ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

যমুনার পানি আরও বাড়ছে

উত্তরের পর মধ্যাঞ্চলেও বন্যার আশঙ্কা

প্রকাশিত: ২২:৩৪, ৩০ জুন ২০২০

উত্তরের পর মধ্যাঞ্চলেও বন্যার আশঙ্কা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ হু হু করে বাড়ছে উত্তরের প্রধান নদী যমুনার পানি। ভারি বৃষ্টি এবং উজান থেকে নেমে আসা পানির কারণে বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে ৮৫, সারিয়াকন্দিতে বিপদসীমার ৭২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে বিপদ সীমার ৬১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে আরও এক সপ্তাহ পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে। এই সময়ের মধ্যে উত্তরাঞ্চলের পাশাপাশি দেশের মধ্যাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা রয়েছে। এদিকে নদীর পানি বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে নদী ভাঙ্গনের প্রকোপ বেড়েছে। এদিকে দেশের উত্তর পুর্বাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। পানি উন্নয়নবোর্ড জানিয়েছে যমুনা নদীর পানি আরও বেড়ে যাওয়ার কারণে গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ বগুড়া এবং টাঙ্গাইলের নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। নদীর পানি আরও বাড়ার পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। এদিকে যমুনা নদীর পানি দ্রুত বেড়ে যাওয়ার কারণে নতুন করে কয়েক লক্ষ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হওয়ার কারণে জনগণের দুর্ভোগ আরও বেড়ে যাচ্ছে। পানিবন্দী হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে তারা। অনেকেই বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে। ফসলের ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক। পুকুরের মাছ ভেসে কৃষকে স্বপ্ন ধুলিসাৎ হয়েছে। নদী ও চরাঞ্চলের মানুষের আহাজারি বেড়েছে। করেনাকালে এমনিতেই মানুষের কাজ কম। এরপর বন্যা মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে দেখা দিয়েছে। এই কয়েকদিনের বন্যায় অনেক পরিবার ঘরবাড়ি হারিয়েছেন। চরাঞ্চলে পানিতে তলিয়েছে সবজি ক্ষেতসহ ফসলি জমি। এদিকে তিস্তা নদীর পানি কমে লালমনিরহাটের বন্যা পরিস্থিতির কিছু উন্নতি হলে মানুষের দুর্ভোগ কমেনি। ডালিয়া পয়েন্টে নদীটির পানি এখন বিপদ সীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে গাইবন্ধায় তিস্তামুখ ঘাটে ব্রহ্মপুত্র নদীর পানি এবং ঘাঘট নদীর পানি বেড়ে বিপদ সীমার ৭৮ ও ৫৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়ে মানুষের দুর্ভোগ আরও বাড়িয়েছে দিয়েছে। এই এলাকায় নদীর পানি বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নদী ভাঙ্গন বেড়ে গেছে। ভাঙ্গন কবলিত এলাকায় মানুষ তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে দিয়ে বাঁধে উঁচু স্থানে খোলা আকাশের নিচে রাত যাপন করছে। গাইবান্ধা ॥ গাইবান্ধায় ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা ও ঘাঘট নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় সোমবার দুপুর ৩টা পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্রের পানি তিস্তামুখ ঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ৭৮ সেমি ও ঘাঘট নদীর পানি নতুন ব্রিজ পয়েন্টে বিপদসীমার ৫৩ সেমি ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। ফলে জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি আরও মারাত্মক অবনতি হওয়ায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। ফলে পানিবন্দী হয়ে পড়ছে হাজার হাজার মানুষ। এছাড়া পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নদী ভাঙ্গনও ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ভাঙ্গন কবলিত ও পানিবন্দী লোকজন তাদের বাড়ি ঘর ছেড়ে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ও গরু-ছাগল নিয়ে নৌকায় করে আসবাবপত্র নিয়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও উঁচু স্থানে গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে। বগুড়া ॥ বৃষ্টি ও উজানী ঢলে যমুনার পানি বাড়ছে। বগুড়ার সারিয়াকান্দি পয়েন্টে গত ২৪ ঘণ্টায় (সোমবার বিকেল পর্যন্ত) যমুনার পানি বেড়ে বিপদসীমার ৬২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানিয়েছে যমুনার পানি বেড়ে যাওয়ায় সারিয়াকান্দির চর এলাকায় বন্যা দেখা দিয়েছে। পানি বৃদ্ধির এই ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সমস্ত নিচু এলাকা ও চরগ্রাম বন্যাকবলিত হবে। করোনার এই সময়ে বন্যা আরেক দুর্যোগ হয়ে আসছে। যমুনা তীরবর্তী সারিয়াকান্দি উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের মধ্যে ৯টি চর এলাকা। এলাকার লোকজন নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য কেউ শুকনো ভূমি কেউ বাঁধে কেউ কোন প্রাইমারী স্কুল সংযুক্ত ফ্লাড শেল্টারে অবস্থান নিয়েছে। সিরাজগঞ্জ ॥ উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢল এবং ভারিবর্ষণে সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে যমুনা নদীর পানি প্রবাহ গত ২৪ ঘণ্টায় ১৯ সেমি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমা ৩১ সেমি ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে করে নদীর দু’কূল ছাপিয়ে চরাঞ্চলের ২২ ইউনিয়নের বাড়ি-ঘরে পানি ঢুকে পড়ে পানিবন্দী হয়ে পড়ছে প্রায় লক্ষাধিক মানুষ। পানিতে তলিয়ে গেছে পাট, আউশ ধান, কাউন, ভুট্টা, বাদাম, সবজি ক্ষেত বীজতলা ও গোচারণ ভূমি। সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী একেএম রফিকুল ইসলাম জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে যমুনা নদীর পানি ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। সোমবার সকাল ৬টায় কাজিপুরে যমুনা বিপদসীমার ৬১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। নীলফামারী ॥ তিস্তার বন্যা ভাঙ্গনে নীলফামারীতে নতুন করে আরও বসতবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। রবিবার রাতে ডিমলা উপজেলা ঝুনাগাছ ইউনিয়নের ছাতুনামা ভেন্ডাবাড়ি চরে ১৬ পরিবার ও টেপাখড়িবাড়ি ইউনিয়নের চরখড়িবাড়ি গ্রামে ৮ পরিবারসহ ২৪ পরিবারের ভাঙ্গনের মুখে পড়ে। সোমবার পর্যন্ত উপজেলায় তিস্তার ভাঙ্গনে বসতবাড়ি হারিয়ে মোট ৬৯টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হলো। পানি উন্নয়ন বোর্ডের উত্তরাঞ্চলীয় প্রধান নির্বাহী প্রকৌশলী জ্যোতি প্রসাদ ঘোষ জানান, রংপুর অঞ্চলের তিস্তা, ধরলা ও ব্রহ্মপুত্র, যমুনেশ্বরী, টাঙ্গন, পুনর্ভবা, ইছামতি, নদীর চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলের গ্রামগুলো প্লাবিত হয়ে গেছে। দেখা দিয়েছে ভাঙ্গন। সুনামগঞ্জ ॥ বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। সোমবার সকাল ৯টায় সুরমা নদীর ষোলঘর পয়েন্টে বিপদ সীমার ৩৩ সেমি ওপরে এবং যাদুকাটার পানি ৫৮ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত। হাওড় ও জনপদে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত আছে। ফলে বন্যা কবলিত এলাকা বাড়ছেই। প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা, ৬১ ইউনিযনের ৬৬ হাজার পরিবার বন্যা কবলিত। অনেক উঁচু এলাকায়ও হাঁটু সমান পানি। নিচু এলাকার ঘরবাড়িতে কোমর থেকে গলা সমান পানি। উজান থেকে নেমে আসা পানি প্রবল তোড়ে সুনামগঞ্জ-জামালগঞ্জ সড়কের ঘাঘটিয়া এলাকায় এবং সুনামগঞ্জ-ছাতক সড়কের কাটাখালি এলাকায় রাস্তা ভেঙ্গে যাওয়ায় জেলা সদরের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে এসব উপজেলার। পানিতে তলিয়ে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে জগন্নথপুর, তাহিরপুর ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার। ভেসে গেছে ৪ হাজড়েরও বেশি মৎস্য ও পোল্ট্রি খামার। ভূঞাপুর, টাঙ্গাইল ॥ গত কয়েকদিন যাবত যমুনার পানি অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পাওয়ায় টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরে বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। এতে অর্ধলক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বিপদসীমার ৪৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। অনেক স্থানে দেখা দিয়েছে ভাঙ্গন। গৃহহারা হয়েছে শত শত পরিবার। গত ক’দিনে যমুনার পানি অতিমাত্রায় বৃদ্ধির কারণে যমুনা নদী তীরবর্তী গ্রামগুলোতে ব্যাপক ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। এতে গৃহহীন হয়ে পড়েছে শত শত পরিবার। তলিয়ে গেছে পাট, আউশ ধান, তিল, বাদামসহ কয়েক হাজার একর জমির ফসল। নেত্রকোনা ॥ সীমান্তবর্তী কলমাকান্দা উপজেলায় বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। তবে কলমাকান্দা পয়েন্টে সোমেশ্বরী নদীর পানি বিপদসীমার আট সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কলমাকান্দা সদর, রংছাতি, বড়খাপন ও খারনৈ ইউনিয়নে প্লাবিত শতাধিক গ্রাম এখনও পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছে। রংছাতি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তাহেরা বেগম জানান, ওই ইউনিয়নের অন্তত ৩০টি গ্রাম এখনও পানিবন্দী। অনেকের ঘরবাড়ি পানিতে নিমজ্জিত। বড়ুয়াকোনা বাজার, সন্ন্যাসী পাড়া ও মৌতলা গ্রামে মহাদেও নদীতে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। এছাড়া কলমাকান্দা-পাঁচগাঁও সড়কের নল্লাপাড়া এলাকার রসুর ব্রিজটির দু’পাশের এ্যাপ্রোচের মাটি ধসে যাওয়ায় ওই ইউনিয়নটি উপজেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এদিকে কলমাকান্দা সদরে উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্সের বিভিন্ন সরকারী অফিস এখনও পানিবন্দী। এছাড়া মন্তলা, চানপুর, পূর্ব বাজার, শিবমন্দির রোড, স্টেডিয়াম রোড, মুক্তিরনগর, নয়াপাড়া প্রভৃতি এলাকার দুই শতাধিক বাসাবাড়ির ভিটামাটি এখনও পানির নিচে রয়েছে। জামালপুর ॥ উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢল ও ভারি বর্ষণে যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় জামালপুরে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদীর পানি বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে ২২ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে সোমবার বিকেল ৩টায় বিপদসীমার ৮৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় দেওয়ানগঞ্জ, ইসলামপুর, মেলান্দহ, মাদারগঞ্জ, সরিষাবাড়ী এবং বকশীগঞ্জ উপজেলার ২৭টি ইউনিয়নের এক লাখ ৪৭ হাজার ৬৩২ জন মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। মেলান্দহ উপজেলার দুরমুঠ ইউনিয়নের রুকনাই গ্রামে সোমবার দুপুরে বন্যার পানিতে গোসল করতে নেমে সানি (১৪) নামের এক ছেলের মৃত্যু হয়েছে। মাদারগঞ্জ উপজেলার চরপাকেরদহ ইউনিয়নের মির্জাপুর গ্রামে বন্যার পানিতে ডুবে সোহান নামের সাত বছরের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। কুড়িগ্রাম ॥ কুড়িগ্রামের ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তা, দুধকুমারসহ ১৬টি নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। জেলার নাগেশ্বরী উপজেলার নারায়ণপুরে বন্যার পানিতে ডুবে সাত বছরের এক শিশু মারা গেছে। ব্রহ্মপুত্রের পানি চিলমারী পয়েন্টে বিপদসীমার ৭৬ সেন্টিমিটার, নুনখাওয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ৬৩ সেন্টিমিটার ও ধরলার পানি সেতু পয়েন্টে বিপদসীমার ৭৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে জেলার চিলমারী, উলিপুর, রৌমারী, রাজিবপুর, সদর, নাগেশ্বরী উপজেলাসহ ৯ উপজেলার ৩৫ ইউনিয়নের প্রায় আড়াই লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী জীবন যাপন করছে। গত গত ৫ দিন ধরে পানিবন্দী এসব মানুষের শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করছে।
×