ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বড় বড় প্রকল্পের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট

প্রকাশিত: ২৩:১০, ৮ আগস্ট ২০২০

বড় বড় প্রকল্পের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট

ফিরোজ মান্না ॥ ছাব্বিশ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি ঢাকা ওয়াসা। গত ১১ বছরে এই টাকা ব্যয় করে ‘ঘুরে দাঁড়াও ঢাকা ওয়াসা’ নামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে তারা। তবে এই সময় পানির দাম বাড়ানো হয়েছে ১১ বার। প্রতি হাজার লিটার পানির দাম পৌনে ৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে এখন ১৪ টাকা ৪৬ পয়সা করা হয়েছে। আর বড় বড় প্রকল্পের নামে লুটপাট হয়েছে সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকা। ১১ বছরে ওয়াসা ৪০টির বেশি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। কোন প্রকল্পই এখনও জনগণের কল্যাণে আসেনি। বরং প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার আগেই টাকা তুলে নিয়ে গেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ধীর গতিতে বাস্তবায়ন করে সময় ও টাকার অঙ্ক বাড়ানো হয়েছে। প্রায় প্রতি প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর কারণে এখনও অনেক কাজ চলমান রয়েছে। নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, ব্যাপক দুর্নীতি আর অনিয়মের কারণে ওয়াসার আজ এমন পরিণতি। বিভিন্ন সময় ওয়াসার এই অবস্থার কথা তুলে ধরা হলেও কোন ফল হয়নি। উল্টো অনেকেই এমডির রোষানলে পড়ে চাকরি হারিয়েছেন। এ বিষয়ে ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খানের কাছে জানতে চাইলে টেলিফোনে তিনি কোন কথা বলতে রাজি হননি। তিনি বলেছেন, তাকে লিখিত প্রশ্ন পাঠাতে হবে। এই প্রতিবেদক ওয়াসার এমডিকে লিখিত প্রশ্ন পাঠালে তিনি তার জবাব দেন। লিখিত জবাবে তিনি বলেছেন, গত ১১ বছরে ওয়াসার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ওয়াসা এখন রোল মডেল হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে। তার বেশিরভাগ জবাবই ছিল দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পক্ষে। জনকল্যাণ প্রসঙ্গে বলেছেন, মানুষ এখন বাসায় বসে ওয়াসার বিল দিতে পারেন। অনলাইনে অভিযোগ জানাতে পারেন। এটা একটা বড় অর্জন। এর আগের রিপোর্টে ওয়াসার এমডির সব জবাব তুলে ধরা হয়েছে। তিনি এখন ৬ষ্ঠবারের মতো নিয়োগ পেতে নানা মহলে জোর তদ্বির চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি ওয়াসার একজন মহিলা কর্মকর্তাকে দিয়ে ক্ষমতাসীন দলের উচ্চ পর্যায়ের নেতার কাছে তদ্বির করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ওই কর্মকর্তার সঙ্গে আওয়ামী লীগের ওই নেতার সুসম্পর্ক রয়েছে বলে জানা গেছে। ওয়াসায় প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কর্মকর্তাদের অনেককেই চাকরি থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। আর কাউকে বছরের বছর ওএসডি করে রাখা হয়েছে। এখন যারা