুল আলমসহ পরিচালকবৃন্দ।
×