ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

১৭৩টি নিয়ে কাজ চলছে

করোনা ভ্যাকসিনের আশায় বিশ্ববাসী

প্রকাশিত: ২২:৩৮, ৬ আগস্ট ২০২০

করোনা ভ্যাকসিনের আশায় বিশ্ববাসী

রশিদ মামুন ॥ বিশ্বজুড়েই সবচেয়ে আলোচিত বিষয় কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন। পৃথিবী জুড়েই মানুষ আশায় দিন গুনছেন কবে আসবে এই ভ্যাকসিন। করোনা মুক্তির কাক্সিক্ষত ভ্যাকসিন নিয়ে একদিকে রয়েছে আশার খবর অন্যদিকে রয়েছে নিরাশাও। ভ্যাকসিন উৎপাদনকারীরা প্রতিদিনই কোন না কোনভাবে আশা দিয়ে যাচ্ছেন। অন্যদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এখনও পর্যন্ত ভ্যাকসিন আবিষ্কার নিয়ে কোন আশার খবর দেয়নি। উল্টো মানুষ বিভ্রান্ত হয় হতাশায় ডুবে যায় এমন বক্তব্য দিচ্ছে। উৎপদানকারী এবং ডব্লিউএইচও এর বিপরীতমুখী বক্তব্যে আশা নিরাশার দোলায় দুলছে ভ্যাকসিন ভবিষ্যত। করোনাতে মৃত্যুর সংখ্যা সাত লাখ অতিক্রম করেছে। গত শতাব্দীর প্রথমভাগে পৃথিবী এমন মহামারী দেখলেও দেখেনি বিংশ শতাব্দীতে। প্রতিদিনই করোনা আক্রান্তের সংখ্যা যেমন বাড়ছে ঠিক তেমনি মৃত্যুর তালিকা লম্বা হচ্ছে। মহামারী প্রতিরোধের একমাত্র উপায় সঙ্গনিরোধ। কিন্তু অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে কাজে নামা ছাড়া মানুষের কোন বিকল্প নেই। সঙ্গত কারণে এখন করোনা প্রতিরোধের একমাত্র সম্ভাব্য উপায় হচ্ছে ভ্যাকসিন। ভ্যাকসিনের আশা ॥ নিউইয়ার্ক টাইমস বলছে বিশ্বজুড়ে ১৭৩টি ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ চলছে। এদের সবাই দাবি করছে তারা করোনার ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেছে। এরমধ্যে একটি ভ্যাকসিন সফল হলেই মানব সভ্যতা রক্ষায় ইতিহাস বদলে যেতে পারে। এর মধ্যে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে ইতোমধ্যে একটি ভ্যাকসিন মানুষের শরীরে প্রয়োগের অনুমোদন দিয়েছে চীন। তবে চীনের এই অনুমোদন খুব একটা গ্রহণযোগ্য হয়নি বিশ্ববাসীর কাছে। চীনের সিনোভ্যাক নামের এই ভ্যাকসিনটি নিজেদের দেশে সেনা সদস্যদের প্রয়োগের অনুমোদন দিলেও আবার তৃতীয় ধাপের ট্রায়েল চালানোর জন্য বিভিন্ন দেশে তারা প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। একদিকে অনুমোদন এবং অন্যদিকে ট্রায়েলের চেষ্টা করার বিষয়টি মানুষকে দ্বিধায় ফেলেছে। তবে ব্রিটেনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যাকসিনটি এরমধ্যে সব থেকে আশার আলো দেখাচ্ছে। সারা গিলবার্টের দল ভ্যাকসিন আবিষ্কারের বিভিন্ন পর্যায়ের খবর প্রকাশ করেছে। এতে করে সাধারণ মানুষ প্রতিটি পর্যায়ের সবশেষ অবস্থা নিজে চেষ্টা করলেই জানতে পারছেন। এর বাইরে ভ্যাকসিন দৌড়ে এগিয়ে থাকা আমেরিকা, রাশিয়া এবং জার্মানি ভ্যাকসিনের কোন ট্রায়েলের খবর আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেনি। সংবাদমাধ্যম বিভিন্ন সূত্র ব্যবহার করে ভ্যাকসিনগুলো সফল হওয়ার খবর দিয়েছে। তবে এরমধ্যেও আশার খবর হচ্ছে এক এক করে তৃতীয় ধাপের ট্রায়েলে উঠে এসেছে ছয়টি ভ্যাকসিন। তৃতীয় ধাপের ট্রায়েলকে বলা হয় সব শেষ ধাপ। এই ধাপে ভ্যাকসিনের কার্যকরিতা পরীক্ষার জন্য বিপুলসংখ্যক মানুষের শরীরে প্রয়োগ করা হয়। প্রয়োগের পর এসব মানুষকে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। এই ধাপের ফল সন্তোষজনক হলেই ভ্যাকসিনটির অনুমোদন দেয়া হয়। এছাড়াও ভ্যাকসিনের