ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

৩ বাংলাদেশীসহ নিহত ১০০ রাষ্ট্রীয় শোক দুই সপ্তাহের জরুরী অবস্থা ঘোষণা রফিক হারিরি হত্যাকান্ডে জাতিসংঘ ট্রাইব্যুনালের রায়ের তিনদিন আগে ঘটল বিস্ফোরণটি

ধ্বংসস্তূপ বৈরুত ॥ ভূমিকম্পের মতো কাঁপল পুরো নগরী

প্রকাশিত: ২২:৩০, ৬ আগস্ট ২০২০

ধ্বংসস্তূপ বৈরুত ॥ ভূমিকম্পের মতো কাঁপল পুরো নগরী

জনকণ্ঠ ডেস্ক ॥ লেবাননের রাজধানী বৈরুতে বিস্ফোরক দ্রব্যের গুদামে ভয়াবহ বিস্ফোরণে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১০০ জনে পৌঁছেছে। আহত হয়েছে চার হাজারের বেশি মানুষ। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বহু ভবন। মঙ্গলবার বিকেলে বৈরুতের বন্দর এলাকার ওই বিস্ফোরণে পুরো বৈরুত শহর ভূমিকম্পের মতো কেঁপে ওঠে বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। লেবাননের কর্মকর্তারা বলছেন, বিস্ফোরণস্থলের ধ্বংসস্তূপ সরাতে এখনও কাজ করছেন উদ্ধারকর্মীরা। ফলে হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এদিকে গভীর রাতে বাসস জানায়, নিহত বাংলাদেশীর সংখ্যা বেড়ে ৪ জন হয়েছে। এর আগে বৈরুতে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় ৩ জন বাংলাদেশী নিহত এবং ৭৮ জন আহত হওয়ার খবর দিয়েছে বাংলাদেশ মিশন। খবর বিবিসি, স্কাইনিউজ, সিএনএন, রয়টার্স, আলজাজিরা ও গার্ডিয়ানের। অর্থনৈতিক সঙ্কট আর করোনাভাইরাস মহামারীর সঙ্গে লড়তে থাকা বৈরুতে বহু বছরের মধ্যে বিস্ফোরণে হতাহতের সবচেয়ে বড় ঘটনা এটি। লেবাননের সাবেক প্রধানমন্ত্রী রফিক হারিরি হত্যাকাণ্ড নিয়ে জাতিসংঘ ট্রাইব্যুনালের রায়ের তিনদিন আগে ওই বিস্ফোরণের কারণ শুরুতে স্পষ্ট ছিল না। তবে পরে দেশটির কর্মকর্তারা বিস্ফোরকের গুদামে বিস্ফোরণের ঘটনা বলে জানান। দেশটির প্রেসিডেন্ট মিশেল আউন এক টুইটে বলেছেন, কোন ধরনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করে ২ হাজার ৭৫০ টন এ্যামোনিয়াম নাইট্রেট বন্দরে মজুদ করে রাখা হয়েছিল, যা কোনভাবেই ‘গ্রহণযোগ্য নয়’। একইসঙ্গে তিনদিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছেন তিনি। পাশাপাশি জরুরী তহবিল হিসেবে তার সরকার ১০০ বিলিয়ন লিরা (৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার) সহায়তা দেবে ক্ষতিগ্রস্তদের। সারি সারি মরদেহ ॥ চারদিকে সারি সারি মরদেহ। দিশেহারা রক্তাক্ত মানুষ। হাসপাতালে জায়গা হচ্ছে না আহতদের। বিলাসবহুল হোটেল, আবাসিক ভবন সবকিছু পরিণত হয়েছে অচেনা ধ্বংসস্তূপে। আহতদের চিৎকার আর নিখোঁজের স্বজনদের দীর্ঘশ্বাসে ভারি হয়ে উঠছে আকাশ। মঙ্গলবারের জোড়া বিস্ফোরণের এই ধ্বংসলীলার মধ্যে তিনদিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে লেবাননের সরকার। বিস্ফোরণের পরপরই বৈরুত যেন এক ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। এদিক সেদিক পড়ে আছে ভাঙ্গা কাঁচ। ভবনগুলো আগুনে পুড়ে গেছে। বিস্ফোরণের মূল এলাকা থেকে ৪ কিলোমিটার