ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

বাড়ছে নদী ভাঙ্গন ॥ বানভাসিদের বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্য সঙ্কট

উত্তরে বন্যা পরিস্থিতির ফের অবনতি হাজার হাজার পরিবার পানিবন্দী

প্রকাশিত: ২১:৫২, ৫ জুলাই ২০২০

উত্তরে বন্যা পরিস্থিতির ফের অবনতি হাজার হাজার পরিবার পানিবন্দী

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দেশের উত্তরাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির ফের অবনতি হচ্ছে। তিস্তা ধরলা নদীর পানি আবারও বেড়েছে। ফলে পানিবন্দী হয়ে পড়ছে হাজার হাজার পরিবার। গত মাসের ২০ তারিখের পর থেকে এখন পর্যন্ত তিন দফায় পানি বেড়ে তিস্তা বিপদ সীমা অতিক্রম করে। পানি বেড়ে যাওয়ায় উত্তরের বন্যা পরিস্থিতির ফের অবনতি হচ্ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে নদী ভাঙ্গন। অনেকে ভিটেমাটি হারিয়ে বাঁধের ওপর আশ্রয় নিয়েছেন। দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের সঙ্কট। একই সঙ্গে দেশের মধ্যাঞ্চলে বন্যার অবনতি ঘটছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে রাজধানীর ঢাকার চার দিকে ঘিরে থাকা চার নদীর পানি। যদিও পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, রাজধানীর চার নদীর পানি বাড়লেও এখনও বিপদসীমা অতিক্রম করেনি। তবে পদ্মা ধলেশ্বরী নদীর পানি বেড়ে মধ্যাঞ্চলের রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ ফরিদপুর, শরীয়তপুর জেলার বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। আগামী কয়েক দিন পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে বলে তারা পূর্বাভাস দিয়েছে। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, দেশে ফের শুরু হয়েছে ভারি বর্ষণ। রাজধানী ঢাকায় বৃষ্টিপাত কম হলেও উত্তরের জেলায় গত কয়েক দিন ধরে ভারি বর্ষণ শুরু হয়েছে। ভারি বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে ফের বাড়ছে তিস্তা নদীর পানি। ফলে এর অববাহিকায় চরাঞ্চলগুলোতে আবারও বন্যা দেখা দিয়েছে। সঙ্গে তীব্র নদী ভাঙ্গন। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে হাজার হাজার পরিবার। তারা এখন মানবেতর জীবনযাপন করছে। এদিকে বন্যা পরিস্থিতির অবনতির পাশাপাশি নতুন সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে নদী ভাঙ্গন। এর ফলে ভিটেমাটি সব হারিয়ে বাঁধের ওপর আশ্রয় নিতে হচ্ছে বন্যার্তদের। বানভাসি মানুষ জানিয়েছে কয়েক দিনের বন্যায় বদলে গেছে তাদের চিরচেনা এলাকা। ভাঙ্গনের তীব্রতা এত বেশি যে, ঘরবাড়ি সরানোর ফুরসত মিলছে না। সেই সঙ্গে নদীগর্ভে চলে যাচ্ছে মূল্যবান গাছপালা। লালমনিরহাট ॥ শনিবার দুপুর ১২টায় জেলায় তিস্তা ও ধরলা নদীর পানি বিপদ সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তিস্তা নদীর পানি দোয়ানির ডালিয়া পয়েন্টে বিপদ সীমার ১২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। উজানের পাহাড়ী ঢল ও টানা বর্ষণের কারণে তিস্তা ও ধরলা নদীর পানি তৃতীয় দফায় বৃদ্ধি পেয়েছে। নদী দুইটি রুদ্রমূর্তি ধারণ করেছে। তিস্তা ও ধরলা নদীর প্রায় ৫০টি চর ও দ্বীপ চরে প্রায় ২৫ হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। কোথাও কোথাও বিশুদ্ধ খাবার পানি ও শুকনো খাবারের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। তিস্তার তীরবর্তী অঞ্চলের মানুষ গেল দুই সপ্তাহে তৃতীয় দফায় বন্যার কবলে পড়েছে। জেলায় বন্যা স্থায়ী রূপ নিয়েছে। দুই সপ্তাহে উজানের পাহাড়ী ঢল ও কয়েক দিনের বৃষ্টিতে তিস্তা নদীর পানি প্রবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে শুকিয়ে যাওয়া মৃতপ্রায় তিস্তা তৃতীয় ধাপে আবারও ফুলে ফেঁপে উঠে ফিরে পেয়েছে চিরচেনা রূপ। তিস্তা ও ধরলা খুবই খরস্রোতা নদী। নদী দুইটির রূপ এখন রুদ্রমূর্তি। কোথাও কোথাও দেখা দিয়েছে তীব্র নদী ভাঙ্গন। ইতোমধ্যে প্রায় দুইশ’ ঘরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। তিস্তা ও ধরলার তীরবর্তী ৫টি উপজেলার প্রায় ২৫ হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়ে। নীলফামারী ॥ নীলফামারীতে বন্যা পরিস্থিতির পুনরায় অবনতি হয়েছে। শনিবার সকালে ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি বিপদ সীমার ২২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এতে পুনরায় বন্যায় কবলিত হয়েছে ডিমলা উপজেলার পূর্ব ছাতনাই, খগাখড়িবাড়ি, টেপাখড়িবাড়ি, খালিশা চাঁপানী, ঝুনাগাছ চাঁপানী ও গয়াবাড়ি ইউনিয়নের প্রায় সাড়ে ৩ হাজার পরিবার। এ ছাড়া নদীর তীব্র স্রোতে ভাঙ্গনের কবলে পড়েছে ডিমলা উপজেলা কিছামত ছাতনাই ও ছাতুনামা ভে-াবাড়ি গ্রাম। এর মধ্যে কিছামত ছাতনাইয়ের ২৩ পরিবার ও ছাতুনামা ভে-াবাড়ি ৪১ পরিবারের বসতঘর নদীতে বিলীন হয়েছে। এর আগে চলতি বছরের বর্ষা মৌসুমে তিস্তা নদীর পানি সর্ব প্রথম ২০ জুন বিপদসীমার ওপরে উঠে। যা পরদিন ২১ জুন সকালে নেমে যায়। এর ৬ দিনের মাথায় ২৬ জুন তিস্তা নদীর পানি দ্বিতীয় দফায় পুনরায় বিপদসীমা অতিক্রম করে ২০ সেন্টিমিটার ওপরে উঠে ২৮ জুন সকালে পানি নেমে গিয়েছিল। ওই সময় নদী ভাঙ্গনের কবলে পড়ে ৭৫ বাড়ি বিলীন হয়। এদিকে তৃতীয় দফায় উজানের ঢলে তিস্তা নদীতে সৃষ্ট বন্যার পানি সামাল দিতে খুলে রাখা হয়েছে তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাট। গাইবান্ধা ॥ ব্রহ্মপুত্র ও ঘাঘট নদীর পানি কমতে শুরু করলেও বন্যা পরিস্থিতি এখনও অপরিবির্তত রয়েছে। এছাড়া বন্যার পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নদী ভাঙ্গনও তীব্র আকার ধারণ করেছে। শনিবার ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার ৬৬ সে.মি. ও ঘাঘট নদীর পানি বিপদসীমার ৩১ সে.মি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এদিকে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ বা উঁচু স্থানে আশ্রিত বানভাসি মানুষ এবং বন্যাকবলিত এলাকার বসতবাড়িতে অবস্থানকারী পানিবন্দী মানুষদের শুকনা খাবার, বিশুব্ধ পানি, পয়ঃনিষ্কাশন সমস্যা ও গো-খাদ্যের সঙ্কট দেখা দিয়েছে জেলার সুন্দরগঞ্জ, সাঘাটা, ফুলছড়ি ও সদর উপজেলার ২৬টি ইউনিয়ন বন্যাকবলিত হয়ে পড়ায় ১ লাখ ২২ হাজার ৩২০ জন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যাদুর্গত মানুষের জন্য এ পর্যন্ত ২শ’ মে. টন চাল ও ১৩ লাখ টাকা সরকারী বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। বন্যাদুর্গত ৪টি উপজেলায় ৬১টি মেডিক্যাল টিম কাজ করছে। এদিকে কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এ পর্যন্ত ফসলসহ প্রায় ২ হাজার হেক্টর জমি পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। এতে চিনা বাদাম, আউশ ধান ও পাটের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বগুড়া ॥ বগুড়ার তিন উপজেলা সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনটে যমুনার পানি বিপদসীমার ৪৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে বাঙালী নদীর পানি স্থিতিশীল। উজানি ঢলের পানি গড়িয়ে যাচ্ছে যমুনা হার্ডপয়েন্টের ভেতরের পূর্বে নিচু এলাকা ও চরাঞ্চলের ওপর দিয়ে। চরের নিচু এলাকাগুলো ডুবে গেছে। ক্ষতি হয়েছে আউশ ও পাট আবাদের। কৃষক আমানের বীজতলা তৈরি করতে পারছে না। বন্যা দীর্ঘ সময় থাকলে আমন আবাদের ওপর প্রভাব পড়বে। চারা না পাওয়ায় সময়মতো রোপণ কার্যক্রম শুরু হবে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুবর বলেছেন, মধ্য জুলাইয়ে টানা বৃষ্টি ও ঢলের পানির তোড় বেড়ে গেলে যমুনার ভেতরের সমস্ত এলাকায় বন্যা ধাক্কা দিতে পারে। আবহাওয়া বিভাগের পূর্বাভাসেও ওই সময়ে টানা ভারি বৃষ্টির সম্ভাবনার কথা বলা আছে। এদিকে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আজাহার আলী ম-ল জানান, সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলার ৮৮টি গ্রাম বন্যাকবলিত হয়েছে এমন একটি রিপোর্ট তিনি পেয়েছেন। প্রশাসনের নির্দেশে বন্যাকবলিত ১৫ হাজার পরিবারের মধ্যে ৬০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ করা হয়েছে। মানিকগঞ্জ ॥ যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় আরিচা পয়েন্টে বিপদ সীমার ৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বৃদ্ধি ও অব্যাহত স্রোতের কারণে পাটুরিয়া দৌলতদিয়া নৌরুটে ফেরি চলাচল করছে ধীর গতিতে। এ কারণে ফেরির ট্রিপ সংখ্যা কমে যাওয়ায় গত বুধবার থেকে শনিবার বিকেল পর্যন্ত পাটুরিয়া ঘাটে ৩ শতাধিক পণ্যবাহী ট্রাকসহ কিছু যাত্রীবাহী যানবাহনকে পারাপারের অপেক্ষায় রেেয়ছে। স্রোত বেড়ে যাওয়ায় ফেরির ট্রিপ সংখ্যা কমে গিয়ে প্রতিদিনই পারাপারের অপেক্ষায় আটকে থাকা পণ্যবাহী ট্রাকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঘাটের পরিস্থিতি সচল রাখতে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে পণ্যবাহী ট্রাকগুলোকে আটকে রাখা হচ্ছে। পানি ও স্রোত বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে পাটুরিয়া ঘাট দিয়ে যানবাহন পারাপারের এ অবস্থার উন্নতি ঘটবে না বলে মনে করেন ঘাট সংশ্লিষ্টরা। হাতিয়া ॥ পূর্ণিমার জোয়ারে নোয়াখালী দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার ৩টি ইউনিয়নের ১০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। শনিবার দুপুরের জোয়ারে এসব এলাকা প্লাবিত হয়। এতে উপজেলার সুখচর, নলচিরা ও চরঈশ্বর ইউনিয়নের ১০টি গ্রাম প্লাবিত হয়। ফরিদপুর ॥ গোয়ালন্দ পয়েন্টে পদ্মা নদীর পানি বিপদসীমার ৪৮ সে. মি ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। শনিবার বিকেল ৬টায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের গেজমাস্টার ইদ্রিস আলি সূত্রে এ খবর জানা গেছে। শনিবার সন্ধ্যা ছয়টায় গোয়ালন্দ পয়েন্টে পদ্মা নদীর পানি ৯ দশমিক ১৩ সে.মিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় পানি বেড়েছে ২ সে.মি। এদিকে পানি বেড়ে যাওয়ায় ফরিদপুর সদরের তিনটি ইউনিয়ন নর্থ চ্যানেল, ডিক্রিরচর ও আলীয়াবাদ ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। নর্থ চ্যানেলে পানি বাড়ায় ২০ একর জমির ভুট্টা, আউশ ও তিল ডুবে গেছে। এছাড়া ওই ইউনিয়নের পুরাতন মোহন মিয়ার হাট এলাকার একটি সড়কের ২০ মিটার অংশ পানিতে ধসে গেছে। এছাড়া গোলডাঙ্গি সড়ক, বারান বিশ্বাসের ডাঙ্গি এলাকার সড়ক, কাইমুদ্দীন মাতুব্বরেরডাঙ্গি এলাকার তিনটি সড়ক পানির নিচে তলিয়ে গেছে। নর্থ চ্যানেল ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ মোস্তাকুজ্জামান বলেন, প্রতিদিনেই পানি বাড়ছে। তবে পানি বাড়ার গতি কম। যে জমি তলিয়ে গেছে তাতে আউশ ধান সম্পূর্ণভাবে বিনষ্ট হয়ে গেছে। সদরের ডিক্রিরচর ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান মেহেদী হাসান জানান, পানি বেড়ে তার ইউনিয়নে ৩৩০ একর জমির ভুট্টা, আউশ ধান এবং বাদাম তলিয়ে গেছে। তার ইউনিয়নের ৬ হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এদিকে আলীয়াবাদ ইউনিয়নের বেড়িবাঁধের বাইরে অবস্থানরত তিন শতাধিক পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ ওমর ফারুক বলেন, ইউনিয়নের সাদীপুর ও গদাধরডাঙ্গি গ্রামের পানিবন্দী হওয়া ওই তিনশ’ পরিবার মানবেতর জীবন যাপন করছে। এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড ফরিদপুরের চরভদ্রাসনের সদর ইউনিয়নের বালিয়াডাঙ্গী ভাঙ্গার মাথায় বালিয়াডাঙ্গি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে নদী তীরের ভেঙ্গে যাওয়া ৩০ মিটার অংশ বালির বস্তা ফেলে ভাঙ্গন রোধ করেছে। এ কাজে ৬০০ বালিভর্তি জিও ব্যাগ ব্যবহার করা হয়েছে।
×