ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০১ জুলাই ২০২৫, ১৭ আষাঢ় ১৪৩২

পরিকল্পনা প্রস্তাবনায় কেটে গেল ২১ বছর!

নিজস্ব সংবাদদাতা, কলাপাড়া, পটুয়াখালী

প্রকাশিত: ০৭:৫২, ১ জুলাই ২০২৫

পরিকল্পনা প্রস্তাবনায় কেটে গেল ২১ বছর!

ছবি: জনকণ্ঠ

বেশ সময় ধরে সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের লাগাতার তাণ্ডবে কুয়াকাটা সৈকতের দীর্ঘ এলাকা লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। ট্যুরিজম পার্ক থেকে নির্মাণাধীন সড়ক, জাতীয় উদ্যানসহ শত শত গাছপালা সব যেন তছনছ হয়ে গেছে। চরম ঝুঁকিতে আছে ট্যুরিজম পার্ক, মসজিদ-মন্দিরসহ বেড়িবাঁধের বাইরের সাগর-লাগোয়া বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা।

এমনিতেই গত ২৪ বছরে গোটা সৈকতের দীর্ঘ এলাকার ম্যানগ্রোভ-ননম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের ৭৫ শতাংশ সাগরে বিলীন হয়ে গেছে। ২০০ একর আয়তনের নারকেল বাগান তো ৯৯ শতাংশ সাগরের পেটে চলে গেছে। সাগর গিলে খাচ্ছে একে একে সব সৌন্দর্য-মণ্ডিত স্পট। এখন জোয়ারের সময় সৈকতে নেই ওয়াকিং জোন। বলতে গেলে গোটা সৈকত অরক্ষিত হয়ে পড়েছে।

তারপরও ভাঙনের কবল থেকে কুয়াকাটা সৈকত রক্ষায় স্থায়ী প্রতিরক্ষা প্রকল্পের বাস্তবায়ন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

ভাঙনরোধে স্থায়ী প্রতিরক্ষায় প্রায় দুই যুগ ধরে সৈকত এলাকার সমীক্ষা শেষে সম্ভাব্যতা যাচাইসহ শুধু প্রকল্প প্রণয়ন ও প্রস্তাবনার কাজ চলছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ বহুবার ডিপিপি তৈরি করে প্রস্তাবনা আকারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। ২০০৩ সাল থেকে এসব খবর গণমাধ্যমে জানানো হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে প্রকল্পটি এখন পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি।

শুধুমাত্র প্রতি বছর জরুরি প্রটেকশনের নামে সৈকতের শূন্য পয়েন্টের দুইদিকে তিন-সাড়ে তিনশ’ মিটার এলাকায় জিও টিউব ও জিও ব্যাগ স্থাপনের মধ্য দিয়ে কোটি কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে। যা নিয়ে পর্যটকদের ক্ষোভ রয়েছে। হচ্ছে তাদের ভোগান্তি। ক্ষোভ রয়েছে কুয়াকাটার স্থানীয় ব্যবসায়ীসহ বিনিয়োগকারীদের।

সবশেষ, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ২০২৩ সালে ‘কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত রক্ষা ও উন্নয়ন’ নামের একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড। দীর্ঘ ১৮ কিলোমিটার সৈকতের ভাঙনপ্রবণ প্রায় ১২ কিলোমিটার এলাকা রক্ষায় এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এজন্য ৭৫৯ কোটি ৫৬ লাখ ৭৯ হাজার টাকা প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে।

সমুদ্রতীর প্রতিরক্ষা কাজের জন্য ৬৮টি গ্রোয়েন নির্মাণ, ট্যুরিজম পার্ক, মসজিদ-মন্দির এলাকার প্রতিরক্ষায় ৬০০ মিটার এলাকায় কাজ করা। এছাড়া ২ কিলোমিটার ৭০০ মিটার সি-বিচের স্লিপিং ডিফেন্স নির্মাণ করে প্রতিরক্ষা করা হবে।

