ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আয়ান আব্রাজ

হারানো রাজ্য ফিরে পেলেন ওসাকা

প্রকাশিত: ২১:৪৫, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২০

হারানো রাজ্য ফিরে পেলেন ওসাকা

আবারও বাজিমাত করলেন নাওমি ওসাকা। দুর্দান্ত পারফর্মেন্সের সৌজন্যে ইউএস ওপেনের শিরোপা পুনরুদ্ধার করলেন জাপানি তারকা। নাওমি ওসাকা এবারের ইউএস ওপেন ২০২০ টুর্নামেন্ট শুরুর পর থেকেই শিরোনামে। বর্ণবিদ্বেষ এবং বিভিন্ন সময়ে পুলিশি আত্মত্যাগের শিকার হয়েছেন যাঁরা, তাঁদের নাম নিজের প্রতি ম্যাচের মাস্কে লিখে, সেই মাস্ক পরে কোর্টে নেমেছিলেন তিনি। এবং সেই থেকেই নজর কেড়েছিলেন ওসাকা। তা নিয়ে বিস্তর লেখালিখি হয়েছে, চর্চায় থেকে গিয়েছেন জাপানি টেনিস তারকা। তবে সে সবের উত্তর যেন ফাইনালে চ্যাম্পিয়ান হয়ে ট্রফিটা হাতে তুলেই নিঃশব্দে দিয়ে দিলেন টেনিসের নতুন এই তারকা। অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া আজারেঙ্কাকে হারিয়ে ইউ এস ওপেন ২০২০-র ফাইনালে জয়ী হলেন নাওমি ওসাকা। ফাইনালের জন্য কোর্টে যখন তিনি প্রবেশ করেন তার মুখাবরণে লেখা ছিল তামির রাইস-এর নাম। ১২ বছর বয়সী আমেরিকান কিশোর তামির ২০১৪ সালে পুলিশের গুলিতে মারা যান যুক্তরাষ্ট্রের ওহিওতে। তার এই প্রতিবাদের পাশে দাঁড়িয়ে ২২ বছর বয়সী জাপানী তরুণীর দাদা তেতসুয়ো সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আমার নাতনি ভীষণ সাহসী। ওর জন্য আমি গর্বিত।’ জাপানের সংবাদমাধ্যমে নাওমির এশিয়ান খেলোয়াড় হিসেবে রেকর্ড তৃতীয় গ্র্যান্ডস্ল্যাম ট্রফি জয় ও প্রতিবাদের প্রশংসা করা হয়েছে। জাপানের একটি সংবাদপত্রে লেখা হয়েছে, ‘নাওমির এই জয় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মানুষদের আরও সংগঠিত করবে।’ ফাইনালে প্রশ্ন করা হয় তিনি এই প্রতিবাদের মাধ্যমে কোন বার্তা দিতে চান? যা শুনে পাল্টা ওসাকা প্রশ্ন করেন, ‘আপনি কোন বার্তা পাচ্ছেন? আমি চাই এই বিষয়ে মানুষ মুখ খোলা শুরু করুক।’ জাপানে জন্ম হলেও যুক্তরাষ্ট্রেই বড় হয়েছেন নাওমি। থাকেন লস এ্যাঞ্জেলসে। তাই মাার্কিন মুলুক তার কাছে নিজের দেশের মতোই। ‘আমি কোর্টের বাইরে যা যা করেছি সেটা কোর্টের মধ্যেও করার চেষ্টা করেছি। এই ব্যাপারটা আমাকে আরও শক্তি দিয়েছে। কারণ আমি চেয়েছিলাম প্রতিটা ম্যাচ জিতে আরও সবার সামনে আনতে’ বলেছেন দ্বিতীয়বার ইউএস ওপেন