ওয়াসায় বড় আওয়ামী লীগ হিসাবে পরিচিত তাদের প্রায় সবাই বিএনপির সময় সুবিধাভোগী। তারা তখন বিএনপির কর্মী হিসাবে কাজ করেছেন। তাদেরই ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খান গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে রেখেছেন। তারা এখন ওয়াসার এমডির কাছের মানুষ। স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন এবং সমবায় মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী তাজুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেছেন, ওয়াসার অনেক বিষয়ে অসঙ্গতি রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে সরকারের উচ্চ মহলেও আলোচনা হয়েছে। এমডি নিয়মবহির্ভূত ৫ বার নিয়োগ পাওয়ার বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, এই নিয়োগ আমার সময় হয়নি। তিনি কিভাবে এতবার নিয়োগ পেয়েছেন তা বলা আমার পক্ষে মুশকিল। আমি ওয়াসার বেশ কয়েকটি প্রকল্প ও খাল পরিদর্শন করে যা দেখেছি তাতে সন্তুষ্ট হতে পারিনি। এ বিষয়ে ওয়াসাকে চিঠি দিয়ে সতর্ক করা হয়েছে। ওয়াসার যে কোন দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনার অবসান ঘটাতে আমি কাজ করে যাচ্ছি। এটা আমাকে দূর করতেই হবে নগরবাসীর স্বার্থে। ওয়াসা সূত্র জানিয়েছে, ঢাকায় প্রতিবছর জনসংখ্যা গড়ে ৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সেইসঙ্গে গভীর নলকূপের উৎপাদন গড়ে ৫ শতাংশ হারে কমে যাচ্ছে। আগামী ২০২৩ সালে জনসংখ্যা ২ কোটি ছাড়িয়ে যাবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। জনগণের জীবনযাত্রার মান ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার দ্রুত উন্নতি ঘটায় তাদের মাথাপিছু পরিমাণগত পানি ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। একইসঙ্গে ঢাকা শহরের আকার বৃদ্ধি পাওয়ায় জনসংখ্যাও বাড়ছে। ফলে বৃদ্ধি পাচ্ছে পানির চাহিদা। এভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে ২০২৩ সালে পানির চাহিদা বেড়ে ৩৫০০ এমএলডি হবে। ঢাকা ওয়াসা থেকে প্রাপ্ত প্রকল্প তালিকার নথি থেকে বড় কয়েকটি প্রকল্পের উল্লেখ করা হলো। গত ১১ বছরে ৪০টির বেশি প্রকল্প হাতে নিয়েছে ওয়াসা। এর মধ্যে রয়েছে, ৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে পদ্মা-যশোলদিয়া পানি শোধনাগার, সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে গন্ধর্বপুর পানি শোধনাগার, প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার, সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার, সাড়ে ৬শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে তেঁতুলঝোড়া-ভাকুর্তা থেকে ঢাকায় পানি আনা, সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ঢাকা ওয়াটার সাপ্লাই নেটওয়ার্ক ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট। প্রতিটি প্রকল্পের পিডি নিয়ে চরম বিতর্ক রয়েছে। ইতোমধ্যে বেশ একাধিক পিডিকে দুদকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এরা সবাই এমডির লোক হিসাবে পরিচিত। আরও কয়েকজন দুর্নীতিবাজ ইঞ্জিনিয়ারকে দুদক চিঠি দিয়েছে। বাকি ৩৪টি প্রকল্প তৈরি করা রয়েছে এক থেকে ১০ কোটি টাকার মধ্যে। যেগুলো এখানে উল্লেখ করা হলো না। কাজ শেষ হওয়ার আগেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ঢাকা ওয়াসাকে বুঝিয়ে দিয়েছে পদ্মা-যশোলদিয়া এবং সাভারের ভাকুর্তা-তেঁতুলঝোড়া পানি শোধনাগার প্রকল্প। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কেও জানানো হয়েছে, প্রকল্প দুটি সম্পূর্ণ শেষ হয়েছে। এমনকি প্রকল্প দুটির যাবতীয় বিলও তুলে নিয়েছে ঠিকাদার- যার পরিমাণ প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা। এখানেই শেষ নয়। কাজ শেষ হওয়ার অসত্য তথ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দিয়ে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে উদ্বোধন করানো হয়েছে প্রকল্প দুটি। বাস্তবচিত্র গোপন করে প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে এই প্রকল্প উদ্বোধন করা হয়। নিম্নমানের কাজ এবং পুরো কাজ শেষ না করেই পদ্মার মাওয়া পয়েন্ট থেকে রাজধানীতে পানি সরবরাহের পদ্মা-যশোলদিয়া প্রকল্পের কাজ শেষ করেছে ঢাকা ওয়াসা। চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স চায়না সিএএমসি ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড কাজ শেষ না করেই পুরো কাজের বিল তুলে নিয়েছে। এ প্রকল্পের ব্যয় শুরুতে তিন হাজার ৫০৮ কোটি ৭৯ লাখ ১৫ হাজার টাকা থাকলেও পরে তা বাড়িয়ে তিন হাজার ৮শ’ কোটি টাকা করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, ঠিকাদারকে সুবিধা দিতেই পুরো বিল দিয়ে দেয়া হয়েছে। পদ্মা-যশোলদিয়া পানি শোধনাগারের মাধ্যমে রাজধানীবাসীর পানির সঙ্কট মেটাতে ৭ বছর আগে হাতে নেয়া এ প্রকল্পের লক্ষ্য প্রতিদিন ৪৫ কোটি লিটার সুপেয় পানি সরবরাহ। কয়েক দফা সময় বাড়িয়ে প্রধানমন্ত্রীকে ভুল তথ্য দিয়ে প্রকল্পটি গত বছর উদ্বোধন করা হয়। প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে ৭ বছর সময় লেগে যায়। পরে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পুরো বিল তুলে নিয়ে যায়। ঢাকাবাসীর জন্য নেয়া এ প্রকল্প তাদের ঘরে পানি পৌঁছে দিতে এখন পর্যন্ত তৈরিই হয়নি সরবরাহ লাইন। থেকেই যাচ্ছে পানির সঙ্কট। পুরনো লাইনেই চলছে পানি সরবরাহ। দৈনিক ৪৫ কোটি লিটার করে যেখানে মাসে ১ হাজার ৩৫০ কোটি লিটার পানি সরবরাহের কথা সেখানে ঢাকাবাসী পানি পাচ্ছে মাসে ৪৬০ কোটি লিটারের মতো। এতে বছরে প্রকল্পে ক্ষতি হচ্ছে ২শ’ কোটি টাকার বেশি। ওয়াসা সূত্র জানায়, পদ্ম-যশোলদিয়ায় পরিকল্পনা অনুযায়ী মাওয়া থেকে ঢাকায় পানি সরবরাহের জন্য খাল-নদীর তলদেশ দিয়ে পাইপলাইন স্থাপনের কথা থাকলেও তা কোনমতে জোড়াতালি দিয়ে করা হয়েছে। এতে নদীর তলদেশের পাইপের নিরাপত্তার জন্য সেটির ওপর কোন নিরাপত্তা খাঁচা (প্রটেকশন কেজ) দেয়া হয়নি। কয়েক মাস আগে ধলেশ্বরী নদীতে চলাচলকারী একটি নৌযানের তলা ওই পাইপে লাগে। এ ছাড়া নির্ধারিত পাইপের বদলে কম পুরুত্বের পাইপ বসানো হয়েছে এ প্রকল্পে। ২২ মিলিমিটার