ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মাস্কে ঢাকা মুখ, খসখসে হাত হোম-অফিস

প্রকাশিত: ২১:২০, ২ জুলাই ২০২০

মাস্কে ঢাকা মুখ, খসখসে হাত হোম-অফিস

মোরসালিন মিজান ॥ জীবন এত কী করে বদলে যায়? প্রতিদিনের চেনা রুটিন তছনছ হয়ে গেছে। জরুরী কাজ। পরিকল্পনা। ভেস্তে গেছে সব। অহর্নিশ ছোটাছুটি করা বহু মানুষ এখন ঘরবন্দী। জীবিকার প্রয়োজনে যারা বাইরে বের হচ্ছেন, হতে হচ্ছে তারাও স্বস্তিতে নেই। কাজে যেটুকু মনোযোগ, তারও বেশি ভাবতে হচ্ছে নিজের সুরক্ষা নিয়ে। ইতোমধ্যে প্রতিদিনের জীবন ঢেলে সাজিয়েছে মানুষ। পোশাক-আশাকে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। সুরক্ষা সামগ্রীতে মুখ নাক ঢাকা। সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় পরস্পরকে সামান্যই চিনতে পারছেন। এভাবে ঘরে এবং জীবিকার প্রয়োজনে বাইরে বের হওয়া মানুষের জীবন আমূল বদলে গেছে। অদ্ভুত এই বাস্তবতার মুখোমুখি করেছে নোভেল করোনাভাইরাস। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ আজ আক্রান্ত। মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে চলেছে। ভাল নেই বাংলাদেশও। সংক্রমণ ও মৃত্যু দুটোই বাড়ছে। দেশে প্রথম করোনা রোগীর সন্ধান মিলেছিল গত ৮ মার্চ। এর পর থেকেই ঘরে ঢুকতে শুরু করে মানুষ। ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। কয়েক দফায় সে ছুটি বাড়ানো হয়। অঘোষিত লকডাউনের ফলে ব্যবসা চাকরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সব কিছু বন্ধ হয়ে যায়। তখন থেকেই বদলাতে থাকে জীবন। বর্তমানে সীমিত পরিসরে সবকিছু খুলে দেয়া হলেও, আগের সেই ছন্দ নেই। বরং একেবারেই ভিন্ন ছবি। বিচিত্রও বটে। এখন যারা জীবিকার প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হচ্ছেন তাদের কারও চেহারা পুরোপুরি দেখা যায় না। নাক মুখ মাস্কে ঢাকা। কিছুদিন আগেও একটি করে মাস্ক ব্যবহার করতে দেখা গেছে। এখন অনেকে একসঙ্গে দুটি মাস্ক ব্যবহার করছেন। চোখ মুখ তাই ইটচাপা ঘাসের মতো। স্যাঁতস্যাঁতে। তদুপরি নাকের ওপর চেপে বসেছে ইয়া বড় গগলস। সেফটি গগলস নাক থেকে কপাল পর্যন্ত কামড়ে ধরছে। এত কিছু ভেদ করে মূল ব্যক্তিটিকে চিনে নেয়া সহজ কাজ নয়। চোখ মুখের মতো হাতও গ্লাভসের ভেতরে ঢুকিয়ে নেয়া হচ্ছে। চিকিৎসকরা অপারেশন থিয়েটারে যে সার্জিক্যাল গ্লাভস ব্যবহার করেন, সেটি পরে রাস্তায় হাঁটছে সাধারণ মানুষ। এমন দৃশ্য করোনাপূর্ব পৃথিবীতে কেউ দেখেনি। আর যাদের হাত খোলা তারা কিছুক্ষণ পর পর পকেট থেকে হ্যান্ড স্যানিটাইজারের শিশি বের করছেন। কয়েক ফোঁটা তরল তালুতে ঢেলে নিয়ে ভাল করে ঘষছেন। সাবান পানি দিয়ে হাত ধোয়া আরও বেশি কার্যকর। এ অভ্যাস আগেও কিছুটা ছিল। এখন ঘরে ঘরে। দিনে কতবার হাত ধোয়া হচ্ছে তার কোন হিসাব নেই। বার বার সাবান দিয়ে ধোয়ায় হাত যারপরনাই খসখসে। এখন মাথাও অপারেশ থিয়েটারের সেই টুপিটা দিয়ে ঢাকা। আরও বেশি অবাক হতে হয় কামানো মাথা দেখে। সেলুনে গেলে সংক্রমিত হওয়ার ভয়। তাই ঘরে বসেই চলছে ন্যাড়া হওয়া। এত যত্নের চুল। ঠিক মতো কেটে ছেটে রাখা যাচ্ছে না। তাই এমন কামিয়ে ফেলা। এ কারণেও চেনা মানুষটিকে অচেনা ঠেকছে। সবচেয়ে অদ্ভুত দেখাচ্ছে পিপিই পরে ঘর থেকে বের হওয়া মানুষগুলোকে। পলিথিন সদৃশ্য বিশাল ব্যাগে নিজেকে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে চেইনটা টেনে দেয়া হচ্ছে। আগা-গোড়া মোড়ানো মানুষ এ অবস্থায় হাঁটতে চলতে অভ্যস্থ হয়েছে। তেমনই এক ব্যবহারকারীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল রাজধানীর বিজয় সরণি মোড়ে। একটি অনলাইন শপে কাজ করেন তিনি। বাইসাইকেলে করে বাসা বাড়িতে পণ্য সরবরাহ করেন। পিপিই পরে এ কাজ করতে সমস্যা হয় না কোন? জানতে চাইলে শাখাওয়াত নামের এ তরুণের জবাব: প্রথম প্রথম গরমে খুব কষ্ট হতো। ঠিকমতো সাইকেল চালাতে পারতাম না। কিন্তু জীবিকার প্রয়োজনে সব সম্ভব। এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। পরিচিতরাও পিপিই পরা অবস্থায় আমাকে চেনে না। না চেনাই ভাল বলে নিজেকে সান্ত¡না দেন তিনি। মানুষের চলাচলেও পরিবর্তন এসেছে। বেড়েছে ব্যক্তিগত যানবাহনের ব্যবহার। বাইসাইকেল চোখে পড়ছে খুব। গণপরিবহনেও অতিরিক্ত যাত্রী বা গায়ে গা লাগা ভিড় নেই। অধিকাংশ আসন ফাঁকা। ওঠার আগে যাত্রীদের হাতে স্প্রে করা হচ্ছে সাবান পানি। ফার্মগেটে সিএনজি চালিত অটোরিক্সায় ওঠার আগে যাত্রী নিজে উদ্যোগী হয়ে সিটে সাবান পানি স্প্রে করছিলেন। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ থেকে বোতল বের করে আশপাশ জীবাণুমুক্ত করতে দেখা যায় তাকে। এ বিষয়ে জানতে তার কিছুটা কাছে এগিয়ে যেতেই হাত উঁচু করে থামিয়ে দেন। দূর থেকে কথা বলার পরামর্শ দেন তিনি। আশীষ সেন নামের এই প্রবীণ বলেন, বয়স হয়েছে। কারও বোঝা বাড়াতে চাই না। তাই সুরক্ষিত থাকার চেষ্টা করছি। বিশেষ কাজে দুই মাস পর বাসার বাইরে বের হয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, অটোরিক্সায় প্রতিদিন কত যাত্রী ওঠে। করোনা রোগী যে উঠেনি, তা তো বলা যায় না। এ কারণে অল্প কিছুক্ষণের জন্য বসলেও, অটোরিক্সার সিটে জীবাণুনাশক ছিটিয়ে নিলাম। বাইরে বের হলে জীবাণুনাশকের এই বোতল সঙ্গে রাখেন বলে জানান তিনি। এদিকে, যারা ঘরে আছেন তাদের প্রতিদিনের জীবনও যথেষ্ট পাল্টে গেছে। দিন রাতের হিসাব নেই। ঘুম খাওয়ার সময় ঠিক থাকছে না। পরিবার পরিজনের সঙ্গে বেশি সময় থাকা যাচ্ছে, এই একমাত্র পাওয়া। বাকি সময় এ-ঘর ও-ঘর করে কাটাতে হচ্ছে। বারান্দায় চেয়ার পাতা। চেয়ারে বসে শুকনো চোখে বাইরের পানে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে। পায়চারী করে সময় কাটাতে হচ্ছে। সবার ছাদে যাওয়ার অনুমতি নেই। তাই আকাশটাও ঠিক মতো দেখতে পারছেন না। মনে ভর করছে হতাশা। বাসায় বসে অফিস করা লোকের সংখ্যাও কম নয় এখন। হোম অফিস কথাটি সবার মুখে মুখে। লিভিং রুমের এক কোনে টেবিল পাতা হয়েছে। তার ওপর ল্যাপটপ। কাজ হচ্ছে ইন্টারনেটে। তাদেরই একজন সুমাইয়া আমিন। একটি বিদেশী গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশ অফিসে কাজ করেন। করোনা পরিস্থিতি শুরুর পর থেকে হোম-অফিস করছেন। অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, বাসার ডাইনিং টেবিলে ল্যাপটপ পেতে কাজ করছি আমি। সকালে একদফা কাজ করি। দুপুরে খাওয়ার পর আরেক দফা। ভিডিও কল ও অনলাইন ডেটিং এ্যাপ ব্যবহার করে মিটিং ইত্যাদি করছি। নতুন এই অফিস মন্দ লাগছে না বলে মত দেন তিনি। অবশ্য এত সতর্কতার পরও কোন কোন ঘরে ঢুকে পড়ছে করোনা। করোনার উপসর্গ দেখা দিচ্ছে। আর তখনই মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। ঘরের ভেতরে আরও ঘর তৈরি করে নিতে হচ্ছে। পরিবারের সবার থেকে আলাদা হতে হচ্ছে আক্রান্তকে। এক ঘরে করোনা আক্রান্ত বাবা। পাশের ঘরে স্ত্রী সন্তান। এর চেয়ে ভয়ানক আর কী হতে পারে? করোনায় আক্রান্ত হওয়া এক সাংবাদিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলছিলেন, আমার করোনা টেস্টে পজিটিভ রেজাল্ট আসার আগে থেকেই স্ত্রী ও দুই বাচ্চা থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিলাম। হাসপাতালে গেলে চিকিৎসা পাব না। তাই বাসার স্টোররুম খালি করে সেখানে ২১ দিন কাটিয়েছি। এ সময়ের মধ্যে পরিবারের কারও মুখ দেখিনি আমি। এখন সব ঠিক থাকলেও, বাসার সবাই সবার থেকে একটু দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করছেন বলে জানান তিনি। সব মিলিয়ে আমূল বদলে যাওয়া জীবন। এ জীবন থেকে ফেরাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আদৌ কি চ্যালেঞ্জে জিতবে মানুষ? নাকি বদলে যাওয়া জীবনটাই স্থায়ী হবে? সময়ই দিতে পারে উত্তর। সে পর্যন্ত শুধুই অপেক্ষা।
×