ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পাবলিক প্রসিকিউশন এক মেজর জেনারেলকে গ্রেফতারের নির্দেশ

মানব ও অর্থ পাচারের অভিযোগে পাপুলের কুয়েতে শাস্তি নিশ্চিত

প্রকাশিত: ২৩:১৪, ১২ জুলাই ২০২০

মানব ও অর্থ পাচারের অভিযোগে পাপুলের কুয়েতে শাস্তি নিশ্চিত

শংকর কুমার দে ॥ বাংলাদেশের সংসদ সদস্য- এমপি শহিদ ইসলাম পাপুলের কাছ থেকে ঘুষ নেয়ার অভিযোগে কুয়েতের পাবলিক প্রসিকিউশন মেজর জেনারেল শেখ মাজান আল জারাহ আল সাবাহরকে গ্রেফতার করে আদালতে হাজির করার আদেশ দিয়েছে কুয়েতের আদালত। ঘুষ দিয়ে কুয়েতের রেসিডেন্ট পারমিট নেয়ার বিরুদ্ধেও পাপুলের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে কুয়েত সরকার। পাপুলের বিরুদ্ধে মানব পাচার, অর্থ পাচারের তদন্ত হচ্ছে বাংলাদেশ ও কুয়েত দুই দেশেই। মানব পাচার ও অর্থ পাচারের অভিযোগে পাপুলের সাত থেকে পনেরো বছর শাস্তি হওয়া প্রায় নিশ্চিত। দুই দেশের যে কোন একটি অথবা দুই দেশেই তার শাস্তি হলে এমপি পদ বাতিল হবে এটাও প্রায় নিশ্চিত বলে তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও আইনজ্ঞগণের দাবি। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ খবর জানা গেছে। কুয়েতের দৈনিক আল কাবাস জানিয়েছে, শুক্রবার কুয়েতের পাবলিক প্রসিকিউশন মেজর জেনারেল শেখ মাজান আল জারাহ আল সাবাহরকে গ্রেফতার করে হাজির করার আদেশ দিয়েছেন কুয়েতের আদালতে। বাংলাদেশী এমপি শহিদ ইসলাম পাপুলের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে রেসিডেন্ট পারমিট বিক্রির অভিযোগে এ তদন্ত হচ্ছে। কুয়েতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্ডার সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করা আল সাবাহর বিরুদ্ধে তারই অধীনন্থ টিমের ওপর তদন্ত ও জিজ্ঞাসাবাদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কুয়েতের কারাগারে আটক এমপি পাপুলের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে তদন্ত করছে একাধিক তদন্ত সংস্থা। এর মধ্যে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), দুর্নীতি দমন সংস্থা (দুদক) অন্যতম। বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর তার আর্থিক বিষয়ে তদন্ত করছে। পাপুলের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। মানব পাচার ও অর্থ পাচারের বিষয়টি তদন্ত ছাড়াও আয়ের সঙ্গে অর্জিত অর্থ সম্পদের বিষয়টিও তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। প্রাথমিক তদন্তের তার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কর্তৃপক্ষ। এমনকি কুয়েতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের বিরুদ্ধে পাপুলকে অবৈধভাবে সহায়তা করেছে কিনা সেই অভিযোগে তদন্ত করা হচ্ছে বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দাবি করা হয়েছে। অপরদিকে কুয়েতেও পাপুলের বিরুদ্ধে মানব পাচার, অর্থ পাচার, ঘুষ প্রদান, রেসিডেন্ট পারমিট গ্রহণসহ বিভিন্ন বিষয়ে তদন্ত করছে। কুয়েতে তদন্তে যেসব ব্যক্তি জড়িত বলে প্রাথমিক তদন্তে প্রমাণ পাওয়া গেছে তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা, নজরদারি, তদন্তসহ নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে কুয়েত সরকার। ইতোমধ্যেই কয়েকজনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। কুয়েতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এস এম আবুল কালাম পাপুল আটক হওয়ার পর তাকে কি অপরাধে আটক করা হয়েছে তা জানাতে কুয়েতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এস এম আবুল কালাম চিঠি দিয়েছে তা এক মাস এক সপ্তাহ পরও তার উত্তর দেয়নি কুয়েত সরকার। পাপুল সে দেশের নাগরিক নন আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দিয়েছে কুয়েত সরকার। তার কুয়েতে সাজা হওয়ার বিষয়টি প্রায় নিশ্চিত। কুয়েতে দোষী সাব্যস্ত হলে তার সাত বছর থেকে পনেরো বছর পর্যন্ত সাজা হবে সে দেশের আইনানুযায়ী। কুয়েতে বা বিদেশে সাজা হলে এ দেশের এমপি পদ বাতিল হবে কিনা- এমন প্রশ্নও সামনে এসেছে। সংবিধানে নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধে ন্যূনতম দুই বছর সাজায় এমপি পদ খারিজ হওয়ার বিধান অনুযায়ী একজন সংসদ সদস্য যদি ফৌজদারি অপরাধ করেন, সাজা পৃথিবীর যেখানেই হোক, তাহলে তার এমপি পদ থাকবে না। এমপি পদ খারিজের জন্য শুধু প্রমাণ হতে হবে, তিনি ফৌজদারি অপরাধ করেছেন, সেই অপরাধের জন্য তার সাজা হয়েছে, ফলে কুয়েতে সাজা হলেও বাংলাদেশের সংসদে পাপুলের পদ খারিজ হবে। কারণ দেশে হোক আর বিদেশে হোক যে দেশেই একজন এমপির শাস্তি হওয়া, জেল খাটা কয়েদিকে তো আর কেউ এমপি হিসেবে জাতীয় সংসদে দেখতে চাইবেন না এমনটাই আইনজ্ঞদের দাবি। মারাফি কুয়েতিয়া কোম্পানির অন্যতম মালিক লক্ষ্মীপুর-২ আসন থেকে নির্বাচিত স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য