জয়ী নাওমি ওসাকা। ইউএস ওপেন শুরু হওয়ার আগেই ওসাকার এই প্রতিবাদ হৈচৈ ফেলে দিয়েছিল টেনিস দুনিয়ায়। গত মাসে জ্যাকব ব্লেক নামে কৃষ্ণাঙ্গের পুলিশের গুলিতে মারা যাওয়ার পর ওয়েস্টার্ন ও সাউদার্ন ওপেনে তিনি সেমিফাইনাল থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন। তার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন কিংবদন্তি বিলি জিন কিংসহ আরও অনেকে। ট্রফি জেতার পর ওসাকার আর একটা ইচ্ছেও পূরণ হয়েছে। আগে দেখেছেন ফাইনালে জিতেই কোর্টে শুয়ে পড়তে বিজয়ীদের। কি দেখেন তারা ওভাবে জানার ইচ্ছে ছিল। শনিবার তিনি ম্যাচ জিতে কোর্টে শুয়ে পড়েন। এই সুযোগটা পেয়ে তিনি খুশি। ওসাকার আরও ইচ্ছে যে সাতজনের স্মৃতিকে তিনি সম্মান জানানোর উদ্যোগ নিয়েছেন তাদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করা। ওসাকার একইসঙ্গে আন্তরিক এবং প্রতিবাদী রূপের জন্যই এখন তাকে বলা শুরু হয়ে গেছে মাঠের পাশাপাশি চ্যাম্পিয়ন মাঠের বাইরেও। ২২ বছরের নাওমি ওসাকার কাছে থেমে গেল ভিক্টোরিয়া আজারেঙ্কার স্বপ্নের দৌড়। ফাইনালে প্রথম সেট হেরে গেলেও, দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়ান ওসাকা। শেষ মেশ জাপানি তারকা ১-৬, ৬-৩, ৬-৩ গেমে আজারেঙ্কাকে হারিয়ে খেতাব জিতে নেন। এর আগে ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র ওপেন জিতেছিলেন ওসাকা। আজারেঙ্কার বিপক্ষে রবিবারের ফাইনালে ‘তামির রাইস’ এর নাম মাস্কে লিখে খেলতে নেমেছিলেন তিনি। ছয় বছর আগে ক্লিভল্যান্ডে ১২ বছরের তামিরকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। তাকে স্মরণ করেই এ দিন ফাইনালে নেমেছিলেন ওসাকা। প্রথম সেটে ১৩টা আনফোর্সড-এরর করে পিছিয়ে গিয়েছিলেন ওসাকা। প্রথম সেটে ১-৬ গেমে শুধুই ৩১ বছরের আজারেঙ্কার দাপট দেখেছে ফ্লাশিং মিডোয়। ফাইনালের প্রথম সেটেই কোর্টে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন আজারেঙ্কা। সেমিফাইনালে সেরিনা উইলিয়ামসকে হারিয়ে খেতাব জেতার স্বপ্ন দেখছিলেন তিনি। প্রথম সেট ৬-১-এ জিতে নেয়ার পরে, দ্বিতীয় সেটেও ৩-০-এ এগিয়ে গিয়েছিলেন আজারেঙ্কা। ওসাকা যে ফাইনাল হারতে চলেছেন, তা অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন। কিন্তু বেশিক্ষণ সময় লাগে ম্যাচ ঘুরতে। তারুণ্যে ভরপুর ওসাকা দ্বিতীয় সেটের শুরুতেই বেঁধে দিয়েছিলেন ফাইনালের ছন্দ। ৬-৩ এবং ৬-৩ গেমে আজারেঙ্কাকে হারিয়ে ফাইনালের রানী হলেন- ওসাকা। কোর্টের মাঝে শুয়ে পড়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে কী যেন বললেন যুক্তরাষ্ট্র ওপেনের বিজয়ীনি। শিরোপা জয়ের জন্য ওসাকা এবার বদ্ধপরিকর ছিলেন। ম্যাচ শেষে তার কথাতেই ফুটে উঠেছে যা। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘আমি যখন অতিরিক্ত জেতার ব্যাপারে চিন্তা করি, তখনই সমস্যা হয়। আমি আর আমি থাকি না। জেতার জন্য শান্ত থাকা খুব জরুরী। কিছুক্ষণ খেলার পর মনে হচ্ছিল, জেতা হবে না। পরে ভাবলাম, আমি একটা ফাইনাল খেলতে এসেছি। অনেক মানুষ ফাইনাল খেলতে চায়। এমন অবস্থায় এক ঘণ্টায় ৬-৩, ৬-০ সেটে হারতে পারি না আমি।’ নাওমি ওসাকা এ সময় আরও বলেন, ‘শিরোপা জেতার মুহূর্তটা আমার জন্য সত্যিই অবিশ্বাস্য ছিল। শেষ পর্যন্ত চ্যাম্পিয়ন হতে পেরেছি, সেজন্য আমি খুবই আনন্দিত।’ ইউএস ওপেন জেতার পর প্রয়াত বাস্কেটবল কিংবদন্তি কোবি ব্রায়ান্টের নাম লেখা জার্সি পরে সাংবাদ সন্মেলনে আসেন ওসাকা। তার কথা স্মরণ করে বলেন, ‘কোবি যেমন ছিলেন, আমিও তেমনটাই হতে চাই। কোবি মনে করতেন, তিনিই সেরা হবেন। আশা রাখি, আমিও একদিন সেরা হব।’ দীর্ঘদিন পর গ্র্যান্ডস্লাম জয়ের খুব কাছাকাছি পৌঁছেও শেষ পর্যন্ত শিরোপার দেখা পেলেন না ভিক্টোরিয়া আজারেঙ্কা। বেলারুশ সুন্দরীর সামনে এবার নতুন এক মাইলফলকের হাতছানিও ছিল। মা হওয়ার পর হাতে গোনা যে তিনজন নারী খেলোয়াড় গ্র্যান্ডস্লাম জিতেছেন, তাঁদের একজন মার্গারেট কোর্ট। ফাইনালে এবার ওসাকাকে হারালেই সেই চ্যাম্পিয়ন মায়েদের কাতারে নাম লেখানোর সুযোগ ছিল তার। কিন্তু পারলে না সেই রেকর্ডে ভাগ বসাতে। মার্গারেট কোর্ট ছাড়া অন্য দুই চ্যাম্পিয়ন মা হলেন-ইভোন গুলাগং ও কিম ক্লাইস্টার্স। স্বামী, বাচ্চা, সংসার সামলে গ্র্যান্ডস্লাম জেতা চাট্টিখানি কথা নয়! উন্মুক্ত যুগের টেনিসে চ্যাম্পিয়ন টেনিস মায়েদের সংখ্যাটা তাই তিনেই সীমাবদ্ধ থাকল। প্রথম সন্তানের জন্মের পরের বছর মার্গারেট কোর্ট ফিরেছিলেন পুরো ফিট হয়ে, চেনা ছন্দে। উইম্বলডন ছাড়া সে বছর বাকি তিনটি গ্র্যান্ডস্লামই জিতেছিলেন তিনি। প্রথম চ্যাম্পিয়ন মা হওয়ার কৃতিত্বটা মার্গারেট কোর্টের। তাঁর ২৪টি শিরোপার শেষ তিনটি জিতেছিলেন মা হওয়ার পরই। ১৯৭২ সালের মার্চে প্রথম সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন কোর্ট। সে বছর ইউএস