প্রথম ধাপের ট্রায়েল শেষ করেছে ১৮টি ভ্যাকসিন আর দ্বিতীয় ধাপের ট্রায়েল শেষ করেছে আরও ১২টি ভ্যাকসিন। প্রিক্লিনিক্যাল পর্যায়ে মানুষের শরীরে প্রয়োগের আগে প্রাণীর দেহে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়। এরপর সফল হলেই ভ্যাকসিনের ডোজ এবং কার্যকরিতা পরীক্ষার জন্য প্রথম ধাপের ট্রায়েল চালানো হয়। প্রথম ধাপ সফল হলে ভ্যাকসিনটি কয়েকশ’ মানুষের ওপর প্রয়োগ করে কার্যকরিতা এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা হয়। এই দুই ধাপ অতিক্রম করেছে ৩০টি ভ্যাকসিন। গবেষণার জন্য যা মানুষের শরীরে প্রয়োগ করা হয়েছে। এখনও এসব ভ্যাকসিনে মানুষের বড় রকমের কোন ক্ষতি হয়েছে এমন খবর প্রকাশিত হয়নি। অর্থাৎ ভ্যাকসিনগুলো মানুষের জন্য নিরাপদ বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। এখন এগুলোর দীর্ঘমেয়াদী কার্যকারিতা পরীক্ষার কাজ চলছে। ভ্যাকসিন নিয়ে বিবিসি এবং সিএনএন গত কয়েকদিন ধরে যে খবর প্রকাশ করেছে তাতে বলা হয়েছে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনের উৎপাদনকারী এবং বাজারজাতকারী বিশ্বখ্যাত ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এ্যাস্ট্রেজেনেকা ভ্যাকসিনের মোড়ক উৎপাদনের জন্য ভারতের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করেছে। এর আগে ভারতের পুনের অন্য আরেকটি ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এ্যাস্ট্রেজেনেকা ভ্যাকসিন উৎপাদনের চুক্তি করে। এছাড়াও আমেরিকা এবং ইউরোপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ছাড়াও বিল গেটস এবং মেলিন্দা গেটস এর দাতব্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ভ্যাকসিন বিক্রির চুক্তি করেছে এ্যাস্ট্রেজেনেকা। কোম্পানিটি বলছে আগামী সেপ্টেম্বরে তাদের তৃতীয় ধাপের ট্রায়েল শেষ হবে। আর ট্রায়েলের খবর হাতে আসার সঙ্গে সঙ্গে যাতে মানুষের কাছে ভ্যাকসিন পৌঁছে দেয়া যায় এজন্য ভ্যাকসিনের উৎপাদনও শুরু করেছে এ্যাস্ট্রেজেনেকা। অন্যদিকে রাশিয়া আগামী অক্টোবর থেকে তাদের নাগরিকদের গণহারে ভ্যাকসিন প্রয়োগের অনুমোদন দিয়েছে। একইসঙ্গে তারা ভ্যাকসিন আবিষ্কারের দাবিও করেছে। সঙ্গত কারণে ধরে নেয়া হচ্ছে তাদেরও ভ্যাকসিন প্রয়োগের সক্ষমতা তৈরি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের মর্ডানা এবং যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি কোম্পানি ফাইজার এবং জামার্নির বায়োএনটেক যে দুটি ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেছে আগামী অক্টোবর থেকে তার তৃতীয় ধাপের ট্রায়েল শুরুর ঘোষণা দিয়েছে তারা। মর্ডানার কাছ থেকে ভ্যাকসিন ক্রয়ের চুক্তি করেছে ইসরাইল। অন্যদিকে ফাইজার এবং বায়োএনটেক এরসঙ্গে করোনার ভ্যাকসিন ক্রয়ের চুক্তি করেছে জাপান। এছাড়াও এ্যাস্ট্রেজেনাকার সঙ্গেও জাপান পৃথক চুক্তি করেছে। ভারতও এ্যাস্ট্রেজেনেকার টিকার ট্রায়েল নিজেদের দেশে শুরু করেছে। ভ্যাকসিনের দর ॥ বিশ্বব্যাপী এখন আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে কত হবে ভ্যাকসিনের দর। ইতোমধ্যে ভ্যাকসিনের দর দামের পূর্বাভাস দিয়েছে উৎপাদনকারীরা। রয়টার্সের এক খবরে বলা হচ্ছে জাপানের সঙ্গে ফাইজার এবং বায়োএনটেক এর সঙ্গে যে চুক্তি করেছে তার দর কোন পক্ষই প্রকাশ করেনি। তবে কোন কোন সূত্র জানিয়েছে দুই ডোজের একটি টিকার দাম পড়বে ৩৯ ডলার। তবে সব থেকে সস্তায় করোনার টিকা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। এ্যাস্ট্রেজেনেকার তরফ থেকে বলা হয়েছে প্রতিটি ভ্যাকসিনের দাম হবে তিন থেকে চার ডলার। অন্যদিকে সিএনএন এর খবরে বলা হয়েছে মার্ডানা তাদের সম্ভাব্য ভ্যাকসিনের দাম রাখবে ৪০ থেকে ৫০ ডলারের মধ্যে। তবে তা শুধুমাত্র মার্কিন নাগরিকদের জন্য। তবে তৃতীয় বিশ্বের যেসব দেশের মাথাপিছু বার্ষিক আয় দুই হাজার ডলারের বেশি নয় তারা ফ্রিতেই এই টিকা পেয়ে যাবে। বাংলাদেশও এই তালিকায় রয়েছে। তবে এখনও অন্য কোন দেশ ভ্যাকসিনের দর সম্পর্কে তেমন কোন কিছু প্রকাশ করেনি। ডব্লিউএইচও এর হতাশা ॥ ডব্লিউএইচও’র প্রধান টেড্রোস আধানম গ্রেব্রিয়েসিস বলেছেন করোনার কোন জাদুকরী সমাধান আপাতত নেই, কোনদিন মিলতেও না পারে। সঙ্গত কারণে করোনাকে সঙ্গে নিয়ে বাঁচার পথ খুঁজতে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। ডব্লিউএইচও’র প্রধানের এই বক্তব্যের পর ভ্যাকসিনের ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। ডব্লিউএইচও এর জরুরী সেবা বিভাগের প্রধান মাইক রায়ানও সম্প্রতি বলেছেন কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন চলতি বছর মিলবে না। তবে কেন তিনি এই কথা বলেছেন তার কোন ব্যাখ্যা দেননি। যদিও স্বাভাবিকভাবে একটি ভ্যাকসিন মানুষের জন্য কতটা কার্যকর তা নির্ধারণের জন্য চারটি ধাপের পরীক্ষার প্রয়োজন হয়। এর এসব পরীক্ষা শেষ হতে সময় লাগে দেড় বছরের মতো। গত জানুয়ারি থেকে ভ্যাকসিন আবিষ্কারের উদ্যোগ নিলেও তা শেষ হওয়ার কথা আগামী জুনে। তবে বিজ্ঞানীরা মানুষের জীবন রক্ষা করার জন্য বিভিন্ন ধাপের ট্রায়েলের সময় এগিয়ে আনা হচ্ছে। এতে করে বছরের শেষ নাগাদ করোনার টিকা মেলার আশা করছেন বিজ্ঞানীরা। বাংলাদেশের অবস্থান কোথায় ॥ দেশে অনেকদিন ধরে চীনা ভ্যাকসিনের ট্রায়েল নিয়ে আলোচনা চলছে। পৃথিবীর অন্যদেশগুলো করোনা সংক্রান্ত বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সময়ক্ষেপণ করছে না। সেখানে উল্টো চিত্র আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের। ভ্যাকসিনের ট্রায়েলের বিষয়ে আইসিডিডিআর,বি বাংলাদেশ মেডিক্যাল রিসার্স কাউন্সিলের (বিএমআরসি) কাছে অনুমোদন চায়। এরপর বিএমআরসি অনুমোদন দিলে বেকে বসে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। প্রথমে স্বাস্থ্য সচিব আব্দুল মান্নান পরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকও একই সুরে কথা বলেন। ফলে ট্রায়েল শুরুর বিষয়ে শুরুতেই সময় নষ্ট করে মন্ত্রণালয়। যুক্তি হিসেবে তারা বলছেন ট্রায়েল দুটি দেশের আন্তঃরাষ্ট্রীয় বিষয়। ফলে এখানে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে। পরে আইসিডিডিআর,বি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আবেদন করলে এখন স্বাস্থ্য সচিব বলছেন পরীক্ষায় এই টিকা নিরাপদ বলে প্রমাণিত হলেই এর ট্রায়েল শুরু হবে। তবে কিভাবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এই টিকা নিরাপদ তা প্রমাণ করবে সে বিষয়ে কিছু বলেননি তিনি। অন্যদিকে তিনি বলেছেন অন্যান্য ভ্যাকসিন উৎপাদনকারীদের সঙ্গেও আলোচনা চলছে। তবে এর বিস্তারিত কিছুই প্রকাশ করা হয়নি। করোনা নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের যে লেজে গোবরে অবস্থা তাতে ভ্যাকসিন প্রয়োগে তারা কি করবেন তা নিয়ে দুশ্চিন্তা তো থেকেই যাচ্ছে।
×