শহিদ ইসলাম পাপুলকে ৬ জুন রাতে কুয়েতের মুশরিফ এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। পাচারের শিকার পাঁচ বাংলাদেশীর অভিযোগের ভিত্তিতে মানব পাচার, অর্থ পাচার ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের শোষণের অভিযোগ আনা হয় তার বিরুদ্ধে। প্রবাসী উদ্যোক্তাদের প্রতিষ্ঠিত এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকেও পাপুলের বড় অঙ্কের শেয়ার রয়েছে। কুয়েতে গ্রেফতার হওয়ার পর তাকে ওই ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যানের পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। পাপুল ও তার কোম্পানির ব্যাংক হিসাব ইতোমধ্যে জব্দ করেছে কুয়েত কর্তৃপক্ষ। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, অঢেল টাকা ছড়িয়ে পাপুল নিজে তো এমপি হয়েছেনই, এমনকি তার স্ত্রীকেও এমপি বানিয়েছেন। পাপুল এমপি হয়ে কুয়েতে গ্রেফতার হওয়ার ঘটনাটিতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করেছে বলে গণমাধ্যমে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। লক্ষ্মীপুর থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করে এমপি হন পাপুল। কিভাবে কাকে কত টাকা দিয়ে নিজে এমপি হয়ে তার স্ত্রীকেও এমপি বানিয়েছেন সেই বিষয়টিও তদন্ত করে দেখছে তদন্ত সংস্থা। ২০১৬ সালের আগে তাকে লক্ষ্মীপুরের রায়পুরের মানুষ চিনতও না, কিন্তু সেই কাজী শহিদ ইসলাম পাপুলই দুই বছরের মাথায় টাকা ছড়িয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে ভোট করে এমপি বনে গেছেন। নিজে এমপি হয়ে স্ত্রী সেলিনা ইসলামকেও একই কায়দায় সংরক্ষিত আসনের এমপি বানিয়েছেন পাপুল। এখন তিনি অর্থ ও মানব পাচারের অভিযোগে এখন কুয়েতের কারাগারের আটক আছেন। তাকে গ্রেফতার, কুয়েতে কারাগারে আটক হওয়ার ঘটনাটি বাংলাদেশ ও কুয়েত-দুই দেশের জাতীয় সংসদেই আলোচনা হয়েছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, সাধারণ শ্রমিক হিসেবে কুয়েত গিয়ে বিশাল সাম্রাজ্য গড়া পাপুল এখন সেখানকার মারাফি কুয়েতীরা কোম্পানির অন্যতম মালিক। প্রবাসী উদ্যোক্তাদের প্রতিষ্ঠিত এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকেও তার বড় অঙ্কের শেয়ার রয়েছে। জুনের শুরুতে কুয়েতে গ্রেফতার হওয়ার পর সেখানে পাপুল ও তার কোম্পানির ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে কুয়েত কর্তৃপক্ষ। সিআইডি, দুদক তদন্ত করা ছাড়াও তার পরিবারের বিরুদ্ধে দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। ২০১৬ সালের কোন এক সময় পাপুল তার গ্রামের বাড়ির সামনে নিজের মায়ের নামে একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান করার উদ্যোগ নেন তখন তার আগে পাপুলকে তিনি চিনতেন না। অভিযোগ আছে, জাতীয় পার্টি, আওয়ামী লীগসহ সকল সহযোগী সংগঠনের দলীয় অনুষ্ঠানগুলোয় প্রচুর অর্থ দিয়েছেন তিনি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ২০১৮ সালের নির্বাচনে লক্ষ্মীপুর-২ আসনটি তাদের মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেয়। আর জাতীয় পার্টি মনোনয়ন দেয় তাদের চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা গতবারের এমপি মোহাম্মদ নোমানকে। এদিকে শহিদ ইসলাম পাপুল দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন স্বতন্ত্র হিসেবে। নির্বাচনের আগে হঠাৎ জাতীয় পার্টির নোমান সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিলে পরিস্থিতি বদলে যায়। পরে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা পাপুলকে সমর্থন দেন এবং তিনি এমপি হয়ে যান। রাজনীতিতে নতুন মুখ পাপুলের আড়াই লাখ ভোটের বিপরীতে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির আবুল খায়ের ভূঁইয়া পান ২৮ হাজার ভোটের সামান্য বেশি। সংসদে দলীয় এমপির অনুপাতে সংরক্ষিত ৫০টি আসন ভাগাভাগির পর পাপুলসহ স্বতন্ত্র চার এমপির ভাগেও একটি আসন জোটে। সেই সংরক্ষিত আসনে পাপুল এমপি বানিয়ে আনেন তার স্ত্রী সেলিনা ইসলামকে। লক্ষ্মীপুরের কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা নির্বাচনের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে তখন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগকে অবহিত করেন, ওই আসনে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তাতে বিএনপি প্রার্থী খুব সহজেই এ আসনে জয়ী হয়ে যাবে। আর সে সময় নতুন করে প্রার্থী দেয়ার সুযোগ সেই। তাই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিএনপির প্রার্থীকে হারানোর জন্য স্থানীয় আওয়ামী লীগের পক্ষে পাপুলকে সমর্থন দেয়া ছাড়া উপায় নেই। পাপুল কুয়েতে গ্রেফতার হওয়ার পর সমালোচনার মধ্যে গত ২৮ জুন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা নোমানকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।
×