কলাপাড়াস্থ নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয় সূত্রে আরও জানানো হয়, এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে কুয়াকাটা সৈকতের ভাঙনরোধ হবে। কিন্তু এ প্রকল্পটির আজ অবধি চূড়ান্ত অনুমোদন মেলেনি। অনুমোদন না হওয়ায় সৈকত প্রতিরক্ষায় স্থায়ী পদক্ষেপ কবে কার্যত বাস্তবায়ন হবে তা অনিশ্চয়তায় রয়েছে।

আর সৈকত রক্ষায় স্থায়ী প্রতিরক্ষা প্রকল্প বাস্তবায়নের কোনো পদক্ষেপ দৃশ্যমান না হওয়ায় এখানকার লগ্নিকারকসহ পর্যটকরা চরম হতাশ হয়ে পড়েছেন। শুধু পরিকল্পনায় যেন ২১ বছর কেটে যাচ্ছে।

এর আগে ২০১৮ সালে সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে ২১২ কোটি টাকার সম্ভাব্য ব্যয় নির্ধারণ করে সৈকতের শূন্য পয়েন্টের দুই দিকে পাঁচ কিলোমিটার এলাকা রক্ষায় একটি প্রকল্প হাতে নেয় পানি উন্নয়ন বোর্ড। যেখানে পরিকল্পনা ছিল গ্রীন সি ওয়াল নির্মাণের মধ্য দিয়ে শোরলাইন বরাবর স্থির থাকবে।

সৈকতের দেশভাগে গ্রীন সি ওয়ালের ওপর দিয়ে পর্যটকরা হাঁটাচলা করতে পারবেন। সি ওয়ালের ওপর ঘাস জন্মাবে। এটি হবে পরিবেশবান্ধব, হবে দৃষ্টিনন্দন। পর্যটক-দর্শনার্থীরা পারবে সি ওয়ালে বসে সৌন্দর্য অবলোকনের সুযোগ।

সি ওয়ালটি অবস্থানভেদে ২১ মিটার প্রস্থ এবং দুই-আড়াই মিটার উচ্চ হবে। গ্রীন সি ওয়ালের সামনের দিকে উত্তাল ঢেউয়ের তাণ্ডব ঠেকাতে নির্দিষ্ট এলাইনমেন্ট বরাবর সাগরের অন্তত তিন মিটার গভীর তলদেশে জিও টিউব বসানো হবে। যার ফলে পলি জমে বিচের পরিধি আরও বাড়বে। প্রশস্ত হবে।

জিও টিউবটি এমনভাবে বসানো হবে যে জোয়ারের সময় এটি পানির নিচে থাকবে, দৃশ্যমান হবে না। ফলে পর্যটকের দৃষ্টি বাধাগ্রস্ত হবে না। জিও টিউবের ওপর দিয়ে সহজেই নৌকাসহ জলযান সাগর অভ্যন্তর থেকে বেলাভূমিতে ভিড়তে পারবে।

সৈকতের ভাঙনরোধে এবং পূর্বের প্রশস্ততা ফিরে আনার জন্য এ প্রকল্প হাতে নেওয়া হলেও বাস্তবায়ন হয়নি। এভাবে কুয়াকাটা সৈকত রক্ষার স্থায়ী পদক্ষেপ নেওয়ার একের পর এক প্রকল্প পরিকল্পনা আর সমীক্ষায় থেমে যায়।

বর্তমানে সৈকতের চরম বেহাল দশা। শুধুমাত্র তিন শ’ মিটার নিয়েই জিও টিউব আর জিও ব্যাগের জরুরি প্রটেকশনের মধ্যে আটকে আছে। এসব জিও টিউব আর ব্যাগের বালু অনেকটা বের হয়ে গেছে। শ্যাওলা ধরে গেছে।