ওপেনে অংশ নিয়ে উঠেছিলেন সেমিফাইনালে। সেবার শেষ চারেই মা কোর্টের দৌড় শেষ হলেও পরের বছর ফিরেছিলেন পুরো ফিট হয়ে, চেনা ছন্দে। উইম্বলডন ছাড়া সে বছর বাকি তিনটিই গ্র্যান্ডস্লামই জিতেছিলেন তিনি। ১৯৭৪ সালে দ্বিতীয় সন্তানের মা হওয়ার জন্য টেনিস ছেড়ে দিয়েছিলেন কোর্ট। পরে ফিরে এসে ডব্লিউটিএ টুর্নামেন্ট জিতলেও গ্র্যান্ডস্লামে আর সাফল্য পাননি। ১৯৭৫ সালে শেষ গ্র্যান্ডস্লাম হিসেবে ইউএস ওপেন খেলা কোর্ট টেনিস থেকে বিদায় নিয়েছিলেন ১৯৭৭ সালে। এদিকে, পুরুষ এককে রূদ্ধশ্বাস ম্যাচের শেষে ইউএস ওপেন খেতাব জিতে নিলেন ডোমিনিক থিয়েম। রজার ফেদেরার, রাফায়েল নাদাল, নোভাক জোকোভিচবিহীন টুর্নামেন্টে এই গ্র্যান্ডস্লাম যে নতুন চ্যাম্পিয়ন পাবে তা প্রত্যাশিতই ছিল। পাঁচ গেমের ম্যারাথন ম্যাচের পর টাইব্রেকারে কাপ হাতে উঠল দ্বিতীয় বাছাই অস্ট্রিয়ার ডোমিনিক থিয়েমের হাতে। বিশ্বতালিকায় তিন নম্বরে থাকা ২৭ বছরের থিয়েম প্রথম দুটি সেট হারিয়ে পিছিয়ে পড়েছিলেন। সেখান থেকেই দুরন্ত কামব্যাক করে অবশেষে খেতাব জিতে নিলেন তিনি। ২০০৪ সালের ফরাসি ওপেনের পর এমন ঘটনা প্রথম ঘটল, যখন কোন খেলোয়াড় দুই সেট পিছিয়ে পড়েও অপ্রতিরোধ্যভাবে ম্যাচে ফিরে এসে খেতাব জিতে নিয়ে গেলেন। হার মানতে হল পঞ্চম বাছাই জার্মানির আলেক্সান্ডার জেভরেভকে। খেলার ফল ২-৬, ৪-৬, ৬-৪, ৬-৩, ৭-৬ (৮/৬)। ৪ ঘণ্টা ২ মিনিটের দুরন্ত লড়াইয়ের শেষে চ্যাম্পিয়ন হন থিয়েম। এর আগে তিনবার ফাইনালে উঠে তাঁকে হারতে হয়েছে। ২০১৮ ও ২০১৯ সালের ফরাসী ওপেন ও ২০২০ সালের অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের ফাইনালে পরাজিত হন তিনি। এদিনও শুরুটা দেখে মনে হয়েছিল এ বারও সেই পরিণতি হতে চলেছে। বেশ কিছু আনফোর্সড এররও করে ফেলেন। খোয়াতে হয় প্রথম দুই সেট। এরপর তৃতীয় সেট থেকে কামব্যাক শুরু করেন থিয়েম। ক্লান্তির জেরে জেভরেভের দ্বিতীয় সার্ভিসের গতি বেশ কিছুটা কমে যায়। পরের দুটি সেট জিতে পঞ্চম সেটে খেলা নিয়ে যান থিয়েম। শেষ সেটেও চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সুযোগ এসেছিল জেভরেভের কাছে। তাঁর পক্ষে ফল ৫-৩ অবস্থায় সার্ভিস খোয়ান জেরেভ। ৬-৫ এগিয়ে যাওয়া অবস্থায় নিজের সার্ভিস খোয়ান থিয়েমও। ফলে টাইব্রেকারে গড়ায় সেই সেট। সেখানেও পরপর দুটি ডাবল ফল্টের খেসারত দিতে হয় জেভরেভকে। ম্যাচ হাতের মুঠোয় করে নেন থিয়েম।
×