ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

জঙ্গী সংশ্লিষ্টতা নেই ॥ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

পল্লবী থানায় রহস্যময় বিস্ফোরণে ৪ পুলিশসহ আহত ৫

প্রকাশিত: ২২:৩২, ৩০ জুলাই ২০২০

পল্লবী থানায় রহস্যময় বিস্ফোরণে ৪ পুলিশসহ আহত ৫

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রাজধানীর পল্লবী থানায় বোমা বিস্ফোরণে চার পুলিশসহ পাঁচ জন আহত হয়েছেন। আহত বেসামরিক ব্যক্তি রিয়াজের বাম হাতের কব্জি ও ডান হাতের একটি আঙ্গুল কেটে ফেলতে হয়েছে। অন্যথায় তার দুই হাত রক্ষা করা সম্ভব ছিল না। তাতে পচন ধরত। সারাদেশে পুলিশের তরফ থেকে জঙ্গী হামলার আশঙ্কায় বিশেষ সর্তকর্তা জারির পর পল্লবী থানায় বোমা বিস্ফোরণে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এমপি বলেছেন, পল্লবী থানায় বোমা বিস্ফোরণে আহত হওয়ার ঘটনায় জঙ্গী সংশ্লিষ্টতা নেই। যারা গ্রেফতার হয়েছে তারা ডাকাত দলের সদস্য। তাদের কাছে থাকা কিছু একটা বিস্ফোরণ হওয়ার ঘটনাটি ঘটেছে। পুলিশও বলছে, এটি কোন জঙ্গী বা পরিকল্পিত হামলা নয়। পুলিশ জানিয়েছে, পল্লবীর স্থানীয় একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিকে হত্যার গোপন ষড়যন্ত্র হচ্ছে, এমন তথ্যের ভিত্তিতে পল্লবীর একটি বাড়িতে অভিযান চালায় পল্লবী থানা পুলিশ। অভিযানে তিন জনকে দুইটি পিস্তল, চারটি তাজা বুলেট এবং ওজন মাপার ডিজিটাল মেশিনের মতো একটি বস্তুসহ গ্রেফতার করে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে গ্রেফতারকৃতদের থানা হাজতে রাখা হয়। আর জব্দ করা মালামালগুলো পুলিশ পরিদর্শক অপারেশন্সের রুমে রাখা হয়। ওজন মাপার সেই বিশেষ যন্ত্রের ভেতরে থাকা বোমার বিস্ফোরণ ঘটে। সিআইডির ফরেনসিক বিভাগ, বম্ব জিসপোজাল টিম, ডিবি পুলিশ, পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থা ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ করেছে। সে সব আলামতের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। এ ঘটনায় মামলা দায়ের হচ্ছে। এমন ঘটনার পর ওজন মাপার মেশিনের ভেতরে বা মেশিনের আদলে জঙ্গীরা পরিকল্পিতভাবে বোমা তৈরি করেছিল কি না তা নিয়ে রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। জঙ্গীরা পরিকল্পিতভাবে বোমাগুলো কোন রাজনৈতিক ব্যক্তির বাড়িতে রেখে পুলিশকে খবর দিয়েছিল কি না। এমনকি জব্দ করা সেই মালামালের মধ্যে ওজন মাপার মেশিনের মতো বিস্ফোরিত ওই জিনিসটিও কি ছিল তা জানতে তদন্ত চলছে। গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত আছে। পল্লবী থানার ডিউটি অফিসার উপপরিদর্শক (এসআই) আকলিমা আক্তার জানান, অন্যান্য দিনের মতোই পুলিশ রাতের ডিউটি করছিল। সম্প্রতি পুলিশ সদর দফতর থেকে পুলিশকে সতর্ক থাকতে বিশেষ নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। এজন্য তারা বাড়তি সতর্কতার সঙ্গে দায়িত্বও পালন করছিলেন। রাতে একজন স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিকে হত্যার গোপন পরিকল্পনার কথা জানতে পারে পল্লবী থানা পুলিশের একটি দল। মঙ্গলবার ভোর রাতে সেই বাড়িতে অভিযান চালায়। অভিযানে বাড়ি থেকে রফিক (৪০), মোশারফ (২৬) ও শহীদুল (২৩) নামের তিন জনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের কাছ থেকে দুইটি পিস্তল, চার রাউন্ড বুলেট ও একটি ওজন মাপার ডিজিটাল মেশিনের মতো জিনিসসহ নানা কিছু জব্দ করা হয়। জব্দকৃত মালামালগুলো রাতে থানার পরিদর্শক অপারেশন্স ইমরানুল ইসলামের রুমে রাখা হয়। জব্দ করা জিনিসপত্রের মধ্যে ওজন মাপার মতো সেই যন্ত্রে বোমা আছে বলে ধারণা করা হয়। এরপর দ্রুত বম্ব ডিসপোজাল টিমকে ডাকা হয়। বম্ব সংক্রান্ত কাজ করা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সকল ইউনিটকে খবর দেয়া হয়। খবর পেয়ে থানায় আসার আগেই ওজন মাপার মতো সেই যন্ত্রটির বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণ চার পুলিশসহ পাঁচ জন আহত হন। ডিএমপির মিডিয়া এ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপকমিশনার প্রকৌশলী ওয়ালিদ হোসেন জনকণ্ঠকে জানান, আসামিদের থানা হাজতে রাখা হয়। তাদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়। আর জব্দ করা মালামালগুলো পরিদর্শক অপারেশন্সের রুমে থাকে। ভোর ছয়টার দিকে আচমকা বিকট শব্দে ডিজিটাল ওজন মাপার মেশিনের মতো সেই বস্তুটি বিস্ফোরিত হয়। এতে আহত হন চার পুলিশ সদস্য এবং থানায় সেবা নিতে আসা একজন সাধারণ মানুষ। আহতদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরী বিভাগের ভর্তি করা হয়। ডিএমপির কমিশনার মোহাঃ শফিকুল ইসলাম ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। পাশাপাশি ঢাকা মহানগর পুলিশকে আরও সতর্কতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের আদেশ জারি করেছে। তবে ঘটনাটি জঙ্গী হামলা কি না তা এখনই মন্তব্য করার সময় আসেনি বলে তিনি দাবি করেন। তদন্তের পর বিষয়টি পরিষ্কার হবে। ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মোঃ মনিরুল ইসলাম বলেন, এটি কোন জঙ্গী হামলা নয়। ঘটনাটির সঙ্গে প্রাথমিক তদন্তে জঙ্গী সংশ্লিœষ্টতার কোন প্রমাণ বা তথ্য মেলেনি। তবে বিষয়টি গভীরভাবে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম) কৃষ্ণপদ রায় দুপুরে থানার সামনে এক ব্রিফিংয়ে বলেন, ওজন মাপার ডিজিটাল যন্ত্রের মতো সেই জিনিসটিতে চারটি বোমা ছিল। তার মধ্যে একটি বিস্ফোরিত হয়েছে। বাকিগুলো নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে। প্রাথমিক তদন্তে এ ঘটনার সঙ্গে জঙ্গী সংশ্লিষ্টতার কোন তথ্য প্রমাণ মেলেনি। গ্রেফতারকৃতদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা চলছে। তাদের গভীরভাবে জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত আছে। তাদের অতীত থেকে শুরু করে হালনাগাদ তথ্য জানার চেষ্টা চলছে। দেখা গেছে, ছয় তলা থানা ভবনটি ঠিক চৌরাস্তা মোড়ে অবস্থিত। সামনেই আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ইলিয়াস মোল্লার ছেলে হারুন মোল্লার নামে একটি ক্রিকেট মাঠ। মাঠ লাগোয়া থানা। থানার যে রুমে বিস্ফোরণ ঘটেছে সেই রুমের দুইটি জানালার মধ্যে একটি ভেঙ্গে নিচে রাস্তায় পড়ে আছে। আরেকটি ভেঙ্গে উপরেই ঝুলে আছে। খবর পেয়ে সকালেই ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের বম্ব ডিসপোজাল টিম ঘটনাস্থলে যায়। তারা দুইটি অবিস্ফোরিত বোমা নিষ্ক্রিয় করে। বিস্ফোরিত বোমাগুলো যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল বলে তাদের ধারণা। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া জানান, আহতদের মধ্যে এস আই অংকুশকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে চক্ষু হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে। এস আই শফিক ও পরিদর্শক অপারেশন ইমরানুল ইসলামকেও প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দিয়েছে চিকিৎসকরা। আহত পুলিশ সদস্যদের মধ্যে এসআই রুমি এবং আহত সেবাপ্রার্থী রিয়াজকে হাসপাতালে ভর্তি রাখা হয়েছে। আহতদের মধ্যে পিএসআই রুমির দুই হাত, বাম পা এবং রিয়াজ নামের ওই ব্যক্তির দুই হাত ও পেট বিস্ফোরণে আঘাতপ্রাপ্ত হয়। বিকেলে রিয়াজের ক্ষত-বিক্ষত বাম হাতের কব্জি কেটে ফেলতে হয়। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরী বিভাগের আবাসিক সার্জন (আরএস) ডাঃ মোহাম্মদ আলাউদ্দিন জানান, অন্যথায় তার হাত রক্ষা করা সম্ভব ছিল না। হাতে পচন ধরে পুরো হাতটিই এক সময় কেটে ফেলতে হতো। আর ডান হাতের একটি আঙ্গুল মারাত্মকভাবে ক্ষত-বিক্ষত হওয়ায় সেটিও কেটে ফেলতে হয়েছে। তার পেটে বড় ধরনের আঘাত রয়েছে। আহতরা বোমার স্পিøন্টারে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন। এমন ঘটনার পর থানাগুলোর নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। পরিচয় নিশ্চিত হয়ে থানায় প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে। তবে সাংবাদিকদের পল্লবী থানার ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। থানার সামনে শত শত উৎসুক মানুষ ভিড় করছেন। সেখানে পুলিশের তদন্তকারী সংস্থা পিবিআইসহ সকল ইউনিটের সদস্যরা উপস্থিত হয়েছেন। এমনকি র‌্যাবও ঘটনাস্থলে রয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এমপি বলেছেন, পল্লবী থানায় বোমা বিস্ফোরণে আহত হওয়ার ঘটনায় জঙ্গী সংশ্লিষ্টতা নেই। যারা গ্রেফতার হয়েছে তারা ডাকাত দলের সদস্য। তাদের কাছে থাকা কিছু একটার বিস্ফোরণ হলে আহত হওয়ার ঘটনাটি ঘটে। তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি ॥ পল্লবী থানায় বিস্ফোরণে চার পুলিশ সদস্যসহ পাঁচজন আহত হওয়ার ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। বুধবার সন্ধ্যায় ডিএমপি কমিশনারের নির্দেশে ডিএমপির যুগ্ম পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম) মোঃ শাহ আবিদ হোসেনকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিকে আগামী তিনদিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। আইএসের দায় স্বীকার ॥ পল্লবী থানা কম্পাউন্ডের ভেতরে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনার দায় স্বীকার করেছে আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস)। বুধবার রাতে সাইট ইন্টেলিজেন্স তাদের টুইটার ও নিজস্ব ওয়েবসাইটে এ তথ্য জানিয়েছে। রাত ৮টা ৪৬ মিনিটে স্বীকারোক্তিমূলক টুইট করেন রিতা কাটজ। তবে ঢাকার পুলিশ কর্মকর্তারা এই বিস্ফোরণের সঙ্গে কোন ধরনের জঙ্গী সম্পৃক্ততা নেই বলে দাবি করেছে।
×