পুরুত্বের (কে-১০) পরিবর্তে দেয়া হয়েছে ১৯ মিলিমিটার (কে-৯)। এখানে সরকারী অর্থের ব্যাপক নয়ছয় করা হয়েছে। ফলে প্রকল্পের ৩৩ কিলোমিটার পাইপলাইনই নির্মিত হয়েছে নিম্নমানের পাইপ ব্যবহার করে। এদিকে পানির খনি পাওয়ার কথা বলে ২০১২ সালের জুন মাসে সাভারের তেঁতুলঝোড়া ও ভাকুর্তা এলাকায় গভীর নলকূপ স্থাপনের জন্য ভাকুর্তা-তেঁতুলঝোড়া ওয়েলফিল্ড প্রকল্প হাতে নেয় ওয়াসা। বলা হয়েছিল হিমালয় থেকে একটি চ্যানেল এখান দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। যা এক শ’ বছরেও শেষ হবে না। তাই এখান থেকে ঢাকা শহরে পানি আনতে ৫৭৩ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। এ প্রকল্পের আওতায় ৪৬টি পাম্প, পাম্পের পানি শোধনে দুটি আয়রন অপসারণ প্লান্ট, একটি ভূ-উপরিস্থ জলাধার, একটি অফিস ভবন এবং ৪২ কিলোমিটার পানি সরবরাহ লাইন স্থাপন করার উদ্যোগ নেয়া হয়। সেখান থেকে উত্তোলিত পানি মিরপুর এলাকায় সরবরাহ করা হবে। প্রতিদিন পাওয়া যাবে ১৫ কোটি লিটার পানি। ২০১৬ সালের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা থাকলেও ওয়াসা তা পারেনি। দুই দফা সময় বাড়ানো হয়। কিন্তু কয়েকটি পাম্প চালুর পরই আশপাশের সাধারণ টিউবওয়েলগুলোতে পানি তোলা বন্ধ হয়ে যায়। এ অবস্থায় ১৫টি পাম্প চালু করে প্রকল্পের কাজ শেষ করে ঢাকা ওয়াসা। গত বছরের জানুয়ারি মাসে প্রকল্পটি ওয়াসাকে বুঝিয়ে দেয় কোরিয়ান ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হুন্দাই রটেন। কাজের মধ্যে বিল নেয়ার পাশাপাশি প্রকল্প বুঝিয়ে দেয়ার পর বাকি বিলও ওয়াসা থেকে তুলে নেয় তারা। এ রকম সাতটি নলকূপ পাইলিংয়ের পর পড়ে আছে। একেকটির পাইলিংয়ে খরচ হয়েছে ৭০ লাখ টাকা। বাকি ১৫টি নলকূপ চালু করা হয়েছে। অন্যগুলোর অবকাঠামো তৈরির পর সেগুলো বন্ধ আছে। প্রকল্পে বেশি দামে নিম্নমানের পাইপ কেনার প্রতিবাদ করায় সরিয়ে দেয়া হয় আগের প্রকল্প পরিচালককে। এর পর নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে এমডি তার উপদেষ্টা প্রকৌশলী বজলুর রহমানকে প্রকল্প পরিচালক হিসাবে নিয়োগ দেন। সরবরাহ লাইন না করেই ৪ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণের উদাহরণ শুধু পদ্মা-যশোলদিয়াই নয়। এদিকে, সরবরাহ লাইন নিয়ে কোন অগ্রগতি নেই। তারপরও এগিয়ে চলেছে মেঘনা গন্ধর্র্বপুর পানি শোধনাগার প্রকল্প ও দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার প্রকল্পের কাজ। এ প্রকল্পের কোনটিরই সরবরাহ লাইন স্থাপন না করে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকার কাজ চলছে। ওয়াসা নিয়ে পানি বিজ্ঞানী ড. আইনুন নিশাত জনকণ্ঠকে বলেন, ওয়াসায় জবাবদিহিতার অভাবে কোন কাজই ঠিকভাবে হয় না। বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে তারা। কিন্তু ওই প্রকল্পের সুফল পেতে যে সার্ভিস লাইনের প্রয়োজন সেটা করা হয় না। কারণ পরে সার্ভিস লাইন তৈরি করার আরও একটি বড় প্রকল্প হাতে নেবে। নির্মিত প্রকল্প ততদিনে নষ্ট হবে। সেটা আবার ঠিক করতে সরকারের অর্থ খরচ করবে। গত ১০ বছর ধরে একই অবস্থা দেখে আসছি। ওয়াসা আসলে সিটি কর্পোরেশনের আন্ডারে থাকা উচিত। এতগুলো বিভাগ নিয়ে ওয়াসা চলতে পারে না। বর্তমানে ওয়সার অবস্থা হচ্ছে, কাউকে কিছু না বলেই মনের ইচ্ছেমতো প্রকল্প গ্রহণ করা। সিটি কর্পোরেশনের হাতে থাকলে এটা হবে না। একটা জবাবদিতার মধ্য দিয়ে তাকে চলতে হবে। বিশ্বের অনেক দেশেই পানি সরবরাহ ব্যবস্থা সিটি কর্পোরেশনের হাতে রয়েছে। একমাত্র আমাদের দেশের ওয়াসা নেই। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব জনকণ্ঠকে বলেন, সমন্বিত কার্যক্রম, সমন্বিত পরিকল্পনা ছাড়া কোন ভাল কাজ হতে পারে না। ২০১৬ সালের ভয়াবহ বন্যার পরে প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের নেতৃত্বে সমন্বয়ে তৎকালীন স্থানীয় সরকার মন্ত্রী, তৎকালীন পানিসম্পদ মন্ত্রী, তৎকালীন পূর্তমন্ত্রীসহ সম্পৃক্ত করে একটি কমিটি করা হয়েছিল। সেই কমিটিকে ওয়াসার এমডি কৌশলে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। যেসব প্রতিষ্ঠান নিয়ে সভা হয় সেখানে সুনির্দিষ্টভাবে ওয়াসার জন্য পাঁচটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছিল। তার একটি সিদ্ধান্তও ওয়াসা বাস্তবায়ন করেনি। তারপরেও তৎকালীন মন্ত্রী আগামী বছরের মধ্যে জলাবদ্ধতার সমাধান হবে এমন প্রতিশ্রুতি দেন। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপপূর্বক আইন পরিবর্তন পরিবর্ধন করার কথাও তিনি বলেন। গত ১৫ বছর ধরে বারবার যারা প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিভিন্ন প্রকল্প নির্ভর কার্যক্রমে ব্যস্ত ছিলেন তাদের সীমাহীন দুর্নীতির কোন প্রতিকার হয়নি। তাদের লক্ষ্য অর্জন না করা সত্ত্বেও অর্থের অপচয়ের কোন জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যায়নি। ওয়াসার এমডিসহ তারা অনেকেই তিরস্কৃত হওয়ার পরিবর্তে পুরস্কৃত হয়েছেন। ওয়াসার এমডি একটি বিশেষ পরিবারের আত্মীয় বলে প্রচার করে মানুষের মধ্যে ভীতি সৃষ্টি করেছে। মানুষের কাছে তার এই আত্মীয় পরিচয়টি মূল পুঁজি। কিন্তু তিনি যে কেমন আত্মীয় তা আমরা জানি। বিএনপি জামায়াতপন্থী কর্মকর্তাদের বড় বড় প্রকল্পের পিডি নিয়োগ দিয়ে তাদের সুবিধা দিচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বহু প্রকৌশলীর চাকরিচ্যুত করেছে। অনেককে ওএসডি করে রেখেছে। এখান থেকেই বোঝা যায় তার ভেতরের চেহারা কি? এটা শেষ কথা না, আত্মীয় পরিচয়ে নিজের মন মতো প্রকল্পের পর প্রকল্প তৈরি করছে। প্রকল্প বাস্তবায়ন হলেও মানুষের সীমাহীন দুর্ভোগ লাঘব হয়নি। এক জায়গায় সমাধান অন্য জায়গায় চরম দূরবস্থা তৈরি হয়েছে। শান্তিনগরের জলজটের এখন কোন সমাধান হয়নি। শান্তি নগরের পানি বেরিয়ে যাওয়ার মা-া খাল ময়লা আবর্জনায় বন্ধ হয়ে আছে। ওয়াসা ওই খাল পরিষ্কারের কোন উদ্যোগ নেয়নি। কিন্তু ড্রেন নির্মাণ করার জন্য শত শত কোটি টাকা ব্যয় করেছে। তাতে কোন লাভ হয়নি। রাজারবাগ, মতিঝিল, বাসাবো, গোড়ানসহ আশপাশের অন্য নিম্নাঞ্চলগুলো বিপজ্জনক অবস্থার মধ্যে রয়েছে। একইভাবে ধানম-ি ২৭ নম্বরসহ বেশ কয়েকটি এলাকা সামান্য