প্রতিনিয়ত পর্যটক পা পিছলে পড়ে আহত হচ্ছে। এমনকি বিবর্ণ এসব টিউব ও ব্যাগ অপসারণের দাবি করছেন পর্যটক ও স্থানীয় মানুষ। তাদের দাবি এতে সৈকত শ্রীহীন হয়ে পড়েছে।

বাণিজ্যিক ক্যামেরাম্যান সোহেল জানান, এই জিও ব্যাগ পর্যটকদের হাঁটাচলার জন্য বিপজ্জনক।

সূত্র মতে, পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৪৮ নম্বর পোল্ডারের ১৭.২৫০তম কিলোমিটার থেকে ৩৭.২৫০তম কিমি পর্যন্ত বেড়িবাঁধের বাইরের দীর্ঘ ২০ কিলোমিটার মূলত কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত এলাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

এর মধ্যে গঙ্গামতির লেকের ২৪.২৫০তম কিমি থেকে আন্ধারমানিক নদীর মোহনার ৩৪.৭৫০তম কিমি পর্যন্ত সাড়ে দশ কিলোমিটার সৈকত সর্বাধিক ব্যবহৃত হয়। যেখানে মূলত পর্যটকরা বিচরণ করেন।

এই সাড়ে দশ কিলোমিটারের মধ্যে ২৭.৪০০ কিমি থেকে ৩২.৫০০ কিমি পর্যন্ত ৫.১ কিলোমিটার সাগরের তীব্র ভাঙন এলাকা। বর্তমানে সৈকতের ঝুঁকিপূর্ণ ৫ কিলোমিটার অংশের মধ্যে আড়াই কিলোমিটার খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।

যা রক্ষায় গেল বছর জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া হয় প্রায় ২ কিমি অংশে। তখন জিও টেক্সটাইল ব্যাগ দেওয়ার পাশাপাশি জিও টিউব দেওয়া হয়। কিন্তু এখন টিউব ও ব্যাগের বেহাল দশা। ঢেউয়ের তীব্রতায় লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে।

বেলাভূমিতে চলছে তীব্র ভাঙন। পর্যটকসহ সাধারণ মানুষ ও কুয়াকাটার বিনিয়োগকারীরা জানান, গোটা সৈকত রক্ষায় সাগরের তীব্র ভাঙন রোধে স্থায়ী পদক্ষেপ না নিলে কুয়াকাটার দীর্ঘ সৈকত সাগরগর্ভে বিলীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

পাশাপাশি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধসহ বিভিন্ন ধরনের স্থাপনাও চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। বর্তমানে কুয়াকাটার লগ্নিকারকরা এ কারণেই অনেকটা হতাশাব্যক্ত করছেন।

কুয়াকাটা হোটেল-মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোতালেব শরীফ জানান, কুয়াকাটার এখন মূল সমস্যা সৈকতের স্থায়ী প্রটেকশন দেওয়ার বিষয়টি। তারপর মেরিন ড্রাইভ। এসব হচ্ছে এখানকার মূল উন্নয়ন।

সাগরের ভাঙনের ঝুঁকি থেকে সৈকতসহ গোটা কুয়াকাটার স্থাপনা-সম্পদ রক্ষায় স্থায়ী পরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি করেন তিনি।

পানি উন্নয়ন বোর্ড কলাপাড়ার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শাহ আলম জানান, সৈকত স্থায়ী রক্ষায় ‘কুয়াকাটা সৈকত রক্ষা ও উন্নয়ন’ নামের একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যা পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে আছে।

কুয়াকাটা বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির সদস্য সচিব ও কলাপাড়ার উপজেলা নির্বাহী অফিসার রবিউল ইসলাম জানান, কুয়াকাটা সৈকত রক্ষায় স্থায়ীভাবে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডকে যথাযথভাবে তাগিদ দেওয়া হয়েছে।

মুমু ২

×