দূরে থাকা ভবনগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। লেবাননে চরম গৃহযুদ্ধ চলার সময়ও এতটা ধ্বংসযজ্ঞ দেখা যায়নি। চিকিৎসা নিতে আশপাশের হাসপাতালগুলোতে নেয়া হয়েছে কয়েক হাজার আহতকে। বিস্ফোরণে হাসপাতালগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এমন অবস্থায় চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছে তারা। বিস্ফোরণস্থলের দুই কিলোমিটারেরও কম দূরত্বে অবস্থিত সেন্ট জর্জ হাসপাতাল। সেখানকার এক চিকিৎসক বলেন, ‘আহতদের হাসপাতালে নিয়ে আসছে মানুষ, তবে আমরা তাদের ভর্তি করাতে পারছি না। তাদের রাস্তার ওপরে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। হাসপাতাল ভবন ভেঙ্গে গেছে। ধ্বংস হয়ে গেছে জরুরী বিভাগ।’ লেবাননের রেডক্রসের প্রধান জর্জেস কেট্টানেহ বলেন, ‘আমরা যা দেখছি তা বড় ধরনের এক বিপর্যয়। চারদিকে হতাহতদের দেখা যাচ্ছে।’ আহতদের বাঁচাতে মানুষের কাছে জরুরী ভিত্তিতে রক্তদানের আহ্বান জানিয়েছে রেডক্রস। স্বাস্থ্যমন্ত্রী হামাদ হাসান বলেন, ‘অনেক মানুষ নিখোঁজ রয়েছে। জরুরী বিভাগের কর্মীদের কাছে এসে লোকজন তাদের প্রিয়জনের সন্ধান চাইছে। রাতে অনুসন্ধান অভিযান চালানো কঠিন। কারণ সেখানে বিদ্যুত নেই।’ দুই সপ্তাহের জরুরী অবস্থা জারি ॥ ভয়াবহ বিস্ফোরণের পর শহরটিতে দুই সপ্তাহের জন্য জরুরী অবস্থা ঘোষণা করেছেন প্রেসিডেন্ট মিশেল আউন। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বৈরুত বন্দরে একটি বিস্ফোরক দ্রব্যের গুদামে বিস্ফোরণ ঘটে। দেশটির শীর্ষ প্রতিরক্ষা পরিষদ বৈরুতকে দুর্যোগকবলিত শহর বলে ঘোষণা করেছে। বিস্ফোরণের পর দেশটির সর্বোচ্চ প্রতিরক্ষা পরিষদ প্রেসিডেন্ট মিশেল আউনের নেতৃত্বে জরুরী বৈঠকে বসে। বৈঠক শেষে এক বিবৃতির মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট রাষ্ট্রীয় জরুরী অবস্থা ঘোষণা করেন। সর্বোচ্চ প্রতিরক্ষা পরিষদ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। এ কমিটি আগামী পাঁচদিনের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট পেশ করবে। তদন্তে যারা দোষী প্রমাণ হবেন তাদের কঠোর শাস্তির সুপারিশ করা হয়েছে। গৃহহীন দুই লাখেরও বেশি মানুষ ॥ বৈরুতে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় দুই লাখের বেশি মানুষ গৃহহীন হয়েছে পড়েছেন। এসব গৃহহীনদের থাকার জায়গার পাশাপাশি খাবার সরবরাহ করছে বৈরুত গবর্নর। দেশটির রাষ্ট্রপতি মিশেল আউন মন্ত্রিসভার এক জরুরী বৈঠকে সবাইকে সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছেন। বৈরুতের গবর্নর মারওয়ান আব্বৌদ বলেন, দুই থেকে আড়াই লাখ মানুষ বাড়িঘর হারিয়েছেন। তাদের খাদ্য ও আশ্রয় দেয়ার কাজ করছে কর্তৃপক্ষ। জাতীয় ঐক্যের ডাক হিজবুল্লাহর ॥ লেবাননের সশস্ত্র ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন হিজবুল্লাহ জাতীয় দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। মঙ্গলবারের বিস্ফোরণের পর সংগঠনটির পক্ষ থেকে জাতীয় ঐক্যের ডাক দেয়া হয়। এই ঘটনাকে ‘মর্মান্তিক বিপর্যয়’ আখ্যা দিয়ে হিজবুল্লাহর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এমন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হয়েই এই পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হবে। এছাড়া বৈরুত বিস্ফোরণের নিন্দা জানিয়েছে সংগঠনটি। মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় যা বলেছে ॥ বৈরুতে ভয়াবহ বিস্ফোরণের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে একমত নয় মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অন্তত তিন কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন, বিস্ফোরণটি হামলার কারণে ঘটেছে এখনও এ ধরনের কোন লক্ষণ বা প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এর আগে, মঙ্গলবার রাতে বিস্ফোরণের পর হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের সামনে এ ঘটনাকে ভয়ঙ্কর হামলা বলে মন্তব্য করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। এ সময় তিনি লেবাননের জনগণের প্রতি সহানুভূতি এবং প্রয়োজনে সহযোগিতার কথা উল্লেখ করেন। নিছকই দুর্ঘটনা নাকি দুষ্কর্ম ॥ জাতিসংঘের মুখপাত্র ফারহান হক বলেছেন, বৈরুতের বিস্ফোরণের কারণ তাৎক্ষণিকভাবে পরিষ্কার হওয়া যায়নি। তিনি বলেন, আমরা জানি না আসলে সেখানে কি কারণে বিস্ফোরণ ঘটেছে। এটা নিছকই দুর্ঘটনা নাকি কারও দুষ্কর্ম তা পরিষ্কার নয়। বিস্ফোরণের নেপথ্যে ॥ লেবানন বলছে, কোন নাশকতা নয়, বৈরুতের বিস্ফোরণ একটি দুর্ঘটনা। গুদামে মজুত থাকা রাসায়নিক পদার্থ ‘এ্যামোনিয়াম নাইট্রেট’ থেকেই বিস্ফোরণ ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে দাবি করেছে তারা। লেবাননের প্রধানমন্ত্রী হাসান দিয়াব বলেছেন, বৈরুত বন্দরের একটি গুদামে বিপুল পরিমাণ এ্যামোনিয়াম নাইট্রেট মজুত ছিল। সেখান থেকেই দুর্ঘটনা হয়েছে। দেশটির সাধারণ নিরাপত্তা বিষয়ক পরিচালক মেজর জেনারেল আব্বাস ইব্রাহিম জানিয়েছেন, বিস্ফোরণের সম্ভাব্য উৎস ছিল বন্দরের একটি ডিপো, যেখানে বিস্ফোরক পদার্থের মজুত ছিল। গত ছয় বছর ধরে ওই গুদামে দুই হাজার ৭৫০ ম্যাট্রিক টন এ্যামোনিয়াম নাইট্রেট মজুত করে রাখা হয়েছিল। ২০১৪ সালে একটি মালবাহী জাহাজে করে ওই রাসায়নিক এসেছিল। কাগজপত্রে ঝামেলা থাকায় বন্দর কর্তৃপক্ষ জাহাজের সরঞ্জাম বাজেয়াফত করে। তারপরই ওই রাসায়নিক গুদামে মজুত রাখা হয়। কথা ছিল, পরে নিলামের মাধ্যমে ওই রাসায়নিক বাজারে ছেড়ে দেয়া হবে। তবে গত ছয় বছরে সে কাজ করা যায়নি। শুধু তাই নয়, এই পরিমাণ রাসায়নিক যেখানে মজুত ছিল, সেখানে যথেষ্ট নিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল না। উল্লেখ্য, এ্যামোনিয়াম নাইট্রেট জমিতে সারের কাজে লাগে। খনিতে কাজে লাগে। আবার বোমা তৈরিতেও ব্যবহার করা হয়। সহজেই এর থেকে বিস্ফোরণ হতে পারে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
×