ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

চুল কাটা নিয়ে বিরোধের জের, আটক ৫

যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঁচ কর্মকর্তার নেতৃত্বে চলে পৈশাচিক নির্যাতন

প্রকাশিত: ২৩:০৪, ১৬ আগস্ট ২০২০

যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঁচ কর্মকর্তার নেতৃত্বে চলে পৈশাচিক নির্যাতন

স্টাফ রিপোর্টার, যশোর অফিস ॥ যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে ৫ কর্মকর্তার নেতৃত্বে কিশোর বন্দীদের ওপর পৈশাচিক নির্যাতন চালানো হয়। এই নির্যাতনে ৩ কিশোর নিহত ও ১৫ জন আহত হয়। পুলিশ ওই পাঁচ কর্মকর্তাকে আটক করেছে। এছাড়াও মারপিটে অংশ নিয়েছিল কর্মকর্তাদের অনুুগত ৭/৮ জন কিশোর বন্দী। ‘চুল কাটা নিয়ে বিরোধের সূত্র ধরে’ মিটিং করে সিদ্ধান্ত নিয়ে ওই মারপিট করা হয়। গত ১৩ আগস্ট যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে হতাহতের ঘটনায় পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে এসব তথ্য উঠে এসেছে। শনিবার দুপুরে প্রেসব্রিফিং করে প্রাথমিক তদন্তের এসব তথ্য জানান যশোরের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আশরাফ হোসেন। অন্যদিকে এই ঘটনায় সমাজসেবা অফিদফতরের গঠিত তদন্ত কমিটি তাদের কাজ শুরু করেছে। আটককৃতরা হলেন, যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক ও সহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মাসুদ, সহকারী তত্ত্বাবধায়ক প্রবেশন অফিসার মাসুম বিল্লাহ, কারিগরি প্রশিক্ষক ওমর ফারুক, ফিজিক্যাল ইনস্ট্রাক্টর একেএম শাহানুর আলম ও সাইকো সোস্যাল কাউন্সিলর মুশফিকুর রহমান। শুক্রবার ১০ জন কর্মকর্তা কর্মচারী হেফাজতে নেয়া হলে মামলার পর রাতে এই ৫ জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়। ঘটনার সূত্রপাত ॥ যশোরের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আশরাফ হোসেন ব্রিফিংকালে জানান, ঘটনার সূত্রপাত হয় গত ৩ আগস্ট। এদিন কিশোর বন্দী হৃদয়কে (যে চুল কাটায় পারদর্শী) চুল কেটে দিতে বলেন কেন্দ্রের নিরাপত্তাপ্রধান (হেড গার্ড) নূর ইসলাম। ঈদের আগে হৃদয় প্রায় দু’শ বন্দীর চুল কাটায় তার হাত ব্যথা উল্লেখ করে চুল কাটতে অস্বীকৃতি জানায়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে নূর ইসলাম কেন্দ্রে’র তত্ত্বাবধায়ক আব্দুল্লাহ আল মাসুদ, সহকারী তত্ত্বাবধায়ক মাসুম বিল্লাহ’র কাছে অভিযোগ করেন, ‘ওরা ট্যাবলেট খেয়ে নেশাগ্রস্ত হয়ে রয়েছে।’ এছাড়াও তিনি হৃদয় ও তার বন্ধু পাভেলের মধ্যে অনৈতিক সম্পর্কের ইঙ্গিত করেন। সেখানে উপস্থিত কিশোর নাঈম অভিযোগ শুনে বিষয়টি পাভেলকে জানিয়ে দেয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে পাভেল তার কিছু অনুসারী কিশোরকে নিয়ে নূর ইসলামকে মারপিট করে। এতে তার হাত ভেঙ্গে যায়। এ ঘটনার সূত্র ধরেই ১৩ আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। কী ঘটেছিল ১৩ আগস্ট ॥ জাতীয় শোকদিবস পালন উপলক্ষে ১৩ আগস্ট যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ১৯ জন কর্মকর্তা কর্মচারী উপস্থিত ছিলেন। এই সভায় ‘নূর ইসলামের ওপর হামলাকারীদের শাস্তি প্রদানের’ সিদ্ধান্ত হয়। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শনাক্ত হামলাকারী ১৩ জনসহ আরও কয়েকজনকে বের করে আনা হয়। ওই পাঁচ কর্মকর্তার নেতৃত্বে কয়েকজন কর্মচারী এবং কর্মকর্তাদের আজ্ঞাবহ ৭/৮ জন কিশোর বন্দী ‘অভিযুক্তদের’ মারপিট শুরু করে। এ সময় তাদের ওপর পৈশাচিক নির্যাতন চালানো হয়। মুখে গামছা ঢুকিয়ে জানালা দিয়ে হাত বাইরে বের করে টেনে ধরে পেছনে বেধড়ক মারপিট করা হয়। লোহার রড, ক্রিকেট স্টাম্প ইত্যাদি দিয়ে বেপরোয়া মারপিট করা হয়। অচেতন হয়ে গেলে মারপিট বন্ধ করে ফের জ্ঞান ফিরলে মারপিট করা হয়। পালাক্রমে এভাবে মারপিটের পর গুরুতর জখম অবস্থায় এদের একটি ঘরে ফেলে রাখা হয়। একজন ‘কম্পাউন্ডার’ দিয়ে সামান্য চিকিৎসার ব্যবস্থা করলেও এদের হাসপাতালে না পাঠিয়ে প্রায় ৬ ঘণ্টা ফেলে রাখা হয়। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে মৃতপ্রায় অবস্থায় একজনকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। হাসপাতাল থেকে খবর পেয়ে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, সিভিল সার্জনসহ কর্মকর্তারা সেখানে গিয়ে এক অবর্ণনীয় পরিবেশ দেখতে পান। নির্যাতনের শিকারদের দুপুরে খাবার না দিয়ে, চিকিৎসা না দিয়ে গরমের মধ্যে গাদাগাদি অবস্থায় ফেলা রাখা হয়েছে। এরই মধ্যে আরও দুজনকে হাসপাতালে পাঠানো হলে তারাও মারা যায়। পরে এ্যাম্বুলেন্স ও পুলিশের পিকাপে করে ১৪ জনকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। পরদিন আরও একজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ নিয়ে এই মর্মান্তিক ঘটনায় তিনজন নিহত ও ১৫ জন আহত ছিল। নিহতরা হলো, বগুড়ার শিবগঞ্জের তালিবপুর পূর্বপাড়ার নান্নু প্রামাণিকের ছেলে নাঈম হোসেন (১৭), একই জেলার শেরপুর উপজেলার মহিপুর গ্রামের আলহাজ নুরুল ইসলাম নুরুর ছেলে রাসেল ওরফে সুজন (১৮) এবং খুলনার দৌলতপুরের মহেশ্বরপাশা পশ্চিম সেনপাড়ার রোকা মিয়ার ছেলে পারভেজ হাসান রাব্বি (১৮)। নিহত রাব্বির রেজিস্ট্রেশন নাম্বার ১১৮৫৩। আর রাসেল ও নাঈমের রেজিস্ট্রেশন নাম্বার যথাক্রমে ৭৫২৪ ও ১১৯০৭। নাঈম হোসেন ধর্ষণ এবং রাব্বি হত্যা মামলার আসামি ছিল। পরবর্তী পদক্ষেপ ॥ ঘটনার পর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের কর্মকর্তারা ‘দু’পক্ষের সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনা’ বললেও পরবর্তীতে আহত কিশোর বন্দীদের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে প্রকৃত ঘটনা বের হয়ে আসতে শুরু করে। পুলিশ দ্রুত তদন্তের দায়িত্ব নিয়ে কেন্দ্রের ১০ জন কর্মকর্তা কর্মচারীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ হেফাজতে নেয়। ১৪ আগস্ট সন্ধ্যা রাতে হত্যাকা-ের ঘটনায় যশোর কোতোয়ালি থানায় মামলা দায়ের করেন নিহত পারভেজ হাসান রাব্বি’র (১৮) পিতা খুলনার দৌলতপুরের মহেশ্বরপাশা পশ্চিম সেনপাড়ার রোকা মিয়া। মামলায় শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র কর্তৃপক্ষকে বিবাদী করা হয়। মামলার পর পুলিশ হেফাজতে নেয়া ১০ কর্মকর্তা কর্মচারীর মধ্যে ৫ জনকে গ্রেফতার করে। পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আশরাফ হোসেন জানান, ওই তদন্ত কমিটির পাশাপাশি পুলিশও মামলার তদন্ত অব্যাহত রেখেছে। ওই মিটিংয়ে থাকা ১৯ জনের সাক্ষাতকার গ্রহণ, তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে জড়িত হিসেবে প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত হওয়ায় ৫ কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের আদালতে সোপর্দ করে রিমান্ড আবেদন করা হবে। এছাড়াও জড়িত ৭/৮ কিশোর বন্দীকে এই মামলায় আইনের আওতায় আনতে আদালতে আবেদন করা হবে। পুলিশ সুপার উল্লেখ করেন, তারা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ঘটনার বিশ্লেষণ করে সতর্কতার সঙ্গে মামলার তদন্তকাজ পরিচালনা করছেন। যাতে প্রকৃত চিত্র ও প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করে আদালতে উপস্থাপন করতে পারেন। সংবাদ সম্মেলনে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি) মোঃ তৌহিদুল ইসলাম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার গোলাম রাব্বানী, যশোর কোতোয়ালি থানার ওসি মনিরুজ্জামান প্রমুখ। এদিকে, শুক্রবারই ‘বন্দী’ তিন কিশোর নিহত হওয়ার ঘটনায় কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক আব্দুল্লাহ আল মাসুদকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পাশাপাশি গঠন করা হয় দু’টি তদন্ত কমিটি। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব শুক্রবার বিকেলে তিন সদস্যবিশিষ্ট এই কমিটি গড়ে দেন। যশোরের জেলা প্রশাসক মোঃ তমিজুল ইসলাম খান বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিন সদস্যবিশিষ্ট কমিটির প্রধান করা হয়েছে যশোরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ আবুল লাইছকে। এ ছাড়া সদস্যসচিব সমাজসেবা অধিদফতর যশোরের উপ-পরিচালক অসিত কুমার সাহা এবং সদস্য করা হয়েছে জেলা পুলিশ সুপারের একজন প্রতিনিধি, যিনি এএসপি পদমর্যাদার নিচে নন। কমিটিকে আগামী পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। এর আগে সমাজসেবা অধিদফতর দুই সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে বিজ্ঞপ্তি জারি করে। ওই কমিটির প্রধান করা হয় সমাজসেবা অধিদফতরের পরিচালক (প্রতিষ্ঠান) সৈয়দ মোহাম্মাদ নুরুল বসিরকে। তার সঙ্গে তদন্তকাজে সহায়তা করবেন উপ-পরিচালক (প্রতিষ্ঠান-২) এসএম মাহমুদুল্লাহ। আগামী তিন কর্মদিবসের মধ্যে এ কমিটিকে মহাপরিচালকের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার নির্দেশ দেয়া হয়। শনিবার সকালে উভয় কমিটি কাজ শুরু করেছে। বেলা ১১টার দিকে সমাজসেবা অধিদফতরের পরিচালক (প্রতিষ্ঠান) যুগ্ম সচিব সৈয়দ মোঃ নুরুল বাসির ও সমাজসেবা অধিদফতরের উপ-পরিচালক (প্রতিষ্ঠান-২) এমএম মাহামুদুল্লা যশোরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ আবুল লাইছকে সঙ্গে নিয়ে হাসপাতাল এবং ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়কসহ পাঁচজন রিমান্ডে ॥ যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে মারপিটে তিন কিশোর নিহতের ঘটনায় আটক কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়কসহ পাঁচজনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। শনিবার বিকেলে যশোর জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক মাহাদি হাসান তাদের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এর আগে শুক্রবার রাতে তাদের গ্রেফতার দেখানো হয়। আদালতে হাজির করে আটককৃতদের সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা চাঁচড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ রোকিবুজ্জামান। শুনানি শেষে তত্ত্বাবধায়ক (সহকারী পরিচালক) আব্দুল্লাহ আল মাসুদ, সহকারী তত্ত্বাবধায়ক মাসুম বিল্লাহ, ফিজিক্যাল ইন্সট্রাক্টর শাহানূর সাইকো সোস্যালকে পাঁচদিন এবং কাউন্সিলর মুশফিকুর রহমান ও ওমর ফারুককে তিনদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়। এর আগে, শুক্রবার রাতে কোতোয়ালি থানায় একটি মামলা করেন নিহত কিশোর পারভেজ হাসান রাব্বির বাবা খুলনার দৌলতপুরের মহেশ্বরপাশা পশ্চিম সেনপাড়ার রোকা মিয়া। মামলায় শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র কর্তৃপক্ষকে আসামি করা হয়।
×