বৃষ্টিতে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান জনকণ্ঠকে বলেন, জলাভূমি, খাল বিল আর নদী পরিবেষ্টিত এক অপূর্ব নৈসর্গিক পরিবেশে ঢাকার যাত্রা শুরু। সেই ঢাকাকে পরিকল্পনার অভাবে মেরে ফেলা হয়েছে। ১৯৭১ সালে স্যার পেট্রিক গেডেস ঢাকা শহরের পরিকল্পনায় জলাশয়, খাল বিল আর নদী নালার গুরুত্বের কথা উল্লেখ করেছিলেন। তিনি ঢাকার এই জলাভূমিকে শহরের পানি নিষ্কাশন, যাতায়াত ব্যবস্থা এবং চিত্তবিনোদনের প্রয়োজনে নগরের ভূমি বিন্যাসে সম্পৃক্ত করার ওপর জোর দিয়েছিলেন। কিন্তু ওয়াসাসহ সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো উদাসীনতার কারণে আজ ঢাকা বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। এখান থেকে উত্তরণ ঘটাতে অনেক কাজ করতে হবে। সমন্বিত উদ্যোগ নিয়ে কাজ করতে হবে। তা না হলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ঢাকা বসবাসের উপযুক্ততা হারাবে। বাপা জানিয়েছে, এক্যুফার অঞ্চল থেকে পানি ওঠানোর মতো গর্হিত অপরাধমূলক কাজ থেকে ওয়াসা সরে যায়নি। উন্মুক্ত স্থান ও খেলার মাঠ ধীরে ধীরে ওয়াসার বিশাল কর্মযজ্ঞে পরিণত হয়েছে। লালনের ভাষায় ‘লালন মরলো জল পিপাসায়, কাছে থাকতে নদী মেঘনা’ আমাদের চারপাশে নদী থাকায় নদী থেকে পানি নিয়ে বিভিন্ন প্রকল্পের নামে অসহায় জনগণকে প্রতারিত করা হয়েছে। বড় বড় প্রকল্পের মাধ্যমে সরকারের বড় অঙ্কের টাকা ওয়াসার কতিপয় প্রকৌশলীর পকেটে গেছে। তাছাড়া ওয়াসার ও জনগণের কোন কল্যাণ হয়নি। পরস্পর দোষারোপের প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে প্রতিবছর যারা দায় এড়িয়ে গেছেন তাদের কাউকেই আজ পর্যন্ত সরকারীভাবে বা আইনগত কোনভাবেই কোন জবাবদিহিতারও আওতায় আনা হয়নি, শাস্তি তো অনেক দূরের বিষয়। বরং খাবার পানি এবং জলজট বিষয়ে যতবার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মুখোমুখি হওয়া গেছে বিষয়গুলো তাচ্ছিল্লের সঙ্গে উড়িয়ে দিয়েছেন এমডি। অপমান করেছেন অথবা মিথ্যা আশ্বাসের মাধ্যমে জনগণকে প্রতারিত করেছেন। সরকারকে ভুল পথনির্দেশনা দিয়েছেন। নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব জনকণ্ঠকে বলেন, মূলত জলাবদ্ধতা নিরসনের বেশ কয়েকটা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য এবং কার্যকর পদক্ষেপ চিহ্নিত করা সম্ভব। প্রথমত আশু এবং অতি অবশ্যই একটি সার্বিকতা নির্ভর সমন্বিত কর্মধারা। একটি কর্মকৌশল তৈরি করতে হবে। এই পরিকল্পনাটি সার্বিকতা নির্ভর হতে হবে এই জন্যে যে বৃষ্টির পানি আকাশ থেকে রহমতের বৃষ্টি হয়ে নামছে তার যে অংশটুকু মাটির নিচে এক্যুফার সমৃদ্ধ করবে সেটিকে নিশ্চয়তা দেয়া বা নিশ্চিত করার কর্মসূচী বা পরিকল্পনাও থাকতে হবে। একই সঙ্গে এই অত্যন্ত বিশুদ্ধ পানির সূত্রটি আমাদের সুপেয় পানির গুরুত্বপূর্ণ আধার হতে পারে। যার উদাহরণ আমাদের পার্শ্ববর্তী ভারতের মুম্বাইতে বিদ্যমান। ফলে আমাদের প্রায় ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানের ৩৪০০ থেকে ৩৫০০ একর যে বারিপাত ধারণ অঞ্চল রাখার কথা রয়েছে, যার জন্যে জমি অধিগ্রহণও করা হয়েছে অথবা অধিগ্রহণের জন্য চিহ্নিত রয়েছে। সেই জমিগুলোকে উক্ত বারিপাত অঞ্চল হিসেবে সুনির্দিষ্টকরণ করতে হবে। একই সঙ্গে ১৬০ থেকে ১৮০ কিলোমিটার চিহ্নিত খালগুলো রয়েছে তা উদ্ধারের মাধ্যমে সেগুলোও বারিপাত ধারণ অঞ্চলে পরিণত করতে হবে। ইকবাল হাবিব ওয়াসার কার্যক্রম নিয়ে সমন্বিত কর্মধারা প্রয়োজন বলে ৫টি সুপারিশ করেছেন। সারফেস ওয়াটার প্রিমেন্ট বা সারফেস ওয়াটার সমন্বয় থাকতে হবে। সারফেস ড্রেনেজ এবং তার সঙ্গে ইমিডিয়েট আন্ডারগ্রাউন্ড সাইট ওয়াক বা সাইট ওয়াকের নিচের ড্রেনেজ এই অংশটুকুর এই মুহূর্তে তৈরি করা থেকে শুরু করে তার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনকে দিতে হবে। আবার আন্ডারগ্রাউন্ড টোটাল ভুগর্ভস্থ স্ট্রং ড্রেনেজ সিস্টেমের দায়িত্ব রয়েছে ওয়াসার। দ্বিতীয়ত : অবশ্যই এই পরিকল্পনার যে কার্যক্রম তার বাস্তবায়ন এবং বাস্তবায়ন পরবর্তী তত্ত্বাবধান একটি সমন্বিত ব্যবস্থাপনার অধীনে হতে হবে। আর এই ব্যবস্থাপনা আপাতদৃষ্টিতে যাই মনে হোক না কেন, জনপ্রতিনিধিত্বশীল সংগঠনের মাধ্যমেই কেবল সুনিশ্চিত করতে হবে। তৃতীয়ত : পুরোপুরিভাবে জনসম্পৃক্ততা করার জন্য এটি যেমন করে প্রয়োজন তেমনি করে এই নির্বাচিত সংগঠনের পক্ষেই অন্যান্য সকল সংগঠনকে সমন্বিত করে কাজ করাও সম্ভব। কারণ তাদের কর্তৃত্বেই জনপ্রতিনিধি থাকা মানেই জনগণ সেই কর্তৃত্বে রয়েছে। এই জন সম্পৃক্ততার প্রাক শর্ত হচ্ছে বা পূর্বশর্তই হচ্ছে এই দ্বিতীয় কাজটি করা। এবং সে কারণেই এক্ষেত্রে দ্বিতীয় কর্মধারায় কার্যকর করার ক্ষেত্রে সিটি কর্পোরেশনকে আমরা বেছে নিয়েছি কেননা এটি এই নগরীর একমাত্র স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা এবং সরাসরি ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধির দ্বারা পরিচালিত। তৃতীয়টির আগেই বলা হলো জনসম্পৃক্ত আচরণ অংশগ্রহণ এবং সচেতনতা নিশ্চিত করতে হবে। চতুর্থত : অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই ব্যবস্থাপনা, পরিকল্পনা এবং তার কার্যকর নিয়ন্ত্রণ, কঠিন ও তরল বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে সংযুক্ত না করলে নিশ্চিত করা যাবে না। তার মানে নগরী জুড়ে তরল ও কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার যে দায়িত্ব যার কাছেই থাকুক না কেন, যদিও এর সিংহভাগই সিটি কর্পোরেশনের সেক্ষেত্রেও এই পরিকল্পনার সঙ্গে সিটি কর্পোরেশনের যুক্ততা, সম্পূরকতা নিশ্চিত করতে হবে। সব শেষে আমাদের বর্তমান যে হতাশাজনক অবস্থা, এই দুর্দশাগ্রস্ত বিপজ্জনক অবস্থার মধ্য থেকে নগরবাসীকে রক্ষা করতে হবে। পঞ্চমত : জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয় বা হচ্ছে সেগুলোকেও অবিলম্বে সমন্বয় কমিটি বা টাস্কফোর্সের মাধ্যমে নিরসন করা, জবাবদিহিতার মাধ্যমে জনগণকে জানানোর পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে। এই পাঁচটি বিষয়ের সমাধান হলে নগরবাসীর কোন দুর্ভোগ পোহাতে হবে না। দুর্ভাগ্য বহুবার এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও কার্যত কোনটাই বাস্তবায়ন হয়নি।
×