ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বিএনপি এমপির ওয়াকআউট

একাদশ জাতীয় নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তোলায় উত্তপ্ত জাতীয় সংসদ

প্রকাশিত: ২২:৪০, ২৪ জুন ২০২০

একাদশ জাতীয় নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তোলায় উত্তপ্ত জাতীয় সংসদ

সংসদ রিপোর্টার ॥ প্রস্তাবিত বাজেটের উপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ আদালত কর্তৃক দÐিত আসামি খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের মুক্তিসহ একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ মন্তব্য করলে সংসদে কিছুক্ষণের জন্য উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে। সরকারী দলের সংসদ সদস্যরা এ সময় ক্ষোভে ফেটে পড়েন এবং তীব্র হৈচৈ করে বিএনপি এমপির অসংসদীয় বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবি জানান। এ সময় স্পীকারের আসনে থাকা ডেপুটি স্পীকার এ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বি মিয়া অসংসদীয় শব্দগুলো সংসদের কার্যবিবরণী থেকে এক্সপাঞ্জ ঘোষণা করলে প্রতিবাদে সংসদ থেকে ওয়াকআউট করে চলে যান বিএনপির ওই সংসদ সদস্য। এক সপ্তাহ মুলতবির পর মঙ্গলবার বেলা ১১টায় স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্ব সংসদের বাজেট অধিবেশন শুরু হয়। স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্বল্পসংখ্যক সংসদ সদস্য অধিবেশনে যোগ দেন। প্রথমেই ঐতিহ্যবাহী ও দেশের প্রাচীন রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ৭১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বক্তব্য রাখেন সংসদ নেতা শেখ হাসিনা। এরপর প্রস্তাবিত ২০২০-২১ অর্থবছরের ওপর সাধারণ আলোচনা শুরু হয়। ডেপুটি স্পীকার এ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বি মিয়ার সভাপতিত্বে বাজেট আলোচনায় অংশ নেন কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক, শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম, সরকারী দলের আমিরুল হক মিলন, উম্মে কুলসুম স্মৃতি, শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন, বিএনপির হারুনুর রশীদ এবং বিরোধীদলীয় চীফ হুইপ মশিউর রহমান রাঙ্গা ও জাতীয় পার্টির ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। বাজেট আলোচনার সময় বাধা এবং খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে দÐিত আসামি বলায় বিএনপির সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ সংসদ থেকে ওয়াকআউট করেন। আলোচনায় অংশ নিয়ে কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক প্রস্তাবিত বাজেটকে গণমুখী ও উন্নয়নমুখী আখ্যায়িত করে বলেন, টানা তিন মেয়াদে আমরা ১২টি বাজেট দিয়ে তা বাস্তবায়ন করেছি, সব লক্ষ্য আমরা অর্জন করেছি। প্রতিটি বাজেটের লক্ষ্যই ছিল বাংলাদেশের উন্নতি ও অগ্রগতি। করোনার কারণে গত তিন মাস দেশের অর্থনৈতিক চাকা প্রায় স্তব্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু সারাবিশ্বের মানুষ করোনা প্রতিরোধের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। করোনা চিরস্থায়ী হতে পারে না, এটা একদিন স্থবির হবেই। বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা আমরা অবশ্যই অর্জন করব। তিনি বলেন, বাজেট নিয়ে অনেক সমালোচনা শুনছি। বাংলাদেশ ব্যাংক দৃঢ়ভাবেই বলেছে, ব্যাংকে তারল্যের কোন সঙ্কট নেই, ঘাটতি ৮৭ হাজার কোটি টাকা নিলেও কোন অসুবিধা হবে না। তাই বাজেট বাস্তবায়ন কোন অসুবিধা হবে না। করোনার মধ্যেও আমাদের খাদ্যর কোন ঘাটতি নেই, বরং উদ্বৃত্ত। জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, অনেক দেশ বাজেট তৈরি করতে পারেনি। কিন্ত সঙ্কটের মধ্যেও প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী বাজেট দিয়ে জাতিকে গৌরবান্বিত করেছেন। তবে এবার দরকার ছিল ছকের বাইরে একটা বাজেট। কিন্তু বাজেট থেকে মনে হচ্ছে দেশে করোনা বলে কিছু নেই। এটি অস্বাভাবিক সময়ের একটি স্বাভাবিক বাজেট মাত্র। তিনি বলেন, করোনা মোকাবেলায় কারিগরি নয়, জনস্বাস্থ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞ টিম দ্রæত তৈরি করতে হবে, সার্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। উপজেলা পর্যায়ে রাজস্ব অফিস এবং ৫০ লাখের বেশি হাট বাজারকে রাজস্বের আওতায় আনলে বাজেটের টার্গেট পূরণ হবে। আমরা ধারে ঋণ নিয়ে ঘি খেতে চাই না। যারা দেশের অর্থ বিদেশে পাচার করে সেকেন্ড হোম করেছে, তাদের টাকা ফেরত আনতে হবে। করোনা পুষে রেখে অর্থনীতি শক্তিশালী হবে না, দুর্নীতি পুষে রেখে উন্নতি হবে না। শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি করোনা সঙ্কট মোকাবেলায় সরকারের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা কথা তুলে ধরে বলেন, উপযুক্ত পরিবেশ হলেই এইচএসসি পরীক্ষা নেয়া হবে। সরকারের সব প্রস্তুতি রয়েছে। করোনা মোকাবেলায় স্বাস্থ্য খাতে বাড়তি ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। টেস্টিং ও অক্সিজেন সরবরাহ বৃদ্ধির চেষ্টা চলছে। করোনার আঘাত অর্থনীতিসহ সব খাতেই লেগেছে এবং লাগবে। তিনি ইন্টারনেট ও মোবাইলের ওপর আরোপিত চার্জ প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের অন-লাইন শিক্ষা ব্যবস্থায় যেতে হবে। আর কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া অনৈতিক বলেই আমি মনে করি। বিএনপির এমপির সমালোচনা করে তিনি বলেন, কথায় কথায় কোরানের কথা বলা, আর এতিমের টাকা আত্মসাৎকারী দÐিত আসামির পক্ষে সাফাই গাওয়া- দুটো একসঙ্গে চলতে পারে না। তথ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ বলেন, পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতী দেশ হওয়া সত্তে¡ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছেন। করোনায় পৃথিবী স্তব্ধ হয়ে গেছে। এর মধ্যেও অর্থমন্ত্রী একটি সাহসী বাজেট দিয়েছেন। প্রতি বাজেটের সময়ই বিএনপি ও কিছু প্রতিষ্ঠান পাÐিত্য ফলাতে বলেন, বাজেট বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। কিন্তু আমাদের প্রতিটি বাজেট বাস্তবায়নের হার ৯৫-৯৬ ভাগ। সরকারের উচ্চাভিলাস ছিল বলেই প্রতিটি বাজেট বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশকে সবদিক থেকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। দেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ ত্রাণ বিতরণের পাশাপাশি এক লাখ কোটি টাকারও বেশ প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। ওয়ার্কার্স পার্টির ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ স্বাধীন লাল-সবুজ পতাকা অর্জনে নেতৃত্ব দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও বঙ্গবন্ধুকে কোনদিন মুছে ফেলা সম্ভব নয়। বিশ্বের অর্থনীতি যখন বিপর্যয়ের মুখোমুখি, উন্নয়ন খাত বিপর্যস্ত তখন আমাদের প্রবৃদ্ধি নির্ভর বাজেট করা উচিত হয়নি। বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ অপ্রতুল। করোনার মধ্যেও এম-১৯ মাস্কসহ স্বাস্থ্য সরঞ্জাম ক্রয় নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে। সংবিধান না পড়ে বাজেট প্রণয়ন করলে নানা ভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। কৃষি খাতে ভর্তুকি যাতে কৃষকরা পায় সেটা নিশ্চিত করার পাশাপাশি কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয় সমবায়ের মাধ্যমে করলে কৃষকরা উপকৃত হবে। করোনার কারণে দারিদ্র্যের হার অনেক বেড়ে যাবে, সেজন্য সামাজিক নিরাপত্তা সহায়তা আরও বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। মুজিবকোর্ট পরে সংসদ অধিবেশনে যোগ দেয়া বিএনপির হারুনুর রশীদ বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে অপসারণ করে উপযুক্ত কাউকে বসাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আহŸান জানিয়ে বলেন, স্বাস্থ্য অধিদফতর বিকলাঙ্গ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে, এটা পরিবর্তন করা দরকার। চীনা বিশেষজ্ঞ দল বলেছে, বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতিতে তারা হতাশ। এই যে সঙ্কট তৈরি হয়েছে, এই সঙ্কট জাতীয় সঙ্কট। এই সঙ্কট উত্তরণের জন্য জাতীয় ঐক্যমত গড়ে তুলুন। খালেদা জিয়া, তারেক রহমানসহ সব রাজনৈতিক নেতাদের মামলা প্রত্যাহার করুন। তিনি একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ উল্লেখ করলে এ সময় সরকারী দলের সংসদ সদস্যরা প্রতিবাদে ফেটে পড়েন, হৈচৈ করতে থাকেন। প্রতিবাদের মুখে বিএনপির এই সংসদ সদস্য আরও বলেন, উন্নয়নের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা বাদ দিতে হবে, মানুষকে বাঁচানোর রাজনীতির চিন্তা করতে হবে। উন্নয়নের ব্যয় কমাতে হবে, প্রয়োজনে মন্ত্রিপরিষদ ছোট করতে হবে। ব্যাংক লুটেরা, মাদক স¤্রাট, মানবপাচারকারী, শেয়ার কেলেঙ্কারির হোতারা এখন সমাজের ভদ্রলোক, ক্ষমতাধর ও প্রভাবশালী। প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এই সরকার। পুলিশ সরকার ও আওয়ামী লীগের গোলাম এবং দাস বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। প্রতিবাদের মধ্যেই নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে গেলে বিএনপির এই এমপি অতিরিক্ত সময় দাবি করলে স্পীকারের আসনে থাকা ডেপুটি স্পীকার ফজলে রাব্বি মিয়া একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন বলায় এ শব্দগুলো এক্সপাঞ্জ করে বলেন, ‘আপনি (এমপি হারুন) জাতীয় ঐক্যের কথা বলেছেন এটি সুন্দর প্রস্তাব। কিন্তু আপনি এমন দু’জন ব্যক্তির নাম উল্লেখ করেছেন যাদের কথা আমি সংসদের এই চেয়ারে বসে উচ্চারণ করতে চাই না। একটি নির্বাচিত সরকার কোন কনভিক্টেড (দÐপ্রাপ্ত) ব্যক্তির সঙ্গে ঐক্য করতে পারে না।’ এ সময় হারুনুর রশীদকে পুনরায় ফ্লোর দিলে তিনি স্পীকারকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলার পর আপনি এক মিনিট সময় বাড়িয়েছেন। আমি আর বক্তব্য দেব না। আপনি আমার বক্তব্যে ইন্টারাপ্ট করেছেন। এর প্রতিবাদে আমি সংসদ থেকে ওয়াকআউট করছি।’ এরপর তিনি সংসদ অধিবেশন থেকে চলে যান। বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মশিউর রহমান রাঙ্গা বিএনপির হারুনুর রশীদের বক্তব্যের সমালোচনা করে বলেন, বিএনপি কীভাবে বিরোধী দল হয়? সংসদে সাংবিধানিকভাবে বিরোধী দল একমাত্র জাতীয় পার্টি। উনারা সরকারীবিরোধী নাকি জঙ্গীদের দল তা তাদের বোঝানো উচিত। তারা সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে দÐিত আসামিদের নাম উচ্চারণ করেন এই সংসদে। এসব সংসদের কার্যবিবরণী থেকে এক্সপাঞ্জ করতে হবে। বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় থাকতে এমপি হয়েও আমার ছেলেকে অপহরণ ও হত্যার চেষ্টা করা হয়। সারাদেশে নির্যাতন চালায়। সেই দলের এমপিরা সংসদে এসে বড় বড় কথা বলেন। জাতীয় পার্টির ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ প্রস্তাবিত বাজেটকে ‘আশাবাদী বাজেট’ হিসাবে আখ্যায়িত করে বলেন, দেশের অর্থনীতিতে শক্তি আছে, এখনও মজবুত রয়েছে। কালো টাকা সাদা করার সুযোগ প্রদানের সমালোচনা করে তিনি বলেন, এই সুযোগে ইয়াবা, ক্যাসিনো, অস্ত্র, চোরাচালান ও দুর্নীতির টাকা সাদা হবে। এই সুযোগ দিলে বর্তমান সুশাসন ও দুর্নীতিমুক্ত করার অবস্থান নড়বড়ে হয়ে যাবে। এতে ১৫-২০ হাজার কোটি টাকা আসতে পারে, কিন্তু আমাদের বাজেটে এই টাকা কিছুই না। তবে কেন দুর্নীতিবাজদের সুযোগ দেব? আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, স্বাধীনতা-মুক্তিযুদ্ধ-বঙ্গবন্ধু, এক অভিন্ন নাম। ৭১ বছর বয়সী আওয়ামী লীগকে ২৬ বছর নেতৃত্ব দিয়েছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ হাসিনা আর ৪০ বছর ধরে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তারই কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। দেশের স্বাধীনতার জন্য ৪ হাজার ২৬৮ দিন কারাগারে বন্দী জীবন কাটিয়েছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খুনী জিয়াউর রহমানরা আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার অনেক চেষ্টা করেছে। তাঁর কন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য ১৯ বার হামলা করা হয়েছে। সব মন্ত্রী-এমপিরা যদি সততার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়নের ক্লান্তিকর প্রচেষ্টায় সহযেগিতা করেন, তবে দেশ অবশ্যই কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছবে।
×