ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

৪৮ জেলাই হতে পারে রেড জোন

প্রকাশিত: ২১:৪২, ২৯ জুন ২০২০

৪৮ জেলাই হতে পারে রেড জোন

রাজন ভট্টাচার্য ॥ দেশের ৬৪ জেলাতেই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী রয়েছেন। তবে রাজধানী ঢাকায় সবচেয়ে বেশি মানুষের দেহে ভাইরাসটির সংক্রমণ হয়েছে। ঢাকা শহরে এখন ২৮ হাজারের বেশি রোগী রয়েছেন। আর দেশের অন্তত ৪৮ জেলায় প্রতিটিতে রোগীর সংখ্যা দুই শতাধিকের বেশি। ১৬ জেলার প্রতিটিতে রোগী রয়েছে ৫৯ থেকে ১৯৬ পর্যন্ত। ঢাকার পর সবচেয়ে বেশি রোগী চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী জেলায়। বিভাগ বিশ্লেষণে সবচেয়ে বেশি ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগে। সবচেয়ে কম রোগী শনাক্ত হয়েছে মেহেরপুর ও মাগুরা জেলায়। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্যানুযায়ী এমন চিত্র পাওয়া গেছে। করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ইতোমধ্যে ১৯ জেলায় কয়েকবারে রেড জোন ঘোষণা করে সাধারণ ছুটির প্রজ্ঞাপন জারি করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। ঢাকার ৪৫ এলাকা চিহ্নিত করা হলেও রাজাবাজারে ১৪ দিন শেষে ২১ দিনের পাইলট প্রকল্প চলমান রয়েছে। অন্য এলাকা কবে রেড জোনের কাজ শুরু হবে তা নিশ্চিত করে কেউ জানেন না। তবে ওয়ারী এলাকা রেড জোনের কাজ শুরু করতে ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি পাঠানোর কথা জানানো হয়েছে। কথা হলো সংক্রমণ ও মৃত্যু উর্ধগতির মধ্যে কিছু কিছু এলাকা রেড জোন ঘোষণা করে ভাইরাসের বিস্তার রোধ করা কি আসলেই সম্ভব? ইতোমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে গঠিত ১৩ সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটির মতামতের ওপর ভিত্তি করে লাল, হলুদ ও সবুজ জোন চিহ্নিত করা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে রেড জোনগুলোর নাম ঘোষণা করা হলেও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ অদৃশ্য। কি বলছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতামত হলো, দেশে মোট আক্রান্ত রোগীর একটা বড় অংশ রাজধানীর। দুই কোটির বেশি মানুষের বসতি যে শহরে সেখানে এলাকাভিত্তিক লকডাউন দিয়ে ছোঁয়াচে এই ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে আনা হবে সত্যিই কষ্টসাধ্য। তাই ঢাকা কমপক্ষে ১৫ দিনের জন্য পুরোপুরি লকডাউন প্রয়োজন। এর বাইরে দেশের সব জেলা পুরোপুরি লকডাউন সম্ভব না হলেও ৪৮ জেলায় কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্য জরুরী ভিত্তিতে লকডাউনের পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। অন্যথায় বিগত দিনে করোনা নিয়ন্ত্রণের জন্য যে ট্রেন আমরা মিস করেছি সামনের দিনগুলোতে কঠোর পদক্ষেপে না নেয়া হলে- তা হবে শত ট্রেন মিস করার সমান। অর্থাৎ মহাবিপর্যয় অনিবার্য হয়ে দাঁড়াতে পারে। জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডাঃ লেনিন চৌধুরী বলেন, কমবেশি সব জেলায় করোনার রোগী থাকার কারণে দিন দিন আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। আমরা শুরুতেই সংক্রমণ রোধের ট্রেনটা অবহেলায় মিস করেছি। এখন যা করছি, তাতে আরও বেশি অবহেলা, সমন্বয়ের অভাব দৃশ্যমান। তিনি বলেন, শুরু থেকে করোনা প্রতিরোধে সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে এর অনেকগুলোই অপরিকল্পিত। অনেকগুলো একেবারেই বাস্তবায়ন হয়নি। তিনি বলেন, যে জেলা বা অঞ্চলে বেশি রোগী সেগুলো চিহ্নিত করে লকডাউন দিয়ে নিবিড় অভিযান পরিচালনা করতে হবে। যাকে বলা হয় বৃত্তের ভেতরে আরেক বৃত্ত। কিন্তু আমার কাছে মনে হচ্ছে কোন স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এখন আর করোনা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না। বেশিরভাগ জেলায় পুরোপুরি রেড জোন ঘোষণা করে লকডাউন করার উপযোগী। পাশাপাশি ঢাকাকে পুরোপুরি লকডাউন করতে হবে অন্তত ১৫ দিনের জন্য। তাহলে আক্রান্তের সংখ্যা কমে আসবে। করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বিলম্ব হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, সম্প্রতি শ্রীমঙ্গল উপজেলাকে রেড জোন ঘোষণা করে লকডাউন করার চিন্তা করা হয়। ১৫ দিন পর এর বাস্তবায়ন করতে গিয়ে দেখা গেল একেবারেই সেখানে রোগীর সংখ্যা কমে গেছে। অর্থাৎ পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে বিলম্বিত হওয়ায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। যা এ রকম একটি স্পর্শকাতর রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য মোটেই সুখকর হতে পারে না। এতে বিপদ আরও বাড়তে পারে। পরিকল্পনা বাস্তবায়ন বিলম্বিত হওয়ার কারণে রোগীর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের রাশ টানাও সম্ভব হচ্ছে না। একদিনে আরও ৪৩ জনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে দেশে নতুন করে করোনাভাইরাসে মৃতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৭৩৮ জন। রবিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় আরও ৩ হাজার ৮০৯ জনের মধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়েছে। তাতে দেশে এ পর্যন্ত শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৭৮৭ জনে। আইইডিসিআরের অনুমিত হিসাবে গত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি রোগী ও বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নেয়া রোগীদের মধ্যে আরও ১ হাজার ৪০৯ রোগী সুস্থ হয়েছেন। এ নিয়ে সুস্থ রোগীর সংখ্যা ৫৫ হাজার ৭২৭ জনে দাঁড়িয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের নিয়মিত বুলেটিনে যুক্ত হয়ে অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা দেশে করোনাভাইরাস পরিস্থিতির এই সর্বশেষ তথ্য তুলে ধরেন। বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়েছিল ৮ মার্চ, তার দশদিনের মাথায় প্রথম মৃত্যুর খবর আসে। ১৮ জুন দেশে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ১ লাখ ছাড়িয়ে যায়। মৃতের সংখ্যা দেড় হাজার ছাড়িয়ে যায় ২২ জুন। আক্রান্ত বিবেচনায় মৃত্যুর হার এক দশমিক তিন ভাগ, আইসোলেশনে ৫৮ দশমিক তিন ভাগ, সুস্থতার হার ৪০ দশমিক চার ভাগ। স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় পরীক্ষা হয়েছে ১৮ হাজার ৯৯ নমুনা। প্রায় সাড়ে তিন মাসে পরীক্ষা করা হয়েছে সাত লাখ ৩৩ হাজার ১৯৭। বিশে^র আক্রান্ত জেলাগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৭তম। যেসব দেশ বেশি আক্রান্ত সেগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে দৈনিক পরীক্ষার সংখ্যা সবচেয়ে কম। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারত ও পাকিস্তানে সংক্রমণ বেশি। সেসব দেশও বাংলাদেশের থেকে বেশি পরীক্ষা করছে প্রতিদিন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকেও বারবার বলা হচ্ছে প্রতিরোধের অন্যতম উপায় হলো টেস্ট টেস্ট আর টেস্ট। যত পরীক্ষা তত সুরক্ষা। ৪৮ জেলায় রোগী বেশি ॥ স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী দেশের ৪৮ জেলায় করোনা রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। ঢাকা মহানগর বাদে ঢাকা জেলায় দুই হাজার ৮৫৬, গাজীপুর তিন হাজার ২৭০, কিশোরগঞ্জ এক হাজার ৮৩, মাদারীপুর ৬৬৬, মানিকগঞ্জ ৫৬৮, নারায়ণগঞ্জ পাঁচ হাজার ২১, মুন্সীগঞ্জ এক হাজার ৯৪৪, নরসিংদী এক হাজার ২৮০, রাজবাড়ী ৩৮৯, ফরিদপুর এক হাজার ৮২৭, টাঙ্গাইল ৫২৮, শরিয়তপুর ৪৭২, গোপালগঞ্জ ৬০৯ জন। চট্টগ্রাম বিভাগের চট্টগ্রাম জেলায় করোনায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সাত হাজার ৪৬৪, কক্সবাজার দুই হাজার ৩৫০, কুমিল্লায় তিন হাজার ৭৪, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ৭৩৩, লক্ষ্মীপুরে ৭৬৮, বান্দরবান ২৬৬, রাঙ্গামাটি ২২৩, নোয়াখালী দুই হাজার ১৩, ফেনী ৭৮৬, চাঁদপুর ৮০৫ জন। সিলেট বিভাগের সব জেলয় রোগীর সংখ্যা বেশি। এর মধ্যে মৌলভীবাজারে ৪১৪, সুনামগঞ্জে ৯৫৯, হবিগঞ্জে ৫৮৫, সিলেটে দুই হাজার ১৭৪ জন। রংপুর বিভাগে চার জেলায় রোগীর সংখ্যা দুই শ’র কম। এর বাইরে রংপুরে ৮৩৫, গাইবান্ধায় ২৩৬, নীলফামারী ৩২৭, দিনাজপুর ৫৬৩ জন। খুলনা বিভাগের খুলনা জেলায় এক হাজার ৫৫১, যশোর ৫১৪, কুষ্টিয়া ৫৩৫, চুয়াডাঙ্গা ২০৩ রোগী পাওয়া গেছে। ময়মনসিংহ বিভাগের ময়মনসিংহ জেলায় এক হাজার ৬১৩, নেত্রকোণা ৪৫৭, শেরপুর ২৩৫, জামালপুর ৫৪২ জন। বরিশাল বিভাগের বরিশাল জেলায় রোগীর সংখ্যা এক হাজার ৩৭৮, ভোলা ২৩৬, পটুয়াখালী ৩১৬ জন। রাজশাহী বিভাগের জয়পুরহাটে করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে ৩২৪, পাবনা ৪৩০, বগুড়া দুই হাজার ৭১৩, নওগাঁ ৩৮৪, সিরাজগঞ্জ ৩৬৯, রাজশাহী ৫১৩ জন। ১৬ জেলায় কম রোগী ॥ দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ১৬ জেলাতে রোগীর সংখ্যা কম পাওয়া গেছে। আইইডিসিআরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এসব জেলার মধ্যে রয়েছে, খাগড়াছড়ি ১৮৮, লালমনিরহাট ৭৬, কুড়িগ্রাম ১৩০, পঞ্চগড় ১৩২, ঠাকুরগাঁও ১৯৬, বাগেরহাট ১৬৬, নড়াইল ১৫৩, মাগুরা ৯৭, মেহেরপুর ৫৯, সাতক্ষীরা ১৫৯, ঝিনাইদহ ১৬৫, বরগুনা ১৭৯, পিরোজপুর ১৫৫, ঝালকাঠি ১৬৬, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ৯৯ ও নাটোর ১৫৮ জন। কয়েক দফায় দেশের ১৯ জেলার বিভিন্ন এলাকাকে রেড জোন ঘোষণা করেছে সরকার। এসব এলাকায় রেড জোন ঘোষণার পরবর্তী ২১ দিন সাধারণ ছুটি থাকবে। গত মঙ্গলবার এ সংক্রান্ত এক প্রজ্ঞাপন জারি করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। জেলাগুলো হলো- কক্সবাজার, মাগুরা, খুলনা ও হবিগঞ্জ। সাধারণ ছুটিতে করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে ওইসব এলাকায় সরকারী, বেসরকারী সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। এসব এলাকার যেসব বাসিন্দা অন্য এলাকায় চাকরি করেন, তাদের জন্যও ছুটি প্রযোজ্য হবে। তবে জরুরী পরিষেবা ছুটির আওতামুক্ত থাকবে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ‘লাল অঞ্চল ঘোষিত এলাকায় অবস্থিত সব সরকারী, আধা-সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিত, সংবিধিবদ্ধ ও বেসরকারী অফিস, প্রতিষ্ঠান ও সংস্থায় কর্মরত ও অন্য এলাকায় বসবাসরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ক্ষেত্রেও এ ছুটি প্রযোজ্য হবে। এর আগে দেশের ৫ জেলার ১১ অঞ্চলকে রেড জোন হিসেবে ঘোষণা করায় সেখানে সাধারণ ছুটির প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এ নিয়ে ১৯ জেলার ৪৫টি অঞ্চলকে ভাইরাস বিস্তারের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বা ‘রেড জোন’ ঘোষণা